বেশ কিছু দিন হলো কয়েকটা ছবি ঘুরে ফিরে ফেসবুকের নিউজফিডে চলে আসছে। ছবিগুলো আমি খুঁটিয়ে দেখি নি। চোখের সামনে পড়লেই সেকেন্ডের ব্যবধানে স্ক্রল করে নিচে চলে গিয়েছি। তবু স্ক্রল করার সময় দুই একবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিলো। কারন ছবিগুলো পোড়া মানুষের ছবি। পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া লাশের ছবি।
একেবারে ছোটোবেলায় যখন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ছিলাম তখন একবার বাসায় না জানিয়ে পিচ্চি-পাচ্চারা মিলে ঠিক করেছিলাম শশ্মানে যাবো। কিভাবে মরা পোড়ায় তা নিয়ে প্রত্যেকের মনেই একটা ভয় মেশানো কৌতুহল ছিলো। অনেক জল্পনা কল্পনার পর বিকেলে আমরা চারজন সাহসী শিশু যখন শশ্মানের কাছাকাছি গেলাম তখন দেখলাম সত্যিকারের মরা পোড়ানো হচ্ছে। ভয়ে ভয়ে আর একটু এগুতেই এক বিদঘুটে গন্ধ আর মরা পোড়ার পটপট শব্দ থামিয়ে দিলো আমাদের। কি এক অজানা আতঙ্কে আর একপা ও সামনে না এগিয়ে, কোনো প্রকার টু শব্দটি না করে প্রত্যেকেই উলটো দিকে প্রাণপণ দৌড় দিয়েছিলাম। সেদিন রাতে দুঃস্বপ্নে আমার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো।
সেটা ছিলো শৈশব। এখন আমি যৌবনে। পোড়া মানুষ দেখে এখন ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। পত্রিকায় পড়লাম আমার পাশের জেলায় চলন্ত বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। শিশুকে জাপটে ধরে জীবন্ত দগ্ধ হয়েছে এক মা। পুড়ে মরেছে আরো কয়েকজন। খবরটা পড়ে ব্যথিত হয়েছি। কিন্তু ভয় পাই নি। এসব তো হরহামেশাই হচ্ছে এইদেশে। আমি একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। ছাত্ররাজনীতি-আন্দোলন-সংঘর্ষ-সেশনজট এইসব এড়িয়ে আমাকে পাশ করে বের হতে হবে। চাকরি করতে হবে। মানুষ পোড়ার খবর পড়ে ভীত হওয়া আমার সাজে না! আমি আমার মতো জীবন যাপন করতে থাকলাম।
কিন্তু দুইদিন আগে আমার ফ্রেন্ডলিস্টের কেউ একজন সেই পুড়ে কয়লা হওয়া মানুষের ছবি ফেসবুকে আপলোড করলো। সেই ছবিতে এক মুহূর্ত আমার চোখ থেমে গেলো। কতোক্ষণ? হাফ সেকেণ্ড, বা তারো কম। সাথে সাথে স্ক্রল করা সত্ত্বেও আমি পোড়া মানুষের গন্ধ পেলাম। শৈশবের সেই ভয়ানক বিকেল…. লাশ পোড়ার কটু গন্ধ….. পটপট শব্দ ….. দুঃস্বপ্ন।
আমি ভীত। আমি এখনো ভীত। চোখ বন্ধ করলেই মানুষের মাংশ পোড়ার গন্ধ পাই। দেখি সন্তানকে জাপটে ধরে একজন মা পুড়ে যাচ্ছে। আগুনে পটপট শব্দ হচ্ছে। উৎকট গন্ধ। চোখ মেলি। দেখি এটা আর কোনো দুঃস্বপ্ন নয়। এটা বাস্তব। এটা জীবন্ত। 🙁