বাংলাগাঁথা

রক্তগঙ্গা
Published : 17 Feb 2012, 06:09 PM
Updated : 17 Feb 2012, 06:09 PM

বাংলাগাঁথা
(ভাষা হিসাবে বাংলার শক্তি বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর অবস্থান নির্ণয়ের চেষ্টা)

বাংলা প্রাচীনতম এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষার একটি। প্রচুর সাহিত্য এবং ধর্মগ্রন্থ এই ভাষায় রচিত হয়েছে, ধ্বনিতাত্ত্বিক বিচারে বাংলার গঠন খুব উঁচুমানের। সহজ করে বল্লে বাংলায় যারা কথা বলে অন্যান্ন ভাষা তারা সহজে উচ্চারন করতে পারে এবং সহজে শিখতেও পারে। ব্যবহারিক দিক দিয়ে বাংলা ভাষার স্থান পঞ্চম। একটি ভাষা স্বয়ং সম্পুর্ণ হতে গেলে তার নিজস্ব অক্ষর এবং ব্যাকরণ থাকা প্রয়োজন। বহুল প্রচলিত অনেক ভাষা আছে যেমন উর্দু, ফ্রেন্স- যাদের নিজস্ব বর্ণমালা নেই, সেই দিক দিয়ে বাংলা পরিপূর্ণ একটা ভাষা। এই ভাষার খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা খুব বেশি। ঔপনিবেশিকতার কারনে হাজার বছর ধরে এই ভাষার উপর আগ্রাশন চলেছে ভিনদেশী পশুদের কিন্তু এই ভাষাটি কোনোদিন কোনঠাসা হয়ে যায়নি বরং বিদেশী শব্দাবলি নিজের মতো করে বদলে নিয়ে নিজেকেই সমৃদ্ধ করেছে। প্রাকৃতজনের ভাষা হওয়ায় এর লোকোজ উপাদান পৃথিবীর অন্য যেকোনো ভাষার চেয়ে সমৃদ্ধ। অঞ্চল (সিলেট, চাটগাঁ, নোয়াখালী ইত্যাদি) এবং সাংস্কৃতিক পার্থক্যের কারনে এই ভাষার গ্রহনযোগ্যতা হ্রাস পায়নি বরং আরও শক্তিশালী মাধুর্যময় হয়ে উঠেছে।

প্রত্যেক ভাষা-ই ঐ জাতীর একটি বড় শক্তি। প্রাচীনকাল থেকে এই ভাষার মাধ্যমেই এক জনপদের মানুষ অন্য জনপদের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি এমনকি অর্থনীতির উপরেও আগ্রাসন চালিয়েছে। সরাসরি সাম্রাজ্যবাদের যুগে সেই অস্ত্রটি আরও ধারালো হয়ে উঠেছে বলেই বিভিন্ন দেশের গনমাধ্যম ভিনদেশী ভাষায় তাদের মতাদর্শ প্রচার করতে শুরু করেছিল। অর্থাত আমাদের ভাষায় অথচ সাম্রাজ্যবাদীদের চোখ দিয়ে ঘটনাবলী দেখতে হচ্ছে। ইংরেজি ভাষা প্রতিষ্ঠার পেছনে কামানের গোলা আর অনূদিত বাইবেল প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। এই শক্তিতে পরাজয়ের ফলে ঢাকা হয়েছিল ডাক্কা আর কলকতা হয়েছিল ক্যালকাটা। সেই থেকে নব্য ধামাধরা একটা আগাছা জন্মালো যারা শুধুমাত্র চামড়ায় বাঙালি কিন্তু ভাষায় চোস্ত ইংরেজ। ঠাকুর হলো ট্যাগর, রায় হয়ে গেল রয়, চট্টপাধ্যায় হলো চ্যাটার্জি, ভট্টাচার্য হলো ব্যানার্জী। বাংলাদেশের ভুঁইফোড় ধনীকশ্রেণীও সেই প্রজাতির। অথচ ১৭৫৫ সালে স্যামুয়েল জনসন এর আ ডিকশনারি অব দ্য ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ বের না হবার আগে ইংরেজী ভাষাটিও ল্যাটিন ভাষার চাপে ম্লেচ্ছদের ভাষা হিসেবেই পরিগণিত হতো।

বাঙালি কোনো সাম্রাজ্যবাদী জাতীর নাম নয় তাই বাংলা ভাষার কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই। ফার্সি, ইংরেজী, উর্দু ভাষার নাম শুনলেই মনে পড়ে আমরা একসময় পরাধীন ছিলাম। আর এখন নব্যবাজারি যুগে চলছে হিন্দির দৌরাত্ম। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অন্যতম মাধ্যম তো ভাষা-ই। নিউ ইঅর্ক, লন্ডন, বার্লিন, বেইজিং, মস্কো, দোহাতে যে রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম আছে তার একটা বড় অংশেই আছে বিদেশী ভাষায় প্রচারনা। বাংলা ভাষারও তেমনি একটা রাজনৈতিক শক্তি থাকা চাই। সেই শক্তি অর্জনের মূল শর্ত হলো ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয়ভাবে এই ভাষার জন্যে একটা অহংবোধ তৈরি করা। সেজন্য সবার আগে আনতে হবে চিন্তার বৈশ্বিকতা এবং দূরদৃষ্টি। এটার প্রথম ধাপ হচ্ছে-নিজের ভাষাটার ঐতিহ্য সম্পর্কে আগে জানতে হবে। হীনমন্যতায় ডুবে থাকলে কোনো ভাষাই আপনাকে তৃপ্তি দেবে না। না জানবেন নিজের ভাষাটা, না পারবেন ভিনদেশী কোনো ভাষাও। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ যদি অতিউচ্চ শিক্ষিত লোকের প্রয়োজন হয়, তার মধ্যে ষাট ভাগ লোকের ইংরেজীতে সুশক্ষিত হওয়া আরও জরুরি। কিন্তু তার চেয়েও মারাত্মক জরুরী বিষয় হলো কমপক্ষে ৯০ শতাংশ লোক তার সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, ধর্ম, রাজনীতি, উৎপাদনে নিজের ভাষায় প্রকৃত শিক্ষিত হওয়া। জাতী হিসেবে সুশিক্ষিত হলে গর্ববোধটা এমনিই এসে যাবে। তখন ইংরেজ আর সৌদিরা এসে হাত কুর্ণিশ করে দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকবে।

বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চলের মানুষগুলো স্বভাবতঃই স্থানীয় জীবনাচারনে বিশ্বাসী এবং অপেক্ষাকৃত কম বস্তুবাদী। ফলে টাকা কখনও ডলার, পাউন্ড বা ইয়রোর মতো শক্তিশালি আন্তর্জাতিক বিনিময় মাধ্যম হয়ে ওঠেনি। ফলঃশ্রুতিতে ভাষাটাও ইংরেজি, ফ্রেন্স বা স্পানিশ এর মতো অর্থনৈতিক শক্তির উপর ভর করে বিস্তৃত হতে পারেনি। আদিতে বাংলা প্রাকৃত জনের ভাষা হলেও এখন তা মধ্যবিত্তেরও ভাষা। বাংলা কখনই রাজপ্রাসাদ বা কর্পোরেট সমাজের ভাষা নয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পরে ধীরে ধীরে তা বাংলাদেশের দাপ্তরিক ভাষা হয়ে ওঠার কথা ছিল। যদিও সরকারের লজ্জাজনক উপেক্ষা এবং বিশ্বায়নের চাপে সেটা আজও সম্ভব হয়নি। যে কাজগুলো অনেক আগেই বাংলা একাডেমির করার কথাছিলো সেগুলোই সাধরন মানুষ ব্যক্তিগত উদ্দ্যোগে করেছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করেছে। প্রতিষ্ঠানটি আজও ব্যবহারিক বাংলার কোনো প্রমিত নির্দেশনা দিতে পারেনি। বিভিন্ন গণমাধ্যমের ভাষার ধরন আজও বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়ে আছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট বাংলাভাষার বিস্তারে একটা কাজও করতে পারেনি যে কারনে পৃথিবীর মানুষ এর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে জানতে পারবে। একটা ভাষার গৌরবকে ছড়িয়ে দিতে এবং গ্রহনযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে পরিকল্পনা এবং বিনিয়োগের প্রয়োজন। মানুষ কেন আজ হিন্দি-ইংরেজি ব্যবহার করে ঠাঁটবাট দেখায়? যদি ঐসব ভাষার মতো বাংলায়ও যথেষ্ট পরিমানে ছোটোদের কার্টুন থাকতো, টেলিভিশনের সিরিয়াল থাকতো, চলচ্চিত্র থাকতো, আইন-বিজ্ঞানের বই থাকতো, অনুবাদ থাকতো তাহলে মানুষ হুমড়ি খেয়ে ওসব খেতো না। এই কাজগুলো করার কথা ছিলো সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের, বাংলা একাডেমি এবং বিশ্ববিদ্যালয় বা বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের। অর্থনৈতিক সংকট কোনো কারন নয় বরং নির্জলা সত্য হচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্রেরনা না থাকাতেই ভালোমানের কাজগুলো যথাসময়ে হচ্ছে না। ফলে মানুষ বাধ্য হচ্ছে অস্বাভাবিক উপায়ে তাদের বিনোদন চাহিদা মেটাতে।

বাংলার ভাষার রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক শক্তি নেই বলে একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েনি। দেরীতে হলেও বাঙালি সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর উত্থানের সাথে তাল মিলিয়ে এভাষার সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতার শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৭৭৮ সালে হ্যলহেডের বাংলা শেখার ব্যাকরণ বইয়ের ভেতর দিয়ে বাংলা বর্ণমালারা আধুনিক মুদ্রনযুগে প্রবেশ করেছিলো। তারপর মুনির চৌধুরী'র কাছে ১৯৬৫ সালের দিকে সেজেগুঁজে টাইপরাইটারের শলাকার মাথায় বসে। মুস্তাফা জব্বার ১৯৮৭ সালে এদেরকে কম্পিউটার এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন এবং পরে নাম দেন বিজয় কীবোর্ড। এবং ২০০৩ সালে শুরু হওয়া অমিক্রন ল্যাবের মেহেদী, তাবিন ও শিহাব মুস্তাফা অভ্র কীবোর্ড নামে বর্ণমালাগুলোকে আন্তর্জালিক জগতে মুক্ত করে দেন ২০১০ সালে। বাংলা তখন ইংরেজী ও ইউরোপিয় অন্য ভাষাগুলোর সাথে নতুন প্রতিযোগীতায় সামিল হয়। ব্রাক ইউনিভার্সিটির CRBLP তৈরি করেছে বাংলা লিখন থেকে শব্দায়ন এবং শব্দ থেকে লিখন প্রকৃয়ার সফ্টওয়ার। শিগ্গিরি আমাদের সামনে আসবে সম্পূর্ণ বাংলা উইন্ডোজ এবং বাংলা মোবাইল ফোন। তখন যেকোনো ইলেক্ট্রনিক্সের জন্য প্রয়োজনীয় সফট্যয়ার আমরা বাংলায় বানাতে পারবো।

বাংলাদেশ ও ভারতের বাইরে বাংলাভাষা ও সাহিত্য নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হচ্ছে লন্ডন (SOAS), শিকাগো, ইন্ডিয়ানা, মেলবোর্ন, হাইডেলবার্গ, প্যারিস, টরন্টো, অটোয়া, এডিনবার্গ, সরবোর্ন, মস্কো, প্যাট্রিস লুলুম্বা এমনকি করাচি বিশ্ববিদ্যালয়েও। যদিও এসব হয়েছে মূলতঃ ব্যক্তিগত উদ্যগে। বাংলাদেশের সরকারী পর্যায় থেকে কোনো উদ্যোগ আজও নেয়া হয়নি। উপোরোক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশী গবেষকেগণ বাংলাচর্চায় উৎসাহী হয়ে নিজের ভাষায় অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ ছাড়াও বাংলা শেখার চমকপ্রদ সব বই। আরও একটি মজার তথ্য হচ্ছে জাতীপুঞ্জের শান্তি মিশনে বাঙালি সৈন্যদের কারনে আইভেরি কোস্টের মানুষের মুখে মুখে এখন বাংলা নিত্যদিনের ভাষা। এসব থেকে প্রমানিত হয় যুগের সাথে তাল রেখে এভাষা মানুষের মনের ভাব প্রকাশে সক্ষম। সমৃদ্ধ উপাদানের কারনে কোনো বাধা একে দুর্বল করতে পারেনি। এই মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন এভাষার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি সৃষ্টি করা, রুচির সাথে সঙ্গতি রেখে বিনোদনের উপাদান বৃদ্ধি করা, শিক্ষা ও প্রশাসনের প্রধান ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা। সেই সাথে সরকার ও তার সংশ্লিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানকে বিনিয়োগ ও বাস্তবিক পরিকল্পনা গ্রহন করতে বাধ্য করা।