জঙ্গিবাদ অস্বীকার করে নয়, নিয়ন্ত্রণ করে ক্রিকেট খেলতে হবে

সাব্বির আহমেদ
Published : 28 Sept 2015, 03:42 AM
Updated : 28 Sept 2015, 03:42 AM

দুই টেস্টের সিরিজ খেলতে সোমবার বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার আগে নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ দেখিয়ে শনিবার ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার এক বিবৃতিতে সফর পেছানোর কথা জানানো হয়। অস্ট্রেলিয়ার ডিপার্টমেন্ট অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ট্রেড (ডিএফএটি) সেদেশের নাগরিকদের বাংলাদেশে ভ্রমণের বিষয়ে সতর্কতা জারি করায় ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর পেছানো হয়েছে।ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার বিবৃতিতে আরও বলা হয়, "নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বাংলাদেশে জঙ্গিরা অস্ট্রেলিয়ানদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করছে।"

বাংলাদেশে ক্রিকেটারদের নিরাপত্তা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার আশঙ্কাকে 'ভিত্তিহীন' বলে দাবি করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, "ইতোমধ্যে ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অনেক দেশ এসে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে গেছে। কোনো ধরনের সমস্যা হয়নি।" এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, 'আমি গোয়েন্দা সংস্থাসহ অন্যদের সঙ্গে আলাপ করেছি। এ ধরনের কোনো আশঙ্কা নেই। আমি অস্ট্রেলিয়া দলকে জানাতে চাই, আমরা পূর্ণ নিরাপত্তা ঘোষণা করছি। এখানে কোনো ধরনের সমস্যা হবে না।' বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ নেই দাবি করে তিনি বলেন, "আমরা এটি নিয়ন্ত্রণে রেখেছি। এদেশের জনগণ অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় ও সচেতন। তারা জঙ্গিবাদকে কখনোই গ্রহণ করে না। এখানে টেরোরিজম ও জঙ্গিবাদ নেই।" এসব খবর দিয়েছে দৈনিক সমকালসহ বিভিন্ন মিডিয়া।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শুধু গোয়েন্দাদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি দেশের বৈদেশিক সম্পর্কবিভাগের সতর্কবাণীকে ভিত্তিহীণ বলে এক কথায় উড়িয়ে দেন কিভাবে? আমাদের গোয়েন্দারা কি সবজান্তা? পৃথিবীর কোন গোয়েন্দা সংস্থা একশত ভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারে? মার্কিন এবং বৃটিশ গোয়েন্দাদের দেয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে ইরাকে হামলা চালিয়েছিল পশ্চিমা দেশগুলো। যুদ্ধে লাখ দুয়েক মানুষের অকাল মৃত্যুর পর জানা গেল ইরাকে ব্যাপক ক্ষতিকর রাসায়নিক অস্ত্র নেই। ৯/১১ হামলার খবর দিতে পারেনি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা। পরিণতিতে প্রাণ দিল তিন হাজার মানুষ, ধ্বংস হল বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র আর সবচেয়ে সুরক্ষিত বলে আমেরিকানদের গর্ব সামরিক কেন্দ্র পেন্টাগন। গোয়েন্দারা আগাম খবর দিতে পারেনি লন্ডনের মেট্রো বোমা হামলার, স্পেনের রেল স্টেশন উড়িয়ে কয়েকশ মানুষের প্রাণহানির, প্যারিসের পত্রিকা অফিসে বোমা হামলার। গোয়েন্দারা রক্ষা করতে পারেনি বাঙালির মুক্তিদাতা ও সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানকে। গোয়েন্দা ব্যর্থতার এরকম ভুরি ভুরি উদাহরণ দেয়া যাবে।

গোয়েন্দাদের কথার উপর নির্ভর না করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অস্ট্রেলিয়ানদের কাছে সতর্কবাণীর কারণ জানতে চাইতে পারতেন; তাদের কাছে কী কী তথ্য আছে তা জানতে চাইতে পারতেন; পারতেন তাদের সঙ্গে নিয়ে যৌথ উদ্যোগে সে সব তথ্য অনুযায়ী গভীর তদন্ত করে, তথ্যের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সে সব না করে তাৎক্ষনিক যে বক্তব্য দিলেন তাতে অস্ট্রেলিয়ানদের সংশয় কাঁটবে না; নিরাপত্তাহীণতা দূর হবে না। অস্ট্রেলিয়ানদের সঙ্গে সহসা ক্রিকেট খেলা হবে না।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের দ্বিতীয় অংশে রয়েছে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী এবং ধর্মীয় জঙ্গিবাদীদের অবস্থানকে সম্পূর্ণ অস্বীকার। কিছুকাল আগে আল-কায়েদা নেতার বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার ও ভারতের কিছু অংশ নিয়ে খেলাফত তৈরীর ঘোষণা যা বাংলাদেশ, ভারত এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল – তা কি বাস্তবতা বিবর্জিত ছিল? যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র জামায়াত-বিএনপি'র দেশব্যাপী নাশকতা, শত শত মানুষ হত্যা; ৫ জানুয়ারী নির্বাচন বানচালের নামে ২০১৩ সালের নাশকতা; হেফাজতের ১৩ দফা, সমাবেশের নামে ভ্যাণ্ডালিজম; সরকার পতনের নামে ২০১৫ সালের অগ্নি সন্ত্রাস; ২০০৫ সালের দেশব্যাপী বোমা হামলা; তারও আগের রমনা বটমূলের বোমা হামলা – এসব কি জঙ্গিবাদ নয়? পাহাড়ে, জঙ্গলে অস্ত্রসহ যেসব ঘাঁটি আবিষ্কার হয়েছে তা কি জঙ্গিদের নয়? সমগ্র পৃথিবী জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী লেখক হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকারকারী আনসারুল্লা বাংলা টিম, অসংখ্য জিহাদি বই-পত্র এবং ধংসাত্বক অস্ত্রশস্ত্রসহ পুলিশের হাতে ধরা পরা হিজবুত তাহরীর, হরকাতুল জিহাদ (হুজি) – এরা কি জঙ্গি সংগঠন নয়? বিএনপি নেতা ও সাবেক হুইপ সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের কন্যা ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা কাদের অর্থ সরবরাহ করছিল? সেনা বাহিনীর সাবেক সদস্য মেজর জিয়া আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের সঙ্গে দেশীয় জঙ্গিদের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করছেন – এমন তথ্য গোয়েন্দারা জানিয়েছেন কোরবানি ঈদের ঠিক আগের রাতে।

অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ নয় যে পাকিস্তানের মত বিপদজনক দেশে তাদের ক্রিকেটারদের পাঠাবে। মানুষের জীবন নিয়ে বিন্দুমাত্র ঝুঁকি তারা নেবে না – এটাই স্বাভাবিক। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে যে পরিমাণ জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড ঘটেছে তাঁর প্রেক্ষিতে যদি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট সংগঠকেরা তাদের দল পাঠানোর আগে দুইবার ভাবেন তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশে জঙ্গি নেই এ কথা কেউ বিশ্বাস করে না। বরং এ কথা অনেক বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে যে গত কয়েক বছর ধরে বর্তমান সরকারের বিরামহীন ও ঐকান্তিক চেষ্টায় জঙ্গিবাদ এখন দূর্বল হয়ে গেছে, নিয়ন্ত্রণে আছে, তাদের অস্ত্বিত্ব বিলুপ্তির মুখে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশীদের এমন আশ্বাস দিতে পারেন। তিনি নিশ্চয়তা দিতে পারেন সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যাবস্থার। অস্ট্রেলিয়ানদের সঙ্গে যৌথ টিম গঠিন করে তাদের উত্থাপিত আশঙ্কাগুলো তদন্ত করে এ নিশ্চয়তা দেয়া হলে তা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। দীর্ঘ ৯ বছর পর বিশ্ব সেরা টিমের সঙ্গে টেস্ট ক্রিকেট খেলার সুযোগ পাবে রয়েল বেঙ্গল টাইগারেরা।