মুলা নাকি জাতে উঠেছে?

রুবু মুন্নাফ
Published : 4 Nov 2017, 03:40 AM
Updated : 4 Nov 2017, 03:40 AM

আগে বাজারে গেলে মুলা কেমন এতিমের মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত, কিন্তু দুঃখের বিষয় তার পানে খুব কম লোকজনই তাকাতো। দু'একজন যারা নেড়েচেড়ে দেখত তাতেই নিজেকে ধন্য মনে করত মুলা জাতি।

ছোটবেলায় আমরা একজন আরেক জনকে টিপ্পনী কাটতাম এই বলে 'ওর তো মুলার মত দাম'। প্রথম প্রথম এর মর্মার্থ না বুঝেই বলতাম। পরে যখন নিজে বাজার করতে যেতাম তখন মুলার মত দামের অর্থ উদ্ধার করতে সমর্থ হই। শীতের শুরুতে মুলা বেশ ভাল দামে বিক্রি হত। চীনা মুলা, বোম্বাই মুলা, দেশী মুলা, নানান হাবিজাবি টাইপের মুলা বাজারে পাওয়া যেত। আমরা স্কুল পড়ুয়া টাইপ যারা বাজার করতাম তাদের আর্কষণ ছিল বোম্বাই মুলার দিকে। তরকারি হিসেবে না; মুলার সাইজের জন্য। চারটা নিলে মোটামুটি সংগ্রাম করতে হত বাড়ী নিয়ে যাবার জন্য। তরকারী হিসেবে খেতে আমাদের ভালই অনীহা ছিল সেটা যত না স্বাদের জন্য ততটাই তার বিপরীত কারণে।

এমনিতে খেতে খারাপ না, তবে বায়ুদূষণ জনিত সমস্যা ছিল প্রকট। কলার মোছার সাথে মুলা ভাল রকম পিষে আমসত্ত্ব মিশিয়ে সাথে মরিচ দিয়ে বাগানে চুপিচুপি কিশোরের দল খেতে বসতাম। এক মুলার কারণে কত বিড়াল আর কুকুরের ঘাড়ে যে কত দোষ চাপানো হত তা ভাবলে আজও হাসি পায়। বায়ুদূষণ করে মুরুব্বিরা যখন দেখত সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে তখন অবলা কুকুর কিংবা বিড়াল যে সামনে পড়ত তার ঘাড়েই দোষ চাপত। দূর, দূর, দূর হ কুত্তার বাচ্চা।

তো যা বলছিলাম, মুলার প্রথম দিকের বাজার দর তেতে থাকতো পরে হত কি মুলা আর কেউ নিতে চাইত না। কেজি নিলে আট আনা কিংবা একটাকা দর হত। তখন অবশ্য মনুষ্য খাদ্য না গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হত। আর কৃষক হাফ ছেড়ে বাঁচত তার ক্ষেত খালি হত বলে। আশা করি মুলার মত দামের মর্মার্থ অনুধাবন করতে অসুবিধা হয় নি।

গত কয়েকদিন অফিসের হ্যাপার কারণে বাজার আর করা হয়ে উঠে না। আর বুয়া যথারীতি ডিম বাঙালির তকমা গায়ে এঁটে দিয়েছে। বাল্য বন্ধু সোহাগ এসে ডিম বাঙালির তকমা ছেঁটে দেবার উদ্যোগ নিল। তার সৌজন্যে রাত সায়ে আটটায় বাজারে গেলাম। মাছ কাটাকুটি করায়ে চিন্তা করলাম কি তরকারী নেয়া যায় আগামী দিনের জন্য। যেহেতু রান্নাটা নিজেই করতে হবে তাই শুধু মাছ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চেয়েছিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাঁচা বাজারে যেতেই হল। কাঁচা মরিচ একশ, পেঁয়াজ আশি, লাউ শাকের মুঠি ষাট, ঢেঁড়স ষাট, মোদ্দাকথা ষাটের নিচে কোন তরকারী নেই। মুলার দিকে তাচ্ছিল্য সহকারে তাকালাম। নাহ্ এইডা নিমু না, এইডা তো এমনি পাওয়া যায় টাইপ ভাব। তারপরও করুণা করে দাম জিজ্ঞেস করলাম। ওত্তেরি, মুলার গায়েও আগুন লাগছে। মুলাও নাকি ষাট টাকা। হায়! হায়! মুলা নাকি জাতে উঠছে। যেইটা ষাট বলতেছে, দেশী চিকন মুলা সেটা তো আমরা কিনার জন্য গোনায় ধরতাম না। তার আজ রাজ কপাল। তার দিন ফিরেছে, সে জাতে উঠেছে!

মুলার ঠিক বিপরীতে আমরা, মুলার দাম হুহু করে বাড়তেছে আর আমাদের দাম কমতেছে। আরো বেশি করে কমতেছে আমাদের মূল্যবোধ। আমরা সামান্য ব্যাপারে অন্যকে খুন পর্যন্ত করতে দ্বিধাবোধ করি না। পায়ু পথে বাতাস দিয়ে কাউকে মেরে ফেলা আজকাল ডালভাত খাওয়ার মত। খুঁটির সাথে বেঁধে কাউকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা আমরা রীতিমত শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছি। আমরা মুভির অনুুকরণে কাউকে খুন করে দিব্যি ঠান্ডা মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। চলন্ত গাড়ি আজকাল নারীর জন্য আতঙ্কের আরেক নাম। আমরা বৃদ্ধ বাপ-মা কে রাস্তায় ফেলে আসি আমাদের বোঝা কমানোর জন্য। এসব খারাপের মাঝেও আমরা স্বপ্ন দেখি। সব তো আর গোল্লায় যায়নি। আমরাও একদিন জাতে উঠব। গোরা কালার সাথে টক্কর দিয়ে আমরা বাদামীরাও সমান তালে এগিয়ে যাব। স্বপ্ন দেখতে তো আর দোষ নেই, স্বপ্ন দেখতে নেই মানা। মুলা জাতে উঠতে পারলে আমরা কেন পারব না।

রুবু মুন্নাফ
দক্ষিণ বনশ্রী, ঢাকা।