প্রথমে ভেবেছি একটি ফ্যান্টাসির ভেতর প্রবেশ করতে যাচ্ছি। অন্তত নামটা সেই রকমই “কমলা সুন্দরী”। ইয়স্তেন গার্ডার যাকে সাহিত্য প্রেমীরা ‘সোফির জগৎ’ এর লেখক হিসেবে সমধিক চেনে। কিন্তু সেই তিনিও যে দর্শনের পাঠ ভুলে অত্যন্ত রোমান্টিকতা জিড়িয়ে রেখেছেন তার প্রমাণ ওরেঞ্জ গার্ল বা “কমলা সুন্দরী”।
উপন্যাসের কাহিনী এগোয় গিয়র্গী নামক এক পনর বছরের নরওয়েজীয় বালক আর এগোর বছর আগে মৃত তার বাবার বয়ানে। ব্যাপার কিছুটা গোলমেলে ঠেকে। যে এগার বছর আগে মারা গেছে তার কিভাবে পুত্রের সাথে কাহিনী বর্ণনা করা সম্ভব? পিতা মৃত্যুর পূর্বে পুত্রের জন্য একখানা চিঠি লিখে গিয়েছিলেন যা এগার বছর পর আবিষ্কৃত হয়।

.
ইয়ান ওলাফ আর কমলা সুন্দরীর প্রেম কাহিনী হিসেবে পড়া শুরু করলেও শীঘ্রই ভুল ভাঙ্গতে শুরু করে। একজন আপাতমস্তক রোমান্টিক প্রেমিক ইয়ান ওলাফ চিকিৎসা বিদ্যার ছাত্র আর তার প্রেমিকা কমলা সুন্দরী চিত্রশিল্পী। হঠাৎ করেই কমলা সুন্দরীর সাথে গাড়িতে দেখা একব্যাগ ভর্তি কমলা নিয়ে। যার চাহনিতে সন্মোহন ছিল। সেই সন্মোহন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাটিয়ে উঠতে পারেনি যুবক ওলাফ। তাকে দ্বিতীয়বার দেখার জন্য এমন কোন পাগলামী সে বাকী রাখেনি। সারা শহরময় চষে বেড়ানো, প্রতিটি কমলার দোকানে উঁকি দেয়া, সিনেমা হলে হলে ঘুরে বেড়ানো। দিনের পর দিন রাস্তায় রাস্তায় কমলা সুন্দরীর খোঁজ করা। কমলা সুন্দরীর প্রথম বাক্য ছিল হাদারাম আর ওলাফের কাঠবিড়ালী। নাম ঠিকানা বিহীন পোস্টকার্ডে সেতিল শহরের সিল দেখে সুদূর স্পেন পর্যন্ত ছুটে যাওয়া ছিল চূড়ান্ত পাগলামী। এভাবেই কমলা সুন্দরী আর ওলাফ আবিষ্কার করে তারা আসলে ছোটবেলার খেলার সাথী। কাহিনীর মধুরেণ সমাপয়েৎ হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। দু’জন একসাথে থাকতে আরম্ভ করে।
গিয়র্গী তার সৎ বাবার সাথে থাকত যেখানে তার মায়ের ঘরে আরেকটি ছোট বোন ছিল। চার বছর বয়সে সে তার বাবাকে হারায়। তারপর সৎ বাবাই তাকে আসল বাবার মত লালন পালন করে। তার আপন বাবার স্মৃতি খুব বেশি মনে ছিল না কারন তার বয়স তাকে তা মনে রাখার মত যথেষ্ট ছিল না। বাবার চিঠি তাকে বারবার সব কথা স্মরণ করতে সাহায্য করছিল। একজন তাগড়া জোয়ান যে তার বাবা ছিল, কান্নায় বুক ভাসানো ছিল অভাবনীয়। অবশেষে অবাক বিস্ময়ে সে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয় কমলা সুন্দরী আর কেউ নয়; সে ছিল তার মা ভেরোনিকা। মা-ছেলের ঘরের অবরুদ্ধ কান্না পাঠকের মন ছুঁয়ে যাবে। মৃত্যুর পূর্বে চার বছরের ছেলেকে জীবন সম্পর্কে অনেক কিছুই বলে গেছে তার বাবা কিন্তু সে তখন তা বোঝেনি। আজ সে তা বুঝতে পারে।
ভেবেছি ‘কমলা সুন্দরী’ পড়া শেষ, কিন্তু না আমার ভুল ভাঙলো। আবেগ, রোমান্টিকতা, জীবন এর বাইরেও এক অমোঘ সত্যি হল মৃত্যু। প্রত্যেক জীব তার জীবনের সাধ ভোগ করতে চাইলে অবশ্যই তাকে মৃত্যুর সাধও নিতে হবে। মৃত্যু মানুষের গতি থামিয়ে দেয় কিন্তু তার আশা বেঁচে থাকে। মৃত্যুর পূর্বে আমাদের জগতকে জানতে হবে। সমান্তরালে কী আর কোন জীবন অতিবাহিত হচ্ছে? নাকি মৃত্যু মানে অনন্তলোকে হারিয়ে যাওয়া!
দ্বিজেন্দ্রনাথ বর্মনের অনুবাদ আর সন্দেশ প্রকাশনীর প্রচেষ্টা চমৎকার। একটানে পড়ে ফেলতে পারেন, মাত্র একশ চব্বিশ পৃষ্ঠা।
রুবু মুন্নাফ
দক্ষিণ বনশ্রী, ঢাকা।
পছন্দের পোস্ট করতে আপনাকে লগইন করতে হবে।