শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য নয়, শিক্ষার উপর ভ্যাট নয়

সাব্বির আহমেদ
Published : 26 Sept 2015, 06:15 AM
Updated : 26 Sept 2015, 06:15 AM

চলতি বছরের বাজেটে প্রথমবারের মত দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের টিউশন ফি'র উপর ৭.৫% ভ্যাট আরোপ করা হয়। জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রীর বাজেট ঘোষণার পর থেকে টিউশন ফি'র উপর ভ্যাটের বিরোধিতা চলে আসছিল সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে। সে বিরোধিতায় জুলাই মাসের পর কিছুটা ভাটা পরেছিল। গত ৯ সেপ্টেম্বর ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শিক্ষার উপর ভ্যাট আরোপের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসলে আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। ১০ সেপ্টেম্বর এ আন্দোলন ব্যাপকতা পায়। এদিন ঢাকা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রায় সকল বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের, মেডিকেল কলেজের এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রছাত্রীরা অবস্থান নিয়ে রাজপথ অবরোধ করে। অবরোধে ঢাকা শহর স্থবির হয়ে যায়। পথের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ আটকা পড়ে অবর্ণনীয় ভোগান্তির শিকার হয়। ভ্যাট বিরোধী প্রতিবাদ ঢাকায় সীমাবদ্ধ থাকেনি তা সিলেট এবং চট্টগ্রামেও ছড়িয়ে পরে।

ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) একটি পরোক্ষ কর। এই কর আরোপ করা হলে তা আদতে ভোক্তার উপর বর্তায়। তাই তা আরোপের ক্ষেত্রে কতগুলো সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিষয় বিবেচনা করা হয়। জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো যাতে মূসকের কারণে ব্যহত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা হয়। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি এবং সেবা মূসকের আওতা মুক্ত রাখা হয়। এ কারণে চাল, ডাল, সবজি, মাছ, মাংস, ঔষধ, ডাক্তারের ফি, সাধারণ মানের বস্ত্র এবং পোষাক, সাধারণ মানের গৃহ নির্মান সামগ্রী, ইত্যাদি। শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। শিক্ষার উপর মূসক আরোপ কর আইনের মূলনীতি বিরোধী। শিক্ষার উপর মূসক আরোপ করা হলে শিক্ষা ব্যায়বহুল হয়ে পড়ে। শিক্ষার বিস্তার বাঁধাগ্রস্থ হয়।

শিক্ষা কোন পণ্য নয়, শিক্ষার উপর ভ্যাট নয় – এ স্লোগানের যথার্থতা কতটুকু? শিক্ষা এবং চিকিৎসা কি আসলেই এই বাংলাদেশে পণ্য হয়ে যায়নি? শিক্ষা এবং চিকিৎসা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। উচ্চ শিক্ষা কি মৌলিক অধিকার? এই বিতর্কে না গিয়ে বর্তমান বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতার অনেকটা স্বীকার করে উচ্চ শিক্ষাকে যদি মৌলিক অধিকার হিসেবে মেনেও নেই তবুও কি এনএসইউ বা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিলাসবহুল উচ্চ শিক্ষা কিংবা অ্যাপোলো হাসপাতালের চিকিৎসাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে মানতে পারি? নিশ্চিত ভাবে উত্তর হচ্ছে 'না'। শিক্ষা এবং চিকিৎসা যে সকল স্থানে পণ্যে রূপ নিয়েছে সেখানে ভ্যাট প্রয়োগ করা হোক। কোন শিক্ষাকে বা চিকিৎসাকে মৌলিক অধিকার বলা হবে আর কোনটাকে বলা হবে না তা নির্ধারণ করা বেশ কঠিন কাজ হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন এই কাজটি করতে পারে। একটি পেশাদারী প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করে একজন ছাত্রকে শিক্ষা দেয়ার জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বছরে কত খরচ হয় তা প্রাক্কলন করে সেই প্রাক্কলিত পরিমাণ টাকার উপর যদি কোন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের কাছ থেকে গ্রহণ করে তবে তার উপর ১৫% হারে মূসক ধার্য করা যেতে পারে। বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একেক জন ছাত্রের কাছ থেকে চার বছরের স্নাতক কোর্সের জন্য সর্বনিম্ন চার/পাঁচ লক্ষ টাকা নিচ্ছে; উপরের দিকে আছে বিশ/পঁচিশ লক্ষ পর্যন্ত। এর উপর আছে হরেক রকমের চাঁদা। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিলাসবহুল অবকাঠামো নির্মান করে শিক্ষা গ্রহণকে স্ট্যাটাস সিম্বল করে তুলেছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পাওয়া ছাত্ররা সরকারী কলেজে শিক্ষা গ্রহণের থেকে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণকে মর্যাদাপূর্ণ মনে করে। অনেক বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে এমন কথা শোনা যায় যে সেখানে ভর্তি হলে ক্লাস না করে, পরীক্ষা না দিয়ে সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। অনেক প্রতিষ্ঠান বছরের পড় বছর ধরে ছাত্রদের কাছ থেকে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য চাঁদা নিয়েছেন কিন্তু প্রস্তাবিত অবকাঠামো নির্মান করেননি। অনেক প্রতিষ্ঠান বহুভাবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের তাগাদা পাওয়ার পরেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমতি পত্রে নির্ধারিত অবকাঠামো নির্মান করেননি। এক্ষেত্রে মঞ্জুরী কমিশনের ব্যার্থতা বিপুল। বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যে বাস্তবিক অর্থেই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এর একটা উদাহরণ হচ্ছেঃ ১১ সেপ্টেম্বর এ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিজ অব বাংলাদেশ সরকারের কাছে মূসক প্রত্যাহারের দাবী জানালে সে খবর কয়েকটি প্রথম সারির টেলিভিশন এবং দৈনিক পত্রিকা এ দাবীকে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের 'মালিকদের' দাবী বলে প্রচার করেছে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর 'মালিক' বলে কিছু থাকার কথা নয়। এগুলো ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে পরিচালিত হয়। ট্রাস্টিদের 'মালিক' বলা যায় না। তবে কেন গণমাধ্যম এদের মালিক বলে সম্বোধন করল? বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আইন সমূহে যাই লেখা থাকুক না কেন এই প্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চলছে। এদের আচার-আচরণও সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক। সমাজের অবচেতনে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে একটা বাণিজ্যিক ধারণা রয়েছে তারই প্রতিফলন হয়েছে গণমাধ্যমে।

বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বাণিজ্যিক স্বভাব বদলাতে হবে, অথবা এদের পুরোপুরি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করতে হবে। বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরী করতে হলে প্রচুর পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। এত বিপুল অর্থ নিঃস্বার্থ ভাবে দান করার মত মানুষ খুব বেশি নেই। যারা এসব প্রতিষ্ঠানে তৈরী করছেন তাদের প্রায় সকলের মধ্যে লাভ-ক্ষতি বিবেচনা বোধ রয়েছে। এ খাতে বিনিয়োগের নীট মুনাফার পরিমাণও যথেষ্ট; গড়ে ২৫% – ৩০%। এইসব প্রতিষ্ঠান যেহেতু আইনের দৃষ্টিতে অলাভজনক তাই বিনিয়োগকারীরা ব্যায়াতিরিক্ত আয়কে (মুনাফা) ডিভিডেন্ড আকারে গ্রহণ করার সুযোগ পাননা। বিভিন্ন কৌশলে মুনাফার অর্থ ট্রাস্টিরা নিজেদের পকেটে নিয়ে নেন। মুনাফার উপর তাদের আয়কর দিতে হয় মাত্র ১৫% হারে। অন্যদিকে একটা ননলিষ্টেড ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে কর দিতে হয় ৩৫%। অতিরিক্ত মুনাফা করে এমন ব্যাবসায়ীক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেমনঃ সিগারেট কোম্পানি, মোবাইল ফোন অপারেটরকে কর দিতে হয় ৪৫% হারে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চলা বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর আরোপিত ১৫% আয়কর যথার্থ নয়। এদের উপর প্রদেয় আয়করের হার ননলিষ্টেড কোম্পানির মত ৩৫% হওয়া উচিৎ। নীট মুনাফার হার ২০ শতাংশের বেশি হলে এবং তা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো বর্ধনে ব্যয় করা না হলে ৪৫% হারে কর ধার্য করা উচিৎ। পর্যাপ্ত হারে আয়কর আরোপের করে বর্তমানের ৭.৫% মূসক প্রত্যাহার করা যেতে পারে। তবে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বেশি টিউশন ফি এবং চাঁদা আদায় করা হলে তার উপর মূসক আরোপ করা উচিৎ।

যে সকল প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির উদ্দেশ্যই হচ্ছে মুনাফা অর্জন তাকে ট্রাস্টি বোর্ডের আদল দিয়ে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান বলার দরকার কি? এরকম অনেক প্রশ্ন আছে সাধারণের কাছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকে এ সকল প্রশ্নের জবাব জানতে হবে। কমিশন প্রায় শ'দুয়েক বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ ভালভাবে করতে পারছে এমনটা কেউ মনে করে না। কমিশনকে শক্তিশালী এবং কার্যকর করে তোলা দরকার। একাজ করার জন্য দরকার হচ্ছে একটি ব্যাপক স্ট্যাডি। বেসরকারী তহবিলে চলা সবকয়টি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আইনি কাঠামো, জবাবদিহিতা, গভর্ন্যান্স, ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ পদ্ধতি, বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রকাশিতব্য তথ্যাদি প্রকাশের নীতিমালা, ইত্যাদি স্ট্যাডি করে দীর্ঘ মেয়াদী সমাধানের পথ বাতলে নেয়া দরকার। পাবলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অপর্যাপ্ততার কারণে কয়েক লক্ষ ছেলে-মেয়ে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে। তাদের শিক্ষা চাহিদাকে জিম্মি করে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোর চলমান বাণিজ্য চলতে দেয়া যায় না। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সত্যিকার অর্থে অবাণিজ্যিক এবং অলাভজনক করে তুলতে পারলে শিক্ষার উপর মূসক এবং আয়কর কোনটাই বসানোর প্রয়োজন হবে না।