ইতিহাসের সাক্ষী হতে চীনের মহাপ্রাচীর ভ্রমণ

রনি ভৌমিক
Published : 1 Jan 2015, 09:37 AM
Updated : 1 Jan 2015, 09:37 AM

[ছবি ক্যাপশন: মেডেল গলায় ঝুলিয়ে 'হিরো অব গ্রেট ওয়াল' রনি ভৌমিক , ইউনিভার্সিটি অব চাইনিজ একাডেমী অব সাইন্স, বেইজিং, চীন ।]

তোমরা কি কখনও দেয়াল টপকে স্কুল পালানোর কথা ভাবো ? এমন কাজ না করাই ভালো । ছোট বেলায় আমি অনেক গাছে উঠতাম অনেকটা শখের কাজ ছিল এটি আমার , আর স্কুল জীবনে অনেকবার দেয়াল টপকিয়ে স্কুল পালিয়েছি । মনে আছে একবার আমি বাড়ির ছাদের উপর ক্রিকেট খেলার সময় পরে গিয়ে হাত বেঙ্গে ছিলাম । আমরা দেখি যে , স্কুল বা বাড়ির চারপাশে দেয়াল থাকে এমন কি দেয়াল থাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভবনের চারপাশেও ; যেন কেউ হঠাৎ ঢুকে পড়তে না পারে । দেয়াল থাকে জেলখানার চারপাশেও , সে ভীষণ উঁচু দেয়াল দেওয়ার কারণ যাতে কয়েদিরা পালিয়ে যেতে না পারে । আমাদের সবারই জানা আছে যে, এমন একটা দেশ আছে, যে দেশ দেয়াল দিয়ে ঘেরা ; সে দেশটির নাম চীন ।

চীনের কথা বললেই যে শব্দটি আমাদের মনে প্রথম উঁকি দেয় তা হচ্ছে চীনের মহাপ্রাচীর । একে চীনা ভাষায় বলা হয় 'ছাংছং' । 'ছাংছং'-এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে দীর্ঘ দেয়াল । এটি মানুষনির্মিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্থাপনা । এমনও কথিত আছে যে , চাঁদ থেকেও এই স্থাপনা নাকি অবলোকন করা যায় । চীনের মহাপ্রাচীর মানুষের হাতে তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থাপত্য । বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি হচ্ছে চীনের এই মহাপ্রাচীর । বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হওয়ার পাশাপাশি এটি চীনের জাতীয় প্রতীকও বটে।

আমার মনে আগে একটি প্রশ্নের প্রায় উদয় হতো, প্রশ্নটি হচ্ছে: হাজার হাজার বছর আগে কেন এতো জনবল,সম্পদ,সময় ব্যয় করে এই মহা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল? আসলে এই মহা প্রাচীর নির্মাণের প্রধান লক্ষ্য ছিল বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে বিশাল এই দেশকে রক্ষা করা।

[ছবি ক্যাপশন: বাংলাদেশী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যারা এখন পিএইচডি ছাত্রছাত্রী , ইউনিভার্সিটি অব চাইনিজ একাডেমী অব সাইন্স, চীন ।]

আকৃতির দিক থেকে পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম দেশ, যার আয়তন ৯৫৯৬৯৬১ (বর্গ কি.মি) । দেশটির পুরো উত্তর সীমান্ত প্রাচীর দিয়ে ঘেরা । খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে, মানে আজ থেকে প্রায় দুই হাজার আটশ' বছর আগে, এই মহাপ্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু হয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজা এই প্রাচীরের বিভিন্ন অংশ তৈরি করেন। তবে ২২০-২০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীরের সবচেয়ে দীর্ঘ অংশ নির্মাণ করেন চীনের সম্রাট ছিন শি হুয়াং। ২১ হাজার ১৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রাচীরটি পরিচিত 'চীনের মহাপ্রাচীর' নামে। ছোটখাটো দেয়াল নয়, সে প্রাচীর ভীষণ উঁচু । আর এত চওড়া যে, পাঁচজন ঘোড়সওয়ার পাশাপাশি যেতে পারতো । প্রাচীরটি কোথাও পাহাড়, কোথাও সমতল, কোথাও গেছে মরুভূমির ওপর দিয়ে । ইট-পাথর দিয়ে তৈরি চীনের এ প্রাচীর প্রায় ৫ থেকে ৮ মিটার উঁচু এবং ৮৮৫১.৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ । এটি চীনের সাংহাই পাস থেকে শুরু হয়ে লোপনুর নামক স্থানে শেষ হয়েছে ।

তবে সেই সময়ে নির্মিত প্রাচীরের তেমন কিছুই আজ আর অবশিষ্ট নেই । পরবর্তী ডাইন্যাস্টিগুলোতে এর নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ অব্যাহত থাকে। তবে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ছিন, হান এবং মিং ডাইন্যাস্টি । এই তিনটি ডাইন্যাস্টি মিলে নির্মিত প্রাচীরের দ্যৈর্ঘ প্রায় ১০০০০ কিলোমিটারের অধিক । বর্তমানে চীনের সিনচিয়াং, কানসু, নিনশিয়া, চিয়াংশি, ইনার মঙ্গোলিয়া, শানসি, হোপেই, পেইচিং, থিয়েনচিন, লিয়াওনিং, চিলিন, হোইলুংচিয়াং, হোনান, শান্তুং, হুপেই ইত্যাদি অঞ্চলে মহাপ্রাচীরের প্রাচীন অংশের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে ।

এই মহা প্রাচীর নির্মাণের স্বর্ণযুগ হচ্ছে মিং ডাইন্যাসটি (১৩৬৮-১৬৪৪)। বর্তমানে আমরা মহা প্রাচীরের যে অংশগুলো দেখতে পাওয়া যায় , তা মূলত মিং ডাইন্যাস্টিতে নির্মিত । এই সময়ে নির্মিত অংশ ৩৭৩ মাইলের বেশি দীর্ঘ । এতে রয়েছে ৮২৭ টি শহর প্রাচীর প্ল্যাটফর্ম, ৭১টি গিরিপথ এবং অগনিত দুর্গ । মিং রাজার সময়ে নির্মিত প্রাচীরের যে অংশগুলো মোটামুটি ভালোভাবে সংরক্ষিত রয়েছে সেগুলো হচ্ছে: বাদালিং, মুথিয়ানাইয়ু, সিশাথাই, চিনশানলিং, হুয়াং হুয়া চং, কুপেইখৌও, চিয়ানখৌও ইত্যাদি।

তবে এর মধ্যে দেশি বিদেশি পর্যটকদের মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে 'মুথিয়ানাইয়ু' । মহা প্রাচীরের এই অংশটিই প্রথম সাধারণ পর্যটকদের জন্যে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল । বেইজিং শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তরে ইয়ানছিং কাউন্টিতে এর অবস্থান । মিং ডাইন্যাস্টিতে এটি ভৌগোলিক ও সামরিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল ।

ইউনিভার্সিটি অব চাইনিজ একাডেমী অব সাইন্স, বেইজিং এ আমরা তখন সাত জন বাংলাদেশী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পি.এইচ.ডি করতে এসেছিলাম আর বিশ্বের ১৪০টা দেশ থেকে ছিল অন্যরা, আমরা ছিলাম মোট ১৬০ জন কিন্তু আমি ছিলাম বয়সের দিক থেকে সবচেয়ে ছোট জন । বেইজিং এ লেখাপড়া করছি আর চীনের মহাপ্রাচীর দেখা হবে না তাহা কি করে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগ পরিকল্পনা করলেন আমাদেরকে নিয়ে চীনের মহাপ্রাচীর দেখাতে নিয়ে যাবেন যে কথা সেই কাজ । কিছুটা শীত শীত আবহাওয়া ছিল, শনিবার সকাল সাড়ে ৮টায় আমাদের যাত্রা শুরু হলো, আমি পরেছিলাম লাল সবুজের পতাকা সম্বলিত টিশার্ট , সাথে ব্যাগে আরও দুইটা বাংলাদেশের মানচিত্র ও ইতিহাস সম্বলিত টিশার্ট নিয়ে নিয়েছিলাম ছবি তোলার জন্য আর হালকা কিছু শুখনো খাবার এবং পানি নিয়েছিলাম সাথে । ঘণ্টাখানেক চলে ইয়ান পর্বতের কোল ঘেঁষে থেমে যায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস । চেয়ে দেখি, আরো অনেক স্কুল-কলেজ-ট্যুরিস্ট বাস হাজির হয়ে গেছে । বাস থেকে নামার সময় শিক্ষকেরা বলে দিয়েছিল দুই ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসতে হবে সবাইকে ।

চীনের মহাপ্রাচীর এই প্রবেশদ্বারের নাম মুথিয়ানাইয়ু । প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ৪০ ইউয়ান (১ ইউয়ান = ১৩ টাকা প্রায়) দিয়ে যে কেউ ঢুকতে পারে । উপরে ওঠার আগে ক্যামেরার সামনে বসে যাই বাংলাদেশী সবাই একবার এর জন্য ।

আগেই বলেছি যে বইয়ে পড়েছিলাম , প্রাচীরের ওপর দিয়ে ঘোড়া দৌড়ানো যেত , কিন্তু বাদালিং এর মহাপ্রাচীর দিয়ে শুধু পাহাড় উঠা যায় , মানে সিঁড়ি ডিঙানো যায় । সিঁড়ি অবশ্য চওড়া আছে, ৮-১০ ফুট । পরে আমাদের চাইনিজ শিক্ষিকা কে ব্যাপারটা জিজ্ঞাসা করার পর তিনি বললেন, প্রাচীরে ওঠার ১০-১২টি পয়েন্ট আছে। সমতলে প্রাচীর এত প্রশস্ত যে একসঙ্গে কয়েকটি ঘোড়া দৌড়াতে পারে । প্রতিদিন নাকি ২৫-৩০ হাজারের উপরে এখানে টুরিস্ট আসে । প্রতি ১৫০ মিটার পর পর বিশ্রামাগার । অল্প বিশ্রাম নিয়ে আবার চলতে থাকি আমরা । দ্বিতীয় বিশ্রামাগারের কাছে মিং রাজবংশের (১৫ শতক) আমলের পোশাক নিয়ে বসেছিল নাম তাঁহার মিঃ লিউ । তলোয়ারও রেখেছে কিছু, তবে এইসব বিক্রির জন্য নয়; ৩০ ইউয়ান নিয়ে এসব পোশাক ও অস্ত্র নিয়ে ছবি ওঠাতে দেয় ।

আর ৩০ মিনিট পরে দেখি দল অনেক ছোট হয়ে গেছে । যতই উঠছি, পাহাড় আরো সুন্দর হয়ে উঠছে । আমি আর আমার কিছু বন্ধু পরিকল্পনা করলাম সবচেয়ে বেশী উপরে উঠবো , যত সামনে যাচ্ছি মনে হচ্ছিল আর একটু গেলেই শেষ হয়ে যাবে কিন্তু কোন ভাবেই শেষ হচ্ছিল না ; এই দিক দিয়ে আমাদের কারোর কোন মোবাইলের নেটওয়ার্ক কাজ করছিল না কারণ তার মধ্যেই আমরা অনেক বেশী উপরে এবং অনেক দূরে চলে এসেছিলাম ।

তারপর আমরা সবার কথা চিন্তা করে গন্তবে ফিরে আসা শুরু করি , আসার পথে দেখি মেডেল বিক্রি করছে নাম ও তারিখ খোদাই করে দেওয়া হয়, তাহা দেখে আমার এক সহপাঠী বলল, চূড়ায় আসলাম 'হিরো অব গ্রেট ওয়াল' হবো , যেই কথা সেই কাজ মেডেল কিনে কিছু ছবি তুলাম ।

মেডেল গলায় ঝুলিয়ে এইবার বলা যায় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু করলাম ফিরতি পথ। ওপরে ওঠা যেমন কষ্টকর ঠিক নামাও অনেক বিপজ্জনক; পা ফেলতে হয় অনেক দেখেশুনে । দলের সবার সঙ্গে মিলিত হতে দুই ঘণ্টা ২০ মিনিট লেগে গেল, আন্তর্জাতিক বিভাগের সব শিক্ষকরা আমাদের চারজন এর জন্য অনেক চিন্তা করছিলো, যদিও অনেক রাগ করেছিলেন প্রথম পরে যখন আমাদের গলার মেডেল গুলো দেখলেন তখন অনেক খুশী হলেন ।

দুপাশের অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ এর সৌন্দর্যে যোগ করেছে বাড়তি মাত্রা । বছরের ৪টি ঋতুতে উপভোগ করা যায় চার ধরনের সৌন্দর্য । শীতকালে শুভ্র তুষারে ঢাকা প্রাচীর যেমন আপনার মনে এনে দিতে পারে এক ধরনের পবিত্র প্রশান্তি, তেমনি বসন্তের রঙবেরঙের ফুল আপনার মনকে করে তুলবে উত্ফুল্ল । গ্রীষ্মকালে গ্রেট ওয়ালের চারপাশের সবুজ স্নিগ্ধ পরিবেশ আর ঝিরিঝিরি বাতাস প্রশান্ত করবে আপনার মন ও হৃদয়কে ।

রনি ভৌমিক
ইউনিভার্সিটি অব চাইনিজ একাডেমী অব সাইন্স, বেইজিং, চীন ।