ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট এর জন্য কি বাজারে শেয়ারের দাম বেড়ে যাবে!

রনি ভৌমিক
Published : 21 Sept 2015, 06:22 PM
Updated : 21 Sept 2015, 06:22 PM

কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে সারা পৃথিবীর এক নম্বর সমস্যা কি তাহলে আমার একটাই উত্তর সেইটা হল ক্ষমতার মোহ । ক্ষমতার মোহের আবির্ভাব দৈবক্রমে আসেনি, মানব সভ্যতার শুরু থেকে চলে আসছে ক্ষমতার মোহ, সুতরাং এটি মানুষের স্বভাব সুলভ আচরণ; আপনারা যদি রামায়ণ, মহাভারত পড়ে থাকেন তাহলে বুঝতে পারবেন ক্ষমতার মোহ কি এক আজব জিনিস । আর পার্থিব জগতের ক্ষমতার মোহ এবং দুর্নীতি একটি আরেকটির সাথে সম্পূর্ণরূপে জড়িত । দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে গেলে প্রশাসনে, প্রতিষ্ঠানে (সরকারি-বেসরকারি) স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সুশাসন এই তিনটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে ।

দীর্ঘ প্রতীক্ষা আর অনেক আলোচনা সমালোচনার পর চলতি মাসের ৬ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫, জাতীয় সংসদে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট (FRA) পাস হয়েছে । গত এক দশকেরও বেশী সময় ধরে অর্থনীতিবিদ এবং পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা এ আইনের জন্য বিভিন্ন সময় সরকারকে তাগিদ দিয়ে আসছিলেন । অপরদিকে শক্তিশালী একটি মহল শুরু থেকেই এই আইন প্রণয়নের উদ্যোগের বিরোধিতা করছিল সরকারকে বিভিন্ন ভাবে চাপের মধ্যে রাখছিল যাতে করে সরকার আইনটি পাশ না করে । শক্তিশালী এ মহলের চাপ কে পাশ কাটিয়ে আইন পাস করা সহজ ছিল না কিন্তু বয়সের ভারে ন্যুব্জ বলে পরিচিত, বিভিন্ন সময়ে দেওয়া তার বক্তব এবং সিদ্ধান্তর জন্য দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচিত সমালোচিত হয়ে আসছেন যিনি সেই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বৃদ্ধ আঙ্গুল দেখিয়ে দিয়েছেন শক্তিশালী এই মহলকে এবং শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখিয়েছেন আইনটির । এমন একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের জন্য এবং আইনটি পাশ করার জন্য বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের সকলকে সাধারন জনগণ এবং বিনিয়োগকারিদের পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন ।

ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট এর আওতায় ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (FRC) গঠিত হবে; প্রণীত হবে হিসাবমান যার প্রধান কাজ হবে আর্থিক নিরীক্ষা কাজ মনিটরিং করা । আইনটি পাস হওয়ায় কোম্পানির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে এবং বিশেষ করে পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে এবং ভবিষ্যতে অডিটরসদের মিথ্যা বা ভুয়া সার্টিফিকেট প্রদানের প্রবণতা কমে আসবে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদ, পুঁজিবাজার বিশ্লেষক সহ আমরা যারা সাধারণ বিনিয়োগকারী আছি । ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং আইনে বলা হয়েছে- এনজিও, বাণিজ্যিক কোম্পানি ও সরকারি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর আর্থিক হিসাবের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করবেন এবং নিরীক্ষা সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা যাবে । যাতে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে ।

ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টি বিলের ৪৮ ধারায় উল্লেখ আছে, যদি কোনো ব্যক্তি এ আইনের বা তদধীন প্রণীত বিধি প্রবিধি আছে, "নির্দেশনায় উল্লিখিত কোনো শর্ত ভঙ্গ অথবা অসাধু পন্থা অথবা মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে নিরীক্ষক হিসেবে নিবন্ধন লাভ করেন অথবা এ আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন করে, তবে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে" । এক্ষেত্রে অপরাধের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছরের জন্য কারাদণ্ড বা অন্যূন ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন বলে আইনে উল্লেখ আছে যা খুবই সামান্য কারণ আমাদের দেশে যারা এই ধরনের কাজে জড়িত তাহাদের কাছে ৫ লাখ টাকা হাতের ময়লা ।

আমরা অনেকেই জানি না কি করে নিরীক্ষকরা পুঁজি বাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারী এবং সরকারকে বৃদ্ধ আঙ্গুল দেখিয়ে অতিলোভী উদ্যোক্তাদের এবং নিজেদের পকেট ভারী করেন । প্রথমত, পুঁজিবাজারের কিছু অতিলোভী উদ্যোক্তা অসাধু নিরীক্ষকের সাথে যোগসাজশ করে কোম্পানির প্রকৃত আর্থিক চিত্র আড়াল করে মুনাফা বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেখায় এবং এর মাধ্যমে প্রভাবিত করা হয় প্রকৃত শেয়ারের মূল্যকে । দ্বিতীয়ত, কখনো কখনো কোম্পানির মুনাফা কমিয়ে দেখিয়ে বিনিয়োগকারী ও সরকারকে বঞ্চিত করা হয় তখন বিনিয়োগকারী তাদের প্রাপ্য লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে সরকার বঞ্চিত হয় তার প্রাপ্য রাজস্ব থেকে ।

আর স্বচ্ছতার কথা বলতে গেলে সবার আগে আসে আর্থিক স্বচ্ছতা । আমরা সকলেই এই পংক্তিটির সাথে পরিচিত, "অর্থই সকল অনর্থের মূল" কিন্তু মানব জীবনে অর্থের অত্যাবশ্যকতা কোন ভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই । তাই বলে এই অর্থ উপার্জন করতে হলে কি দুর্নীতি, ছলচাতুরি, প্রতারণা করা আবশ্যকীয় ? আর্থিক কর্মকাণ্ড যদি স্বচ্ছ না হয় তাহলে অনেকটা গুড়ায় গলদ হওয়ার মত, তখন অন্যান্য কাজে স্বচ্ছতা আশা করা অতীব কষ্টের । ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল প্রথম কাজ হবে সঠিক ভাবে সব জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা । ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট এর কারণে বাজারে শেয়ারের দাম বেড়ে যাবে বলে আশা করা ঠিক না, কারণ তাদের কাজ শেয়ারের দাম বৃদ্ধি করা নয় আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যাতে করে কোম্পানিগুলোর আর্থিক অবস্থার প্রকৃতচিত্র জানতে পারবেন বিনিয়োগকারীরা এবং সে অনুসারে বিনিয়োগকারিরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে ।

সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানির প্রধান মালিক, তাই পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানির যেসব জায়গায় জনসাধারণের বিনিয়োগ আছে সেগুলোর জবাবদিহিতা করা অত্যাবশ্যক । জনগণের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কোম্পানির উদ্যোক্তারা কী করছেন, কত লাভ করেছেন, লাভের কতটুকু জনগণকে দিয়েছেন, কোন ধরনের স্বজনপ্রীতি, প্রতারণা ও ছলচাতুরি করছে কিনা তাও দেখবে ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল ।

কাউন্সিলের অন্যতম আরেকটি কাজ হল প্রতিষ্ঠানগুলোর সঠিক ও সুশাসন নিশ্চিত । এই কাউন্সিলে সবার অংশগ্রহণ থাকবে; ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের জন্য সরকার মনোনীত একজনকে চেয়ারম্যান করা হবে । কাউন্সিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বা তার প্রতিনিধি থাকবেন; এছাড়া বিএসইসি, স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়, আইসিএবি এবং আইসিএমএবির প্রতিনিধি থাকবেন । কাউন্সিল এর কাঠামো এমন ভাবে করার কারণ হলো সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আর্থিক খাতে সুশাসন ও স্বচ্ছতা বাড়ানো ।

যদি শক্তিশালী ও কার্যকর ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল হয় তাহলে কারণে বাজারে শেয়ারের দাম বেড়ে যাবে এমন নয়; কিন্তু পুঁজিবাজারে আর্থিক প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা বাড়বে; বাজার গতিশীল হবে ও নিশ্চিতভাবেই পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং এতে করে বাজার, বিনিয়োগকারী ও সরকার সব মহল লাভবান হবে এমনকি বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে যৌথ বিনিয়োগে উৎসাহী হবে এবং আস্থা ফিরে পাবে বলে আমরা আশা করতে পারি । ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং অ্যাক্ট কার্যকর করা ও মনিটরিংয়ের জন্য ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল যেটি গঠিত হবে সেই প্রতিষ্ঠানটিকে হতে হবে অত্যন্ত শক্তিশালী ও কার্যকর । নাম মাত্র স্বাধীন ও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান না করে আমরা আশা করবো প্রকৃত অর্থেই স্বতন্ত্র স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গঠন করতে সহায়তা করবে সরকার । যদি তা করতে সরকার ব্যর্থ হয় তাহলে এই আইন পাশের কোন মানে থাকবে না এবং সবকিছু পণ্ডশ্রম বলে বিবেচিত হবে আর তার জন্য সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তাদের ন্যায্য মুনাফা থেকে বঞ্চিত হবে । প্রকৃত অর্থেই শক্তিশালী ও কার্যকর স্বতন্ত্র স্বাধীন ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল অপেক্ষায় থাকলাম ।

রনি ভৌমিক
গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব চাইনিজ একাডেমী অব সাইন্স, বেইজিং, চীন ।