ফ্রান্স নির্বাচন থেকে শোষক শ্রেণি আউট

সাব্বির আহমেদ
Published : 25 April 2017, 03:12 AM
Updated : 25 April 2017, 03:12 AM

গতকালের ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রথম পর্বে জিতেছেন সুশীল এমানুয়েল ম্যাকরন এবং কড়া ডানপন্থী মেরিন লি পেন। প্রথম রাউন্ডে বাদ পরেছেন এতকালের শাসক দলগুলো। এসব দলগুলোর প্রার্থীরা হলেন ক্ষমতাসীন সোশালিস্ট দলের বেনট হ্যামন্ড, ডানপন্থী লা রিপাবলিকান ফ্রাঁসোয়া ফিলন এবং কড়া বাম, লা ফ্রান্স ইনসৌমাইজ দলের জঁ লুক মেলেনশন।

শাসক দলগুলোকে বাদ দিয়েছে ফ্রান্সের জনগণ। সবচেয়ে বেশী ভোট পেয়েছেন রাজনীতিতে নতুন, মধ্যপন্থী ৩৯ বছর বয়স্ক ম্যাকরন (২৩.৭৫%) এবং দ্বিতীয় স্থানে থেকে দ্বিতীয় পর্বে উত্তীর্ণ হয়েছেন চরম জাতীয়তাবাদী লি পেন (২১.৫৩%)।

ফ্রান্সের নির্বাচনী হয় দুই পর্বে। প্রথম পর্বে যত জন ইচ্ছা প্রার্থী হতে পারেন। তাদের মধ্য থেকে প্রথম দুইজন দ্বিতীয় পর্বে উক্তির্ন হবেন। প্রথম পর্বে যদি কেউ ৫০ শতাংশের বেশী ভোট পান তবে দ্বিতীয় পর্বের নির্বাচন হবে না। ৫০ শতাংশের বেশী ভোট পাওয়া প্রার্থী রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হবেন। সাধারণত এমন হয় না। প্রথম পর্বে সর্বাধিক ভোট পাওয়া দুজনের মধ্যে দ্বিতীয় পর্বের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং একজন নির্বাচিত হন।

এবারের নির্বাচনকে ব্যাতিক্রমধর্মী হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর কারণ এই নির্বাচনে প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর উপর থেকে আস্থা হারিয়েছে ফ্রেন্সরা। একদিকে জেগে উঠেছে চরম জাতীয়তাবাদ অন্যদিকে নবাগত ম্যাকরন। কড়া জাতীয়তাবাদী লি পেনকে তুলনা করা চলে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে। ট্রাম্প তাঁকে প্রকাশে সমর্থনও জানিয়েছেন। লি পেন নির্বাচনী প্রচারণায় পুতিনের প্রশংসা করে বক্তব্য রেখেছেন। রাজনৈতিক আদর্শের দিক থেকে তাঁরা দুজনেই এক। ট্রাম্পের মত লি পেন বলছেন – ফ্রান্স ফার্স্ট। তিনি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বিরোধী, অভিবাসন বিরোধী, এলিট বিরোধী, ইসলামী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশী সোচ্চার, দেশের পিছিয়ে পড়া লোকদের স্বার্থ রক্ষা তাঁর প্রথম এজেন্ডা। ট্রাম্পের রাজনীতির সঙ্গে মিল থাকলেও ব্যাক্তি ট্রাম্পের দুশ্চরিত্র এবং অসততার সঙ্গে তাঁর মিল নেই। তাঁকে ন্যায়নিষ্ঠ হিসেবেই ভোটাররা গ্রহণ করেছে।

এমানুয়েল ম্যাকরন সরকারী আমলা হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করেন। পরে সে চাকরি ছেড়ে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার হিসেবে কাজ করেন। বর্তমান রাষ্ট্রপতি ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ তাঁকে জুনিয়র অর্থনীতি মন্ত্রী বানান। সে কাজে ইস্তফা দিয়ে নিজে একটি রাজনৈতিক দল খোলেন মাত্র গতবছর। তাঁর দলের নাম অ্যাঁ ম্যাসে (ইংরেজিতে on the move; বাংলায় হতে পারে – দৌড়ের উপর)। মাত্র এক বছর আগে দল গঠন করে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে প্রথম পর্বে জিতে যাওয়া বিরাট ব্যাপার; তাও মাত্র ৩৯ বছর বয়সে। ম্যাকরন অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ইস্যুতে মধ্যপন্থী। নির্বাচনী ইস্তেহারে বা নির্বাচনী ইস্যু সৃষ্টিতে তার কোন বিশেষত্ব নেই।

ম্যাকরনের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার প্রধান কারণ ফ্রান্স রাজনীতির দেউলিয়াত্ব। চলমান রাজনীতিতে হতাশ লোকেরা ম্যাকরনের কাছে নতুন কিছু প্রত্যাশা করছে। মিডিয়া তাঁকে ব্যাপক সাপোর্ট করেছে। প্রথম পর্বে জেতার পর বিশ্বায়ন পন্থীরা, ধনীরা, ইউরোপিয়ান পন্থীরা, মধ্যপন্থীরা অর্থাৎ সুশীলেরা একই সঙ্গে রক্ষণশীলেরা ও বামেরা সকলে একাট্টা হয়ে ম্যাকরনের পেছেনে কাতার বেঁধে দাঁড়িয়েছে লি পেনকে ঠেকানোর জন্য। তাদের হাতে আর ভাল কোন প্রার্থী নেই বলে ম্যাকরনকে সমর্থন দেয়া ছাড়া কায়েমী স্বার্থবাদীদের আর কিছু করার নেই।

২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দা এবং তৎপরবর্তী বিশ্ব ব্যাপস্থাপনার জন্য আমেরিকার ইউরোপের সাধারণ মানুষ ক্ষেপে আছে সুশীল সমাজ এবং রাজনীতিবিদদের উপর। এর ফলেই ব্রেক্সিট হয়েছে, জিতেছে ট্রাম্পের মত দুশ্চরিত্র, বর্বর। গত মাসে নেদারল্যান্ডের জাতীয় নির্বাচনে আরেক ট্রাম্প, গ্রীট ওয়াইল্ডার জিতে জিতে হেরে গেছেন সুশীল মিডিয়ার কারণে। খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলে আমেরিকার নির্বাচনে টিকতে পারেননি বার্ণী স্যান্ডার্স; টাকার জোড়ে, টাকাওয়ালাদের স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করে জিতে গেছেন বর্বর ট্রাম্প। লি পেনের টাকা নেই; টাকা ওয়ালারা, সুশীলেরা, কায়েমী স্বার্থবাদীরা তাঁর বিরুদ্ধে। এ রকম পরিস্থিতিতে তাঁর জিতে আসা প্রায় অসম্ভব। ম্যাকরনকেই বলা হচ্ছে ফেভারিট।

ফ্রান্সসহ উন্নত বিশ্বের মূলধারার সকল রাজনৈতিক শক্তি, অর্থনৈতিক শক্তি, মিডিয়া শক্তি এখন ম্যাকরনের পেছনে। এঁকে হারানো সহজ হবে না আমজনতার প্রার্থী লি পেনের পক্ষে। লি পেনের বাস্তব সুযোগ আছে একটাই – প্রচারণার মাধ্যমে ম্যাকরনকে এলিট শ্রেণীর লোক হিসেবে প্রতিষ্টিত করা। মেইন্সট্রীম মিডিয়া তাঁর সঙ্গে নেই বলে এ কাজ কঠিন হবে। তবে তার রয়েছে বিশাল তরুণ কর্মী বাহিনী। এরা খেঁটে খাওয়া মানুষদের ভাবনার জগতটার উপর আরেকটু বেশী প্রভাব বিস্তার করতে পারলে, খেঁটে খাওয়া মানুষদের মাথা ঠাণ্ডা করে আরেকটু ভাববার সুযোগ করে দিতে পারলে সুশীলদের বিভ্রান্তির মায়াজাল ছিঁড়ে দলে দলে তারা ছুটে গিয়ে ভরে দিয়ে আসতে পারে লি পেনের ভোটের বাক্স। এটা নির্বাচন, নির্বাচনের ফলাফল অনেক সময় প্রচলিত ধ্যান-ধারণা উল্টে দিয়েছে। তার উপর এটা ফরাসী বিপ্লবের দেশ, ফ্রান্স। বিপ্লব যে আরেকটা হবে না তা কে বলতে পারে?