মান-মর্যাদা পরিমাপের মাপকাঠিটাই যদি বদলে দেয়া যায়

সাব্বির আহমেদ
Published : 13 Jan 2017, 09:53 AM
Updated : 13 Jan 2017, 09:53 AM

অর্থই অনর্থের মূল। কথাটা শোনেনি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া যাবে না। একথা শোনার পর, সেই ছেলেবেলা থেকে কথাটার মানে বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছি। একেক সময় কথাটার একেক রকম অর্থ করেছি। অন্যদের সঙ্গে আলোচনায় ততোধিক ভিন্ন ধারণার পরিচয় পেয়েছি। কথা যত ছোট হয়, তার গভীরতা, ব্যপকতা ততই বড় হয় বলে বিভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করা সম্ভব। বহু বিবর্তনের পর, অর্থ কেন এবং কিভাবে অনর্থের কারণ সে সম্পর্কে আমার একটা নিজস্ব ধারণা তৈরী হয়েছে। এ  ধারণা আবার নতুন কোন কারণে বদলে যেতে পারে। সে যাই হোক না কেন, আমার ধারণাটা এই লেখায় ধারণ করে রাখতে চাই।

একজন মানুষের জীবন-যাপনের জন্য কি দরকার  অথবা একজন মানুষ তার জীবনের কাছে কি চায়? এমন  প্রশ্নের সবচেয়ে ভাল জবাব দিয়েছেন মার্কিন সমাজ বিজ্ঞানী আব্রাহাম মাসলো। মানুষ কিসে প্রেরণা পায়- তা বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে মাসলো মানুষের প্রয়োজনের শ্রেণী বিন্যাস করেন। তিনি  মানুষের প্রয়োজনকে পাঁচ স্তরে সাজিয়েছেন। এর প্রথম স্তরে রয়েছে শরীরবৃত্তীয় প্রয়োজন (খাদ্য, পানীয়,  উষ্ণতা,  বিশ্রাম); দ্বিতীয় স্তরে নিরাপত্তা; তৃতীয় স্তরে ভালবাসা, সহমর্মীতা; চতুর্থ স্তরে শ্রদ্ধা, সম্মান; এবং পঞ্চম স্তরে রয়েছে সৃজনশীল কর্মের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা অর্জন। মাসলো বিশ্বাস করতেন, মানুষের নিজস্ব একতা প্রেরণা পদ্ধ্বতি রয়েছে যা পুরস্কার এবং অবচেতনের প্রত্যাশা থেকে বিযুক্ত। মাসলো বলেছেন, মানুষ কিছু অর্জন করার জন্য স্বপ্রণোদিত হয় এবং সেটা অর্জন হলে অন্য কিছু অর্জনের জন্য তা প্রণোদিত করে। আমাদের সবচেয়ে প্রাথমিক প্রয়োজন হচ্ছে শরীরবৃত্তীয়। তা পূরণ হলে আমাদের মধ্যে পরবর্তী পর্যায়ের প্রয়োজন অর্থাৎ নিরাপত্তা অর্জনের প্রেরণা সঞ্চারিত হয়। এভাবে একে একে প্রেরণা পরিপূর্ণতা প্রাপ্তির পথে চলতে থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্নতা প্রাপ্তি না ঘটে ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ তা অর্জনের জন্য কাজ করতে থাকে। পরিপূর্ণতা অর্জন একটা  অশেষ  প্রক্রিয়া।  এর অর্জন  শেষ হয় না। তাই দেখা যায় একজন সৃষ্টিশীল মানুষ একের পর এক সৃষ্টি করতে থাকেন।  কবিদের  মুখে প্রায়ই শোনা যায় যে তার সবচেয়ে ভাল কবিতাটা আজো লেখা হয়নি।

মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলো (খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান) যদি সমাজ বা রাষ্ট্র সরবরাহ করতে পারে। সমাজের মধ্যে যদি শারীরিক, আর্থিক এবং মানসিক  নিরাপত্তাহীনতা না থাকে তবে একে অন্যের সঙ্গে সম্পদ আহরণের জন্য অমানবিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে না। এই প্রতিযোগিতা না থাকলে মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রকৃতি প্রদত্ত আত্মিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে কোন বাঁধা থাকবে না। সমাজ যদি প্রতিটি মানুষের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে তবে চতুর্থ স্তরের প্রয়োজন শ্রদ্ধা, সম্মান তার ভিত্তিতে নির্ধারণ হতে পারে। যে বেশি শিক্ষিত এবং জ্ঞানী হবেন সমাজের অন্যান্যরা তাকে বেশি সম্মান করবেন। যিনি  অন্যের জন্য, সামষ্টিকভাবে  সমাজের জন্য কাজ করবেন তিনি তত বেশি শ্রদ্ধার অধিকারী হবেন। যিনি যত বেশি সৃষ্টিশীল কাজ করবেন তিনি একদিকে, তত বেশি সম্মানের  অধিকারী হবেন। অন্যদিকে, নিজের ভেতরে পরিপূর্ণতার স্বাদ অনুধাবন করতে পারবেন। সমাজের বা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে যদি সকল সম্পদ থাকে এবং তা পরিচালনার জন্য যদি সকল মানুষ একত্রে অভিন্ন উদ্দেশ্যে কাজ করে তবে একটা সুখী, সমৃদ্ধ সমাজ গঠন করা সম্ভব হবে।

মানুষ যখন কৃষিকাজ শিখল তখন থেকে মনুষ্য সভ্যতার শুরু হয়েছে বলে ধরা হয়। আর তখন থেকেই মানুষে মানুষে ভেদাভেদেরও শুরু হয়। কৃষিকাজ শেখার আগে মানুষের সম্পদ বলে কিছু ছিল না। তখন ছিল শিকারি সমাজ। শিকারি সমাজে মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ ছিল না। কারণ তখন সম্পদ বলে কিছু ছিল না। মানুষ যে পশু শিকার করে বা ফলমূল আহরণ করে নিয়ে আসত তা সকলে মিলে সমান ভাবে ভাগ করে  খেয়ে  ফেলত। গাইয়ের  জোড় খাটিয়ে কেউ হয়ত বেশি খাওয়ার চেষ্টা করত বা অনেক সময় খেয়েও ফেলত। কিন্তু তা সংরক্ষণ করা যেত না বলে সম্পদ হিসেবে কেউ নিজেকে বেশি সম্পদের অধিকারী বলে দাবী করার সুযোগ পেত না। একমাত্র  শীত প্রধান অঞ্চলে প্রাকৃতিক সুবিধার কারণে শিকার করা প্রাণীর মাংস অনেকদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যেত। আদিম সমাজে খুব সামান্য সংখ্যক মানুষ শীত প্রধান অঞ্চলে বসবাস করত বলে এই সংরক্ষণ সুবিধা ব্যাতিক্রম হিসেবে আলোচনার বাইরে রাখছি।

কৃষিকাজ শেখার পরে মানুষ উৎপাদিত খাদ্য শস্য দীর্ঘ সময়ের জন্য সংরক্ষণ করার সুযোগ পেল। যার মজুদে যত বেশি খাদ্য শস্য সে তত বেশি সম্পদের অধিকারী হিসেবে নিজেকে জাহির করা শুরু করল। কৃষিকাজের সঙ্গে মনুষ্য সমাজে আরেকটি প্রধান উপাদান যুক্ত হয় – সম্পদের মালিকানা। কৃষিকাজের জন্য জমিকে আবাদযোগ্য করে তোলা কঠিন ছিল। বনবাদার পরিষ্কার করে একজন যখন আবাদযোগ্য একটা জমি তৈরী করল তখন তার উত্তরাধিকার নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। মালিকের মৃত্যুর পরে ওই জমির মালিক কে হবে? এই প্রশ্নের উত্তর বের করা সহজ ছিল না। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মানুষ একগামী সমাজ ব্যবস্থার প্রচলন করল যা পৃথিবীর প্রায় সকল সমাজ গ্রহণ করেছে। কৃষি শুধু খাদ্য শস্যের সংরক্ষণের মাধ্যমেই নয় উত্তরাধিকার নিশ্চিত করে প্রজন্মান্তরে সম্পদের প্রবাহ বজায় রাখার পথ বের করে দিল। ফলাফল হল এই যে শক্তিমানেরাই শুধু যে  বেশি সম্পদ অর্জন করতে পারবে তাই নয়, তাদের পরবর্তী প্রজন্মের লোকেরা শক্তিশালী না হলেও সম্পদের অধিকারী হবে। প্রজন্মান্তরের সম্পদ প্রবাহের এই সভ্যতার বর্তমান পরিস্থিতি হচ্ছে: পৃথিবীর মোট সম্পদের অর্ধেকের উপর অধিকার রয়েছে মাত্র ১% মানুষের। বাকি ৯৯% মানুষের অধিকার রয়েছে বাকি অর্ধেক সম্পদের উপর। একদিকে, কিছু মানুষ অসম্ভব ভোগ বিলাসে জীবনযাপন করছে। অন্যদিকে, ৮০% মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। এখনো পৃথিবীতে ৮০ কোটি (১৩%) মানুষ ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যায়।

কৃষিকাজ না শিখলে আজকে হয়ত মানুষ নামের প্রাণীর কোন অস্তিত্ব থাকত না। কৃষি ছাড়া টিকে থাকলেও কি তা ৭০০ কোটিতে পৌঁছাতে পারত? কৃষি যেমন একদিকে খাদ্য নিরাপত্তা দিয়েছে তেমনি অন্যদিকে সেই নিরাপত্তার কারণে মানুষ গভীর চিন্তায় মগ্ন হবার সুযোগ পেয়েছে। নতুন নতুন আবিষ্কার মানুষের জীবনকে দিন দিন অধিক নিরাপত্তা দিচ্ছে। এই নিরাপত্তা নিয়ে মানুষ আরও বেশি সম্পদ আহরণের কাজে লিপ্ত রয়েছে। যত বেশি সম্পদ তত বেশি নিরাপত্তা তত বেশি মান-মর্যাদা। বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের সম্মান, মর্যাদা নির্ধারণ হয় সম্পদের পরিমাণের উপর। যার যত বেশি সম্পদ তার তত বেশি মর্যাদা, ক্ষমতা। সম্পদশালীদের সুবিধা অনুযায়ী রাষ্ট্র আইন তৈরী করে, মসজিদ,  মন্দির,  গির্জা ফতোয়া  দেয়; গণমাধ্যম তাদের গৌরবমুখর হয়ে ঢোল-তবলা বাজায়। ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে, গোষ্ঠিতে-গোষ্ঠিতে, দেশে-দেশে যে বৈরী ভাব, যুদ্ধ-বিগ্রহ দেখা যায় তার এক এবং অভিন্ন কারণ সম্পদ। সম্পদ প্রাপ্তির নেশা মানুষকে অমানুষে পরিণত করেছে।

মানুষত্বে ফিরে যাওয়ার সহজ পথ সম্পদের নেশা ত্যাগ করা। সম্পদের প্রয়োজন আছে একথা স্বীকার করেই বলা যায় সম্পদের নেশার প্রয়োজন নেই। মাসলো মানুষের প্রয়োজনের যে প্রথম তিনটি স্তরের কথা বলেছেন তা অর্জনের জন্য সম্পদ প্রয়োজন। সম্মান, শ্রদ্ধা এবং পরিপূর্ণতা অর্জনের ক্ষেত্রে সম্পদের ভূমিকা অনেক অনেক কম। সমাজে একজন মানুষের মর্যাদা নির্ধারনের মাপকাঠি যদি সম্পদের পরিমাণের পরিবর্তে মননশীলতা এবং মানবিকতার গুণগত মান দিয়ে করা যায় তাহলে মানুষ সম্পদ অর্জনের নেশা পরিত্যাগ করবে।

একটা সমাজে সকলে মিলে যদি সমাজের সামষ্টিক সম্পদ অর্জনের জন্য কাজ করে আর তার বিনিময়ে সমাজ আহরিত সম্পদ সকলের মধ্যে সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা করে তাহলে সম্পদ অর্জনের জন্য মানুষে মানুষে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা থাকবে না; মানুষের সময় বাঁচবে। সেই বেঁচে যাওয়া সময় মানুষ মননশীলতা চর্চার জন্য, পরোপকারের জন্য, প্রকৃতির উন্নয়নের জয়, জ্ঞানার্জনের জন্য খরচ করবে। মানুষ মানুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে। মানুষ মানুষকে সম্মান করবে, শ্রদ্ধা করবে তার মানবিকতার জন্য, মননশীলতার জন্য, সৃজনশীলতার জন্য। মানুষ মূলত মান-সম্মানই চায়। কেউ তা অর্জন করতে চায় সম্পদের পাহাড় বানিয়ে অন্যদের হতচকিত করে দেয়ার মাধ্যমে। অন্যরা তা  চায় নতুন কিছু সৃষ্টি করে তা  মানব কল্যাণে কাজে লাগানোর মাধ্যমে। মান-মর্যাদা পরিমাপের মাপকাঠিটাই যদি বদলে দেয়া যায় তবে আর  মানুষে মানুষে হানাহানি, কাটাকাটি থাকবে না;  সুন্দর এই পৃথিবীটা মানুষের ভালবাসায় সুজলা, সুফলা, মানবিক হয়ে উঠবে।