রাজনৈতিক থাবায় হত্যা রহস্য, আর কতদিন?

সাইফুল রুদ্র
Published : 13 July 2012, 12:30 PM
Updated : 13 July 2012, 12:30 PM

একটি ছোট্ট গল্প, সুখের নয় বেদনার। কথায় বলে যার যায় সে বুঝে। আমার যায়নি বলে আমি বুঝি না, কিন্তু যার গেছে তার কি অবস্থা? কথায় কথয় মানুষ মারা মানুষের স্বভাবে পরিণত হয়েছে, মাঝে মধ্যে তাই মনে হয়। আগে লোকমুখে আবার মাঝে মধ্যেই সেই এলাকার মানুষের মুখে শুনতাম। এলাকাটির নাম গফরগাঁও, ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত। ইচ্ছে হতো কোন এক সময় কাজের সুযোগ পেলে গিয়ে ঘুরে দেখে আসব। এবার তাই হলো..।

আলোচিত কিনা? হ্যা, তাইতো মনে হয় আমার। যে মানুষটির কথা বলব তিনি বেঁচে নেই। দুর্বৃত্তরা মেরে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছিল তাকে। পাঠকদের ধৈর্য্য হবে তো? ভূমিকা বড় না করে ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে..।

একই গোষ্ঠির দুই পরিবারের সম্পর্ক কখনোই খারাপ ছিল না, যখন জানতে চাইলাম তখন এই কথাটিই জানালেন দুই পরিবারের অর্থাৎ দুই বাড়ির সদস্যরা। এলাকাবাসীর মতে বাড়ির পাশে থাকা ছোট্ট বিলটিতে মাছ চাষকে কেন্দ্র করেই সর্ব প্রথম বিরোধের সৃষ্টি হয় দুই পরিবারের মধ্যে। আর তারই মাশুল গুনতে হয়েছে নিহত সেই লোকটির। যার নাম ডাক্তার রফিকুল ইসলাম ওরফে দুলাল। এলাকার লোকজন তাকে দুলাল ডাক্তার বলেই জানতো।

এক সময় ঐ বিলটিতে মাছ চাষকে কেন্দ্র করেই বইতে থাকে বৈরিতার বাতাস। প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত হয় প্রতিবেশি আবুল হোসেন দিপুর পরিবার, যাকে আমরা একটু আগেই এক পরিবারের লোক বলে জেনেছি। দুলাল ডাক্তারের পরিবার দাবি করছে, দিপুর ষড়যন্ত্রেই পৃথিবী ছেড়েছেন দুলাল ডাক্তার। কিন্তু এলাকাবাসীদের মধ্য থেকে অনেকেই জানালেন ভিন্ন কিছু কথা। কেচোঁ খুঁড়তে গিয়ে বেড়িয়ে আসে সাপ। কেবল এই একটি বিভেদকে কেন্দ্র করেই এলাকার লোকজন দুটি শিবিরে ভাগ হয়ে গেছে। বিলের এই মাছকে কেন্দ্র করে যখন মতদ্বৈধতার শুরু, তখনই সুযোগ সন্ধানী একদল লোক সেই ঘটনাকে রাবারের মত টেনে নিয়ে যায় বাড়ির পাশে থাকা ডুমুর গাছ পর্যন্ত, যেখানে দুলাল ডাক্তারের লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। এলাকবাসীদের মধ্যে এক পক্ষ জানালো, দুলাল ডাক্তার ও দিপুর বাবা বেঁচে থাকতেই এই বিলে মাছ চাষ করা হতো। আর তার জন্য ঐ বিলের দু'পাশে দিতে হয়েছিল ছোট্ট দুটি বাঁধ। শুধুমাত্র পানি ধরে রাখার জন্য।

দুই পরিবারের অভিভাবক গত হবার পর, স্থানীয় এমপি যাকে ইদানিং আমরা অনেকেই পিস্তল গিয়াস নামে চিনি, তারই কতিপয় সাঙ্গপাঙ্গ চাপা ছাঁইয়ে বাতাস দিয়ে নতুন করে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিশুদ্ধ বাতাসের বলয় ভেদ করে দুষিত অক্সিজেনকে সঙ্গি করে সেই আগুন জ্বলে ওঠে দাউ দাউ করে।

যার ফলশ্রুতিতে 2010 সালের 19 জুন দিবাগত রাতে দুলাল ডাক্তারকে প্রান দিতে হয়েছিল। অবাক লাগে এই মানুষটিই গফরগাঁওয়ের হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন। আর স্বাধীনতার এতগুলো বছর পর সে নিজেই পরাধীনতার শৃঙ্খলে থেকে বিদায় নিলেন। সুযোগ সন্ধানীরা কিন্তু ঠিকই ওৎ পেতে থাকা নেকঁড়ের মত শিকারের ঘাড় কামড়ে ধরল মটকে দেবার জন্য। তাই হলো। দিপুর এখনো দুটি পরিচয় দেয়া বাকি। দিলে পাঠকরা বুঝতে পারবেন, হত্যা রহস্য কী, কেন বা কিভাবে?

আবুল হোসেন দিপুরা ৮ ভাই। সে সবার ছোট। এক ভাই গ্রামে থাকেন, যাকে এই মামলার অন্যতম আসামী করা হয়েছে। আর বাকি ৭ ভাই থাকেন রাজধানীতে। মকবুল অর্থাৎ গ্রামে থাকা ঐ ভাইটি ছাড়া বাকি সবাই শিক্ষিত। দিপু ডক্টরেট করেছেন, অধ্যাপনা করছেন একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে। 2008 সালের নির্বাচনে তৃণমূলের সমর্থন নিয়ে নিজ এলাকাসহ আশপাশের এলাকায় অর্থাৎ গফরগাঁও আসনে আওয়ামী লীগের হয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন। আর বর্তমান এমপি পিস্তল গিয়াস ছিলেন তৃতীয় অবস্থানে। কিন্তু বিশেষ ব্যবস্থায় দিপুকে নির্বাচনের অনুমতি দেয়া হয়নি বা দেয়ানো হয়নি। তারপরও দিপু নির্বাচনের সময় চারদিক থেকে সহযোগিতা করেছিলেন বর্তমান এমপি গিয়াসকে। এই তথ্যগুলো আমাকে দেয়া হয় দিপুর নিজ এলাকা ও তার আশপাশের এলাকা থেকে। পাঠক দয়া করে একটু বেুঝে নিয়েন। সব দায়িত্ব আমার উপর চাপিয়ে দিয়েন না দয়া করে…।

সংকটের শুরু মূলত ঐ নির্বাচন থেকেই। সবার দেয়া তথ্যমতে, আগামী নির্বাচনে জনপ্রিয়তার ফলে এগিয়ে যাবার একটি পূর্ণ সুযোগ রয়ে গেছে দিপুর হাতে। অতএব বুঝতেই পারছেন?

সে যাকগে, প্রায় আশি বছর বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা দুলাল ডাক্তার মারা যাবার পর, মুহুর্তের মধ্যেই পুড়িয়ে দেয়া হয় দিপুদের গ্রামের ভিটেয় থাকা বাড়িটি। কে বা করা এমনটি করেছেন? সে প্রশ্নের কোন জবাব মেলেনি। সোজা কথায় বললে কেউই স্বসাহসে এগিয়ে আসেননি, আমাকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে। বাড়িতে আগুন জ্বলতে দেখেছেন, ধোঁয়া দেখেছেন আওয়াজও পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু আওয়াজ করেননি কেউ । যদি তার নিজের ঘরটিও হারাতে হয়!! যদি হারাতে হয় নিজের প্রান!!! অথচ কিছু লোক এগিয়ে এসে চুপি চুপি বলল, অনেকটা কানে কানে বলার মত..। দিপু খুন করছে, আমরা দেখছি। পরক্ষণেই যখন জানতে চাইলাম, বাড়িতে আগুন দিল কে? তখন সে বলল আমি জানিনা। অথচ ঐ মানুষটির বাড়ি দিপুর বাড়ির পাশেই। অদ্ভুত! আপনাদের কি মনে হয়?

ঢাকার উত্তরায় এসে যখন দিপুর বড় ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম, তখন তিনি জানালেন বাড়িত থাকমু ক্যামনে? বাড়িত যে থাকমু, বা আমরার ভাই তারা থাকব, হ্যারা কিছু রাখছে? বাড়ির এ্যাতলা মানু থাকব কই? পাঠক আপনারাই বলুন, বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিলে একটি মানুষ তার পরিবার পরিজন নিয়ে কোথায় গিয়ে ঠাই নিবে…?

দিপুর পরিবার অভিযোগ করেন, দুলাল ডাক্তার মারা যাবার পর দিপুর বাড়ির কেউ তার জানাজায় শরীক হননি। এটারও বিচারের ভার আপনাদের হাতেই ছেড়ে দিলাম। মমতাজ উদ্দিন অর্থাৎ দিপুর বড়ভাই কেঁদে ফেললেন কথাটি বলতে গিয়ে।

ইন্ধনদাতা হিসেবে পরিচিত এলাকার এমপি, যিনি খোলামেলা গোলাগুলি করতে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, সেই গিয়াস সাহেবের পরোক্ষ নেতৃত্বে দুলাল ডাক্তারের পরিবার বাদি হয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। যার মূল আসামী দিপু। যেই মামলার সর্বমোট আসামী 13 জন।

এবার আসি লাশের পোস্টমর্টেম রিপোর্টে, ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডাক্তার মন্জুরুল কাদির। তার দায়িত্বে চলে ময়না তদন্ত। রিপোর্টে ডাক্তার এটাকে বার্ধক্যজনিত স্বাভাবিক মৃত্যু বলে চিহ্নিত করেন। তারপর শুরু হয় আসল খেলা। বাদি পক্ষ সেই রিপোর্টের বিরোধিতা করে আদালতে আপিল করলে আদালত রিপোর্টটি পুনরায় তদন্তের জন্য বলেন। মজার বিষয় হলো, সেই একই ডাক্তার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে সাক্ষর পূর্বক স্বীকারোক্তি দেন যে তার দেয়া প্রথম রিপোর্টটিতে ভুল ছিল। এরই মাঝে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক কিশেষজ্ঞ ও বিভাগীয় প্রধান ডাক্তার মোকলেছুর রহমানকে আদালত থেকে নির্দেশ দেয়া হয় ঐ রিপোর্টটি পূণ:মূল্যায়নের। ৩ সদস্য বিশিষ্ট বোর্ডের সিদ্ধান্তে মন্জুরুল কাদিরের দেয়া রিপোর্টের অসঙ্গতি ধরা পড়ে। কারন এর পেছনে ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ও স্থানীয় এমপি গিয়াস উদ্দিনের ট্রান্সপারেন্ট হাত। কিন্তু পুরো বিষয়টিকে ট্রান্সুলেন্ট করে রাখা হয়েছে লোকসম্মুখে। শেষ পর্যন্ত মন্জুরুল কাদির বাধ্য হন দেশ ছাড়তে। আমি যখন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে যাই তার সংগে দেখা করে রিপোর্টটি নিয়ে কথা বলব বলে, তখন তিনি জার্মানীতে। কবে গিয়েছেন, কিংবা কেন গিয়েছেন তার কোন সদুত্তর মেলেনি ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ থেকে।

এদিকে কবর থেকে লাশ তুলে কিংবা লাশ না দেখে ময়না তদন্তের রিপোর্ট পুনরায় বিবেচনার কথা বলায়, আসামী পক্ষ আদালতে চ্যালেঞ্জ করে। সংগে সংগে মন্জুরুল কাদির উধাও। অন্যদিকে তিন সদস্য বিশিষ্ট মেডিক্যাল বোর্ডের সুপারিশে, ময়মনসিংহের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ডাক্তার মন্জুরুল কাদিরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এবার আপনারাই বলুন ডাক্তার দেশে থাকবেন কিভাবে? এটাও হয়ত তার জন্যে শাপে বর। দেশের জঞ্জাল না ঠেলে বিদেশের সুখ! এমনটা কয়জনার ভাগ্যে জোটে?

মৃত্যু রহস্যের কুল কিনারা করতে আমরা যখন ময়মনসিংহে পৌঁছাই, তখনই ছোট খাটো তোলপাড় শুরু হয় শহরে। একদিকে গফরগাঁওয়ের এমপি পিস্তল গিয়াস, অন্যদিকে শহরের এমপি। সেই অভিজ্ঞতার কথা আজ আর না বলি। সাংবাদিকতা? শুধু এই কথাটিই বার বার ভাবছিলাম, এটা আমার পেশা এটা আমার নেশা।

মৃত্যুর আগে দুলাল ডাক্তার একটি সাধারন ডায়েরি করেছিলেন গফরগাঁও থানায়, তবে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও তদন্ত কর্মকর্তা আমাকে নিশ্চিত করে বলতে পারেননি, ঐ সাধারন ডায়েরিটি আসলেই দুলাল ডাক্তারের করা ছিল কিনা?!? তবে কে করেছে সেই ডায়েরি। এমপি গিয়াস নিজেই ডিও লেটার দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ে, দুলাল ডাক্তারের মোবাইলের কল-লিস্টে গফরগাঁওয়ের কুখ্যাত সন্ত্রাসী মাসুদ ডাকাতের নম্বর পাওয়া গেছে। তবে কি সম্পর্ক মাসুদ ডাকাতের সংগে তার? অন্যদিকে ময়মনসিংহ জোনের সিআইডি বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কল লিস্টে থাকা ব্যক্তির সংগে ডাক্তার দুলালের কোন যোগসাজস ছিল না। এই মহান তথ্যটি ছাড়া সিআইডি কর্মকর্তার মুখ থেকে আর একখানা শব্দও আমরা বের করতে পারিনি। এখান থেকে পাঠক কী বুঝলেন???

দু'দিনের ময়মনসিংহ সফরের অভিজ্ঞতায় আরেকবার আমাদের দেশের মন্ত্রী এমপিদের চেহারাটা নতুন করে চিনতে হলো।

এই হত্যা মামলা তো কেবল দুই গড়িয়ে তিন বছরে পড়ল, আরো এমন অনেক অনেক হত্যা মামলার তদন্ত ফাইল বছরের পর বছর ধরে ঘুরছে সিআইডি-র টেবিলে টেবিলে। তারা অপেক্ষায় থাকেন রুই-কাতলাদের কিংবা বড় কর্তাদের ফোনের। ধুলোর আবরনে ধূসর থেকে আরো ধূসর হয় পড়ে থাকা ফাইল গুলো। এক সময় তা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কালের বিবর্তন আর তার স্রোতে ভাসতে ভাসেত হারিয়ে না গেলেও, খোলস বদলিয়ে ধারন করে নতুন রুপ। রাজনৈতিক থাবায় বদলে যায় হত্যা রহস্যের মূল কারন। তাদের অতিমাত্রায় দাপট আর প্রভাবের ফলে, হত্যা রহস্য নতুন করে হত্যা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর কতদিন? আর কতদিন চলবে এই ষোলগুটি?

দুলাল ডাক্তারের মৃত্যুরহস্য ! যদি সাধারন মানুষের কাতারে দাঁড়িয়ে বলতে চাই বা বলি…

এই মৃত্যুকে ঘিরে এলাকাটিতে যে দুটি দৃশ্যত শিবির তৈরি হয়েছে, তা আপাত দৃষ্টিতে খুব একটা সুবিধা জনক নয়। ভয় ভীতি উপেক্ষা করে নিশ্চুপ দাবি জানিয়েছেন অনেকেই, যেন এই এলাকায় আগের মত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে। যেন উন্মোচন হয় এই মৃত্যু রহস্য। যেন সত্যটা জানতে পারে তারা। আর কতদিন থাকবে বা চলবে এই রাজনৈতিক থাবা? এই প্রশ্নটিও ঐ সাধারণদের। আর কতদিন? সত্যিই আর কতদিন? তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি কি পারবে ?