মীন সমাচার

রুবু মুন্নাফ
Published : 28 July 2017, 02:10 PM
Updated : 28 July 2017, 02:10 PM

বিদ্যা শিক্ষার জন্য যানবাহন এক বিরাট মাধ্যম। আপনি লাইব্রেরী, বই-পত্র ঘেটে যে জ্ঞান অর্জন করবেন তা বলা যায় মুফতে পাবেন। মাত্র দশটি টাকা খরচ করে জ্ঞানের ভান্ডার নিশ্চিত। যাবতীয় অভিজ্ঞতার ভান্ডার এই যানবাহন। কার গ্রামে তিন মাথা বাছুর, কারও আবার মাছের ভান্ডার, কারও বাঘের হানা জাতীয় নানান হাবিজাবি অভিজ্ঞতার সমাহার। সেক্ষেত্রে আপনি জ্যামের অবদান অস্বীকার করার জো নেই। জ্যামের কারণে না আপনি এত বিশাল সময় পাচ্ছেন। না হলে পাঁচ দশ মিনিটের রাস্তা যেখানে ঘন্টা দু'ঘন্টায় গিয়ে ঠেকে সেখানে নিজের জ্ঞানের ভান্ডার স্ফীত করার এমন সুবর্ণ সুযোগ আর কই পাবেন?

সহকর্মী জুয়েলের কল্যাণে পুলিশ প্লাজার মোড় পর্যন্ত আসা গেল। তারপর হাতির ঝিলের চক্রাকার বাসের জন্য দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনীর মত অপেক্ষার পালা। যাত্রীর লাইন দেখে পিলে চমকে যাওয়ার মত অবস্থা। ঠিক যেন ছোট বেলার গ্রামের এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া পথের মত। এখন অবশ্য গ্রামের সে দৃশ্য জাদুঘরে। তো মোটামুটি শখানেক লোকের পিছনে দাঁড়াবার সৌভাগ্যে পুলকিত বোধ করলাম। কারন আমার পরেও লাইন মোটামুটি ফুলেফেঁপে উঠতে লাগল। গাড়ি আর আমাদের অবধি আসে না। পিপিলিকার পিলপিল পায়ে গাড়ির সারি এগোয়।

আমার সামনে দুই কপোত কপোতির মান-অভিমানের পর্ব চলছিল। কপট গাম্ভীর্য নিয়ে ভারত-পাকিস্তান স্নায়ু যুদ্ধ চলছিল। অবশেষে সে মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত। ধীর লয়ে গাড়ি এগিয়ে আসল। রাজ কপাল বলতে হবে। ইয়েস, সিট পেয়ে গেলাম। অনন্তকালের চক্র শেষ করল চক্রাকার বাস।

এবার আসি মূল বিনোদনে। রামপুরা ব্রিজ থেকে লেগুনায় দক্ষিণ বনশ্রীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। যথারীতি শিক্ষা সফরের জ্ঞান কে ঠেকায়। আহা রে! বলে একজন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। এইডা আছিল নদী! এখন খাল হইছে। রামপুরা খাল। এইসব বালখিল্যে কথা বার্তায় দর্শকের অভাব থাকলেও সমর্থকের অভাব হয় না। আরেকজন সায় দিয়ে বলল, হ ভাই, এহানে তো নৌকা নিয়া মেরাদিয়ার হাটে লোকজন আসা যাওয়া করত। দিনও আছিল আগের। কি না উঠত এহানে। যদিও তার চেহারার সাথে ইতিহাস মিলতে ছিল না।

যাক, প্রথম জন যার দুই দাঁতের মাঝখানে কিঞ্চিৎ ফাঁক আছে অর্থাৎ সিথা দাঁতি স্মৃতির আয়নায় সব দেখছিল। আহ! ভাই, কইলে কইবেন গফ কই; এই সেই দিনের ঘটনা। ইহ জগতে এত বড় রুই মাছ আমার চক্ষে দেখি নাই। ওই মাছের আঁইশ ঠিক এত বড়। তার হাত বৃত্তাকারে যতটুকু প্রসারিত করা যায় ততটুকু প্রসারিত করে। আহ! ভাই, কি কমু। আমি সিক্সে বা সেভেনে পড়ি তহন মনে করেন সতেরশ টাকা বেচছিল। আট নম্বরে থাকে মাদানি সাহেব কিনছিল। কি কমু ভাই, বাপে পোলায় গেছিল ট্যাটা নিয়া। পোলায় তো ছোট মানু, দিল মাথার মইধ্যে ঘাঁই। পোলারে সুদ্ধা টাইনা নিয়া যাইতেছে। মাছে মানুষে টানাটানি। বাপে টানে একদিক মাছে টানে একদিক। হ্যাষে মাছ টাইনা পোলারে ঐ দিকে নিয়া গ্যাছে। ঐ দিকে তাকিয়ে আমি এখন মিস্টার জহুরুল ইসলামের আফতাবনগরের দালান ছাড়া কিছুই দেখলাম না। তো ছেলেও নাছোড়, সে পণ করেছে ট্যাটা ছাড়বে না। অবশেষে ধরনী দ্বিধা হইয়া ট্যাটার উর্দ্দাংশ ভাঙ্গিয়া মাছে মানুষের লড়াইয়ের যবনিকাপাত ঘটিল।

সিঁথা দাঁতির জবানে আবার ফিরে যাই। বুঝলেন ভাই, হ্যাষে তিনদিন পর দেখা গেল মাছের চিপের মত কি যেন উঠানামা করতেছে। কচরি সরাই দেখল মাথার মধ্যে ট্যাটা আটকানো সেই মাছ। তহনো জীবিত আছে তয় নড়াচড়া বেশি করতেছে না। ওই মাছ দেহনের লাই দূর দূরান্ত তন মানুষ আইছে। তখনো তার মাথা অনবরত নড়তে ছিল আর মুখে অবিশ্বাসের রেশ চিকমিক করতে ছিল। মনে হচ্ছিল সে এখনো চোখের সামনেই সে ঘটনা দেখতেছিল। সিঁথা দাঁত আবার ও ফ্লাশব্যাকে ফিরে গেল। লেগুনা তখন ফরাজি হাসপাতাল অতিক্রম করছিল।

এহানে ভাই, কত বক মারছি। প্রজেক্টের কাম তহন চলছিল, কত বোয়াল মাছ পাওয়া গ্যাছিল। এহন তো গফের মত শোনায়। সিঁথা দাঁত মিশ্র ভাষায় তার বাতচিত চালাচ্ছিল। আরেক ভদ্রলোক জান নামধারী কারো সাথে মোবাইলে বাতচিত সেরে কাহিনিতে হামলে পড়ল। কি বলব ভাই, আমরা তো শহরে থাকি; একবার গ্রামে গিয়েছিলাম। এত বড় কাতল মাছের মাথা আমাকে দিল। আমি এক হাতে খেতে পারি নি। দুই হাতে তুলে খেতে হয়েছে। ভদ্রলোক দুই হাত তুলে দেখাতে গিয়ে ওনার জানের ব্যাপারটা আমার দৃষ্টিগোচর করলেন। কারন ওনার জান তখনো আকুল তিয়াসা নিয়ে মোবাইলে কান দিয়ে রেখেছে কার সাথে বাতচিত চলছে। আজ বুঝলাম জান পাখি, প্রাণ পাখি বলার জন্য বয়স বাধা হতে পারে না। আমি তখনো পুরাই শিক্ষা সফর মুডে আছি। আহা! এমন মুফতে জ্ঞান অর্জন সহজ ব্যাপার না।

আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ছয় সাত বছরে ও এমন জ্ঞানার্জন সম্ভব হয় নি যা আজ মাত্র দশ টাকা গাড়ি ভাড়া খরচ করে পাওয়া গেল। গন্তব্য বড় বেরসিক। এত দ্রুত চলে আসল। আস্ত এক লাইব্রেরী রেখে আমাকে নেমে যেতে হচ্ছে। আফসোস, আজকের জ্যাম কেন দীর্ঘ হল না।

রুবু মুন্নাফ
১৮-০৭-২০১৭
দক্ষিণ বনশ্রী, ঢাকা।