’দিবস’ হৃদয়ে আত্মস্থ করার বিষয়, ঢাকঢোল পিটিয়ে সব হয় না

রনি ভৌমিক
Published : 16 March 2015, 05:59 PM
Updated : 16 March 2015, 05:59 PM

একটা সময় ছিল যখন শুনতাম এবং জানতাম যে ভাইদের প্রতি বোনেদের অনেক বেশি দায়িত্ব থাকে, পালের হাওয়া পরিবর্তন হতে শুরু করেছে কারণ এখন যে দিন বদলের সময় । তাই বলে বলছি না যে বোন'রা তাঁহাদের ভাইদের কে আগের মতো খোঁজ খবর নেয় না! হয়তো নিতে চায় ডিজিটাল যুগের জন্য তাঁদেরকে আজ আর আগের মতো সেই সুযোগ হয়তো করে দেয় না ; আমার বোনেরা আজ শুধু জননী, সহোদরা, দয়িতা অথবা ঘরণী নয় আজ তারা শিক্ষাদাতা, নেত্রী, কর্মজীবী, সহকর্মী, এবং ব্যবসায়ী । ঘরে বাহিরে সব জায়গায় আজ তারা, আগে শুধুমাত্র দেখা যেতো উন্নত দেশ গুলোতে মেয়েরা তাঁহাদের যোগ্যতার প্রকাশ করতে পারতো, এখন আমাদের দেশের মেয়েরাও থেমে নেই ; আমাদের দেশের মেয়েরা এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বরং ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে গেছে, কিন্তু তারপরও বলবো উন্নত দেশের তুলনায় এখনো অনেক পিছিয়ে ।

প্রতি বছর ৮ই মার্চ পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী কর্মী দিবস যাকে আমরা সাধারণত বলে থাকি আন্তর্জাতিক নারী দিবস এইবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি । আমরা কাছে মনে হয় আমরা সবাই যে কোন দিবসের মর্ম বুঝি, আসলে কি আমরা তা জানি অথবা বুঝি অথবা মন দিয়ে বুঝার চেষ্টা করে থাকি? আমরা কি শুধু একটু লোক দেখানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের সভা-সমাবেশ এর মাঝে ব্যস্ত থাকি না?

আমরা প্রতিটা মানুষ কক্ষনো না কক্ষনো কোন কিছু নিয়ে ভয় পেয়েছি এমনকি ভয় পেয়ে থাকি, যেমন দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ঘর থেকে কেউ বাহিরে গেলেই তাঁহাদের সজনদের মন পরে থাকে কখন ভালো ভাবে ঘরে ফিরে আসবে , কারণ গুলো আমরা ভালো করেই জানি হরতাল, অবরোধ । সবসময় ঠিক এমনি করে অনিশ্চিয়তা আর ভয়ে আঁকড়িয়ে ধরে আমাদের দেশের মা-বোনদের, তাঁহারা খুব সহজে কোন কিছু বিশ্বাস করতে পারেন না কারণ ঘর পোড়া গরু সিধুরে মেঘ দেখলে ভয় পায় ।

আমরা যা চাই তা হয়তো সবসময় পাই না, আর এই না পাওয়া থেকে শুরু হয় জীবনের দুঃখ-কষ্ট কিন্তু যা চাই তাঁহা যদি সবসময় না পাই তাহলে কি আমাদের জীবন শেষ হয়ে গেলো, জীবন ব্যর্থতার অতল গহ্বরে তলিয়ে গেলো!

আমাদের দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলোর দিকে চোখ রাখলেই প্রতিদিন কোন না কোন একটা আত্মহত্যার ঘটনা চোখে পরে, সেই আত্মহত্যাগুলোর ৯০% শতাংশের মতো আমাদের মা-বোনদের। গতকিছু দিন আগে দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষবর্ষে পড়ুয়া এক বোন আত্মহত্যা করেছে, আমাদের পুরুষ শাসিত সমাজের প্রবাঞ্চনার আঘাতে ঘায়েল হয়েছে একটি ফুটন্ত গোলাপ। আমি পরে খবর নিয়ে জানতে পারলাম মেয়েটি একটা ছেলের সাথে মন দেওয়া নেওয়া করছিল, কিন্তু কিছু দিন পর ছেলেটি মেয়েটাকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছিল না কারণ ছেলেটির জন্য তার বাবা-মা মেয়ে পছন্দ করে রেখেছে । ছেলেটি কোন ভাবেই তার বাবা-মা'র কথার অবাধ্য হতে চায় না, কিন্তু মেয়েটি এর আগেই তার পছন্দের সেই ছেলের কথা বাসার সবাইকে জানিয়েছে। ছেলেটি যখন চূড়ান্ত ভাবে না করে দিয়েছে এবং মেয়েটির সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে মেয়েটি তখন আসতে আসতে নিঃসঙ্গতা অনুভব করতে শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে ।

আপনি যদি কোন কাজের সফলতা না পান অথবা কাউকে পাওয়ার কথা কিন্তু পেলেন না তাহলেই কি জীবনটা শেষ হয়ে গেলো! এমনও তো হতে পারতো সেই মেয়েটি যে ছেলের জন্য আত্মহত্যা করেছে তারচেয়ে অনেক ভালো ছেলে অপেক্ষা করছিলো তার জীবনের জন্য, আমরা কেন একটা কথা বারবার ভুলে যাই যে, সৃষ্টিকর্তা যা করেন তাঁহা জীবের মঙ্গলের জন্য করেন। এখন হয়তোবা অনেকে বলে উঠবেন মানুষের জন্মলাভ, বিয়ে এবং দেহাবসান হত্তয়া সবকিছু সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে হয়ে থাকে আমি নিজেও এই কথাটি মনে প্রাণে বিশ্বাস করে থাকি । কিন্তু কি তাই বলে আমরা আত্মহত্যাকে ও সর্বশক্তিমানের নির্দেশ বলবো নাকি আমাদের জীবনের নিকৃষ্ট ছবি বলবো !

আমরা পুরুষশাসিত সমাজ বহু যুগ আগে থেকেই মা-বোনদের একটা বন্দী খাঁচার মধ্যে রেখে দিতে চেয়েছি এবং এখনো চাই, আমাদের সমাজে এখনো দেখা যায় চাকরিজীবী মেয়েদের ভালো ভাবে নিতে পারি না পুরুষ সমাজ, বেশীর ভাগ পুরুষ চায় না তার পত্নী ঘরের বাহিরে চাকরী করবে, তারা চায় পত্নী শুধুমাত্র গৃহকত্র্রী হিসাবে স্বগৃহ দেখভাল করবে । আবার তাঁহাদের মাঝে যদিও কেউ কেউ স্ত্রীকে চাকরী করতে দেয় সেই ক্ষেত্রে কখনো কখনো দেখা যায় স্ত্রীর উপার্জনের টাকা তাদের স্বামীরা ব্যবহার করতে চান না। আমরা স্বামীরা মনে মনে চিন্তা করি যে স্ত্রীর উপার্জনের টাকা যদি নেই তাহলে সংসারে স্ত্রী'র আধিপত্য বেড়ে যাবে, যদি তাই না হতো তাহলে যে আপনার জীবনের বড় একটা অংশ যাকে নিয়ে আছে, তাহাকে ঘরের বাহিরে পাঠাতে অথবা তার উপার্জনের অংশ সংসারের কাজে ব্যাবহার করতে আপনার এতো অনীহা কেন ! আর আমাদের দেশে এখনো কর্ম ক্ষেত্রে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সুযোগ সুবিধা অনেক কম, সবচেয়ে বেশী দেখা যায় বেতন আর চাকরীর প্রোমোশনের সময় দেখানো হয় বিভিন্ন ধরনের অজুহাত । কিন্তু আমরা ভুলে যাই আমাদের দেশের প্রধান শিল্প বলতে যা আছে সেইটা হল পোশাক শিল্প এবং সেই পোষক শিল্পকে আজ এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন আমাদের দেশের অক্লান্ত পরিশ্রমী মা-বোনেরা । হে পুরুষ শাসিত সমাজ, কেন আজও আমরা ছলচাতুরি-প্রতারণা-ক্ষমতার জোর দেখিয়ে তাঁহাদের মন ভাঙ্গি ও অধিকার দাবীয়ে রাখি, তাহলে কি বলতে হয় আমরা শুধু লোক দেখানোর জন্য ডাকঢোল বাজিয়ে এই আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে থাকি!

আমাদের মা-বোনেরা কেন এখনো নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা নিতে পারেন না তার রহস্য আমার এখনো অজানা! আপনি চাকরীজীবী, ব্যবসায়ী, নাকি ঘরনী হবেন তার সিদ্ধান্ত নিজে নিতে শিখুন । কোন কাজে সফলতা না পেলে অথবা মনের ভিতরের অনেক দিনের লালিত স্বপ্ন পূর্ণ না হলে ভেঙ্গে না পরে অথবা আত্মহত্যার পথ বেঁছে না নিয়ে, জীবন সংগ্রামের পথে ভেঙ্গে না পরে আর শক্ত হোন এবং আরও ভালো কিছু পাওয়ার আশা করতে শিখুন । মনে রাখবেন জীবন একটাই এই জীবন দিয়ে নিজের জন্য কিছু না করতে পারেন বাবা-মা এবং দেশের জন্য কিছু করুন । আন্তর্জাতিক নারী দিবস লোক দেখানোর জন্য না পালন করে মন থেকে পালন করতে শিখুন। আমার দেশের মা-বোনদের প্রতি অনেক ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা জানিয়ে আজকের শেষ লেখার ইতি টানতে গিয়ে বলতে চাই আগামি দিনের সংগ্রামী জীবনে পৃথিবী জুড়ে আপনাদের জয়-জয়কার দেখার অপেক্ষায় রইলাম।

রনি ভৌমিক
গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব চাইনিজ একাডেমী অব সাইন্স, বেইজিং, চীন ।