রূপকথার জনপ্রিয় চরিত্র ব্যাঙ ও আনুসাঙ্গিক কিছু কথা

রেজোওয়ানা
Published : 28 March 2012, 03:00 AM
Updated : 28 March 2012, 03:00 AM

ছোটবেলায় ব্যাঙ রাজপুত্রের গল্প শোনেনি মানুষ মনে হয় খুব কমই আছে। গল্পটা কেমন ছিল মনে আছে?

অনেক অনেক দিন আগে বিজয়নগর রাজ্যের রাজার ছিল খুব সুন্দর এক রাজকন্যা, নাম তার কংকাবতী। রাজবাড়ির পাশের ছোট্ট সবুজ একটা বন, সুন্দর ছোট্ট টলেটলে পানির একটা ঝর্ণাও ছিল সেখানে, ঐ বানটা কংকাবতীর খুব প্রিয় ছিল! সে মাঝে মাঝেই ওখানে বেড়াতে যেতো। একদিন ফুরফরে বাতাস বওয়া সুন্দর বিকালে রাজকুমারী বেড়াতে বেড়াতে একা একা সেই বনে চলে গেলো। তার হাতে ছিল সুন্দর একটা সোনালী বল, এই বলটা তার খুব প্রিয়। হাটতে হাটতে বল নিয়ে লোফালোফি করতে করতে সে ঝর্ণাটার কাছে এসে একটা পাথরের উপর বসলো। এমন সময় হঠাৎ তার হাত ফসকে বলটা ঝর্ণার পানিতে পড়ে গেলো, এত গভীরে চলে গেলো যে আর দেখায়ই যায় না।

রাজকন্যার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো বলের জন্য। সে মুখ ফসকে জোরে বলে উঠলো " ইস, কোন ভাবে বলটা যদি আবার ফিরে পেতাম!!" যেই না এই কথা বলেছে, ওম্নি একটা মোটাসোটা কোলা ব্যাঙ, জলের উপর মাথা তুলে বলে উঠলো "কি গো রাজকন্যা বলের জন্য মন খারাপ? আমি যদি তোমাকে বলটা তুলে এনে দেই, তাহলে কি তুমি আমাকে ভালবাসবে, তোমার সাথে তোমার রাজপ্রাসাদে থাকতে দেবে?"

মোটকা ব্যাঙটার এই কথা শুনে কংকাবতীর রাগ উঠে গেলো, "কি তোমার এত বড় সাহস! তুমি ভাবলে কিভাবে যে তোমার মতন এমন পচাঁ, বিশ্রী একটা ব্যাঙকে আমি আমার সাথে করে আমার ঘরে নিয়ে যাবো! তারপরও যখন এত করে বলছো যাও আগে আমার বলটা নিয়ে আসো তারপর দেখবো তোমার জন্য কি করা যায়।" কোলা ব্যাঙ খুশি হয়ে সাথে সাথেই এক ডুবে ঝর্নার নিচ থেকে বলটা তুলে এনে ডাঙায় ছুড়ে ফেললো! কংকাবতী তখন করলো কি বলটা তুলে নিয়ে এক দৌড়ে বাড়ি চলে গেলো, পাছে ব্যাঙটা আবার তার পিছু নেয়।

পরের দিন সকালবেলা রাজকন্যা, তার বাবার সাথে বসে বসে নাস্তা খাচ্ছিল, এমন সময়ে বাইরের সিড়িতে একটা অদ্ভুত থ্যাপ থ্যাপ শব্দ আসতে লাগলো, যেনো কেউ লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজায় মৃদু নক শোনা গেলো, সর্দি বসা গলায় কেউ একজন সুর করে বলছে………

প্রিয়তম রাজকন্যা, দরজা খোল
দরজা খোল, তোমার ভালবাসার জন্য!
ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ
মনে আছে কি কথা দিয়েছিলে আমায়
সেই সবুজ শীতল বনে ঝার্ণার কাছে, গাছের ছায়ায়?
ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ

সেই গান শুনে রাজকন্যা মনটা ভয়ে কেপে উঠলো, সে ত্রস্ত পায়ে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখে সেই কুৎসিত ব্যাঙটা দাড়িয়ে। সে তখন দড়াম করে তার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিয়ে আবার ডাইনিং টেবিলে ফিরে গেলো। কংকাবতীর ভয়ার্ত মুখ দেখে রাজা জানতে চাইলেন কি হয়েছে, কে এসছে? তখন কংকাবতী আগের দিনের কথা সব খুলে বললো। সব শুনে রাজা বললেন, তুমি তো তাকে প্রতিশ্রতি দিয়েছিলে, সেটা রাখা তোমার কর্তব্য!

অগত্যা দরাজ খুলে কংকাবতী ব্যাঙটাকে ভেতরে নিয়ে আসলো। ঘরে ঢুকে সেই কোলাব্যাঙ থ্যাপর থ্যাপর করে লাফিয়ে লাফিয়ে রাজকণ্যার চেয়ারের পাশে দাড়িয়ে বললো, তোমার পাশে আমাকেও একটা চেয়ারে বসাও। তাই করা হলো। তখন সে আবার হুকুম করলো তোমার প্লেটটা আমার কাছে নিয়ে আসো প্রিয়তমে, আমি ওখানে থেকে একসাথে খাব। তাও করা হলো, তখন ব্যাঙ মহাশয় পেট পুরে খেয়ে দেয়ে বললো, খেতে খেতে আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পরেছি। এখন আমি ঘুমাবো, আমাকে তোমার ঘরে নিয়ে যাও। কংকাবতী আর কি করবে, সে রাগে গজ গজ করতে করতে ব্যাঙটাকে নিয়ে গেলো তার ঘরে।
ঘরে ঢুকে ব্যাঙ ইয়া বড় এক ফাল দিয়ে সোজা কংকাবতীর ছোট্ট বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো! ব্যাঙটার কান্ড দেখে কংকাবতীর গা জ্বলে গেলো, সে চেয়ারে বসে রাত কাটিয়ে দিল। পরদিন সকালে উঠে ব্যাঙটা আর নেই দেখে সে ভাবলো যাক আপদ বিদায় হলো। এই ভেবে কংকাবতীর মনটা খুশি হয়ে উঠলো, কিন্তু সন্ধ্যার পরে তার সেই খুশি আর থাকলো না! আবার সে হাজির হলো সন্ধ্যায় এবং আবারও সেই এক ঘটনা। এভাবে পরপর তিনদিন গেলো। তৃতীয় দিনের সকালে ঘুম থেকে উঠে রাজকন্যা দেখলো তার বিছানার ঘুমিয়ে আছে পরম সুন্দর এক যুবক। সেই সুন্দর পুরুষ ঘুম ভেঙে উঠে হতবাক হয়ে যাওয়া রাজকণ্যাকে বললো, ভয় পেয়ো না আমিই সেই কুৎসিত ব্যাঙ। আমি আসলে হীরকগড়ের রাজপুত্র কমলকুমার, এক ডাইনী বুড়িরর অভিশাপে ব্যাঙ হয়ে ঝর্ণায় ছিলাম, পরপর তিন দিন রাজকন্যার বিছানায় ঘুমিয়ে সেই অভিশাপ কেটে গেছে। এখন আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।

এরপর সাত দিন সাত রাত ধরে অনেক ধুমধাম করে তাদের বিয়ে হয়ে গলো। বিয়ের পর রাজপুত্র কমলকুমার ১৪ ঘোড়ায় টানা সোনার গাড়িতে করে রাজকন্যা কংকাবতীকে তার হীরকগড়ের রাজপ্রসাদে নিয়ে গেলো। এরপর তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো!

উৎপত্তি গত ভাবে পশ্চিমা এই গল্পের বিভিন্ন রূপ ভিন্ন ভিন্ন দেশে প্রচলিত আছে। ব্যাঙ নিয়ে এত ছড়া, গল্প এমনকি গানও রচিত হয়েছে প্রাণীকুলের মধ্যে আর কারও কিন্তু এতটা জনপ্রিয়তা দেখা যায় না, যতটা আছে ব্যাঙের! মাঝে মাঝে আমার খুব অবাক লাগে, ব্যাঙের মতন এমন বিশেষত্বহীন মোটামুটি কুদর্শন একটা প্রাণী কিভাবে সাহিত্য, মিথ, লোককথায় এমন অবস্থান করে নিল! শুধু বাংলা ভাষাতেই যদি আমরা ব্যকরণের দিকে তাকাই তাহলে ব্যাঙের সর্দি, ব্যাঙের ছাতা, ভেক এমন কত কত শব্দ! এমন অবস্থা কিন্তু পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই দেখা যায়।
ব্যাঙের ছাতা, মাশরুম গুলোর নাম কেন ব্যাঙের ছাতা হয়ে গেলো। এই ছাতার নীচে কখনো কি কোন ব্যাঙকে বসে থাকতে দেখা গেছে বর্ষায়?

যাই হোক, শুধু বর্তমান কালের এসব গল্প নয়, প্রাচীন অনেক সংস্কৃতির মিথে আর লোককথায়ও ব্যাঙের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দেখা যায়। এর কারণটা কি মানব সভ্যতার আদিম কোন টোটেম? যেমন প্রাচীন মিশরের কথা বলা যায়, মিশরীয় সভ্যতায় উর্বরতা আর জন্মের দেবী হেকেট। এই দেবীকে মাঝে মাঝে ব্যাঙের মাথা আর দেহ মানুব দেহের কম্পোজিট ফিগার হিসাবে দেখানো হয়ছে। পশ্চিমা মিথলজিতে প্রাক খ্রীস্টিয় বিশ্বাস অনুযায়ী ব্যাঙ হলো আত্মিক জাগরণের প্রতীক। গ্রেকো রোমান সভ্যতাতে ব্যাঙ আফ্রেদীতী আর ভেনাসের প্রতীক এবং উল্লেখ্য যে এরাও কিন্তু প্রেম ও উর্বরতার প্রতীক!

হিন্দু পৌরানিক কাহিনীতেও ব্যাঙের উল্লেখযোগ্য অবস্থান রয়েছে, ঋগবেদ বলা হয়েছে, বিশাল এক ব্যাঙ তার মাথায় বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডটা ধরে রেখেছে :|! আবার বৈদিক গ্রন্থ অনুসারে ব্যাঙের ডাকাডাকির কারণেই বৃষ্টিপাত হয়। এই সংস্কারটা অবশ্য বর্তমান সমাজেও প্রচলিত, এমনকি ইউরোপীয় লোকাচারেও রয়েছে।

এখন কথা হলো, ব্যাঙকে কেন উর্বরতা আর জন্মের প্রতীক হিসাবে নির্ধারণ করা হলো? এর কারণটা কি ব্যাঙের অধিক সংখ্যায় ডিম দেয়া (প্রায় ৩০০০) আর বাচ্চা ফুটানো? বর্ষাকালে জলাশয়ে হাজার হাজার ব্যাঙাচির জন্ম নেয়া দেখেই কি তাকে উর্বরতা ও জন্মের রক্ষাকারী দেবতা হিসাবে চিন্হিত করেছিল প্রাচীন মানুষেরা?

এছাড়া ব্যাঙকে বৃষ্টি আর পানির উৎস মনে করে অনেক সভ্যতা আর ধর্মে একে উপাসনা করা হতো। যখন এই প্রাকৃতিক পানিই ছিল সেচ ব্যবস্থার একমাত্র মাধ্যম, সেই সময়ে আদিম মানুষ খেয়াল করলো বৃষ্টির সাথে ব্যাঙের ডাকাডাকি আর গোষ্ঠি বৃদ্ধির একটা সম্পর্ক রয়েছে, সেই জন্যই কি তারা তখন ব্যাঙকে উর্বরতা, জন্ম আর জলের টোটেম হিসাবে নির্দিষ্ট করেছিল? আর সেই আদিম কৃষি ভিত্তিক সমাজে এটাই ছিল স্বাভাবিক।

তবে যে ভাবেই করা হোক না কেন, পূর্বপুরুষদের সেই রিতী কিন্তু এখনও পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজ বহন করে চলেছে! যেমন পেরু আর বলিভিয়ার আয়মারা নামক ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠিরা ছোট ছোট ব্যাঙের মূর্তি বানিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় রেখে এসে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে। আমাদের বাংলাতেও প্রবল খড়ায় ব্যাঙের বিয়ে দিয়ে বৃষ্টিকে আহবান করা হয়!

তবে ব্যাঙ যে মানব সভ্যতায় সব সময়েই সমাদৃত হয়েছে, তাও কিন্তু না। মিলটনের প্যারাডাইজ লস্টে বর্নিত আছে ইভের মনে হিংসা আর সন্দেহের বীজ বপনকারী সেই দুরাত্মা ছিল একটা সোনা ব্যাঙ!! এ ছাড়া মধ্যযুগীয় ইউরোপে ব্যাঙকে শয়তানের প্রতীক হিসাবে ভাবা হতো, কারণ হলো ক্যাথলিক চার্চ গুলো থেকে বল হয়েছিল ব্যাঙ হলো ডাইনী চর্চার অন্যতম উপাদান। ছোটবেলায় আমরা শুনেছিলাম ব্যাঙাচি ধরলে হাত ঘা হয়, এই ধরনের অনেক সংস্কার বিভিন্ন দেশে প্রচলিত আছে! এভাবে দেখা যাচ্ছে কোন না কোন ভাবে এই এম্পিবিয়া গোত্রের প্রাণীটি মানব সংস্কৃতিতে কোন না কোন ভাবে জড়িয়ে গেছে।
পৃথিবীর বেশির ভাগ মানব সংস্কৃতির উপকথা, গল্প কাহিনীতে জড়িয়ে আছে সে। কল্পনাপ্রিয় মানুষেরা ব্যাঙকে অতি আপন ভেবেই বিভিন্ন চরিত্র রুপায়ন করেছে তাকে নিয়ে রূপকথা, সেটা সুবেশি রাজকুমার থেকে শুরু করে পাজি শয়তান পর্যন্ত। কিন্তু বর্তমানে যে ভাবে পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে, জলাশয় গুলো ভরে গিয়ে নগর সভ্যতার অগ্রাসন চলছে তাতে করে সন্দেহ হয় যে আর কতদিন আমরা সেই ডোবাপুকুর থেকে রূপকথার অন্যতম জনপ্রিয় চরিত্র ব্যাঙের নস্টালজিক ডাক শুনতে পাবো!