আওয়ামী লীগের ছাত্রলীগ সমস্যা!

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 6 Jan 2012, 05:50 AM
Updated : 20 Jan 2020, 04:05 PM

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী  ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ছাত্রলীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের লেখাপড়া করতে হবে। সুন্দর আচরণের মাধ্যমে মানুষের মন জয় করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ বুকে ধারণ করে চলতে হবে। ছাত্রলীগকে সুশিক্ষা ও মেধার আলোয় আলোকিত হতে হবে।… ছাত্রলীগ নেতাদের বঙ্গবন্ধুর লেখা দুটি বই অসমাপ্ত আত্মজীবনী' ও 'কারাগারের রোজনামচা'সহ জাতির পিতার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রকাশিত বই পড়তে হবে। মুজিববর্ষ উদযাপনে সক্রিয় থাকতে হবে।

নি:সন্দেহে সৎ উপদেশ এবং সুপরামর্শ। প্রশ্ন হচ্ছে, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনার এই সব উপদেশ বা পরামর্শ কতটুকু পালন করবে? কথায় কথায় 'নেত্রী মোদের শেখ হাসিনা' বলে স্লোগান দিলেও ছাত্রলীগ গত কয়েক বছর ধরেই আওয়ামী লীগের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। ছাত্রলীগের একশ্রেণির নেতাকর্মী নানা ধরনের অন্যায়-অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হওয়ার খবর আওয়ামী লীগের জন্য, সরকারের জন্য একাধিকবার বিব্রতকর হয়েছে। ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কোনো উদ্যোগই সফল হয়নি। অথচ ছাত্রলীগ এদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার যে ধারাবাহিক সংগ্রাম, তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছাত্রলীগের নাম। কিন্তু এখনকার ছাত্রলীগ ঐতিহ্যের কতটুকু ধারক-বাহক সে প্রশ্ন উঠছে। একের পর এক খারাপ কাজে ছাত্রলীগের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় মানুষ ছাত্রলীগকে একটি 'অপরাধী'দের অথবা 'অপরাধপ্রবণ' সংগঠন হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত হচ্ছে।। ধমক দিয়ে, শাসিয়ে ছাত্রলীগকে নির্বৃত্ত করতে পারছেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। বিষয়টি উদ্বেগের, আশঙ্কার এবং হতাশার।

ছাত্রলীগকে সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য শেখ হাসিনার যে ভাবনা-চিন্তা আছে সেটা তার বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। আওয়ামী লীগ চিরদিন ক্ষমতায় থাকবে না। শেখ হাসিনা নিজেই একাধিকবার দলের নেতাকর্মীদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে তার বয়স হয়েছে! তাকেও একসময় অবসর নিতে হবে। আওয়ামী লীগে নতুন নেতা সরবরাহ করার কারখানা হলো ছাত্রলীগ। কিন্তু ছাত্রলীগ যদি বিপথে চলে, ছাত্রলীগ নেতৃত্ব যদি আদর্শবাদী না হয়ে সুবিধাবাদী-সুযোগ সন্ধানী হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের জন্যই বড় সংকট তৈরি হবে। ছাত্রলীগকে বদলানোর কাজে শেখ হাসিনাকে তাই সফল হতেই হবে। বঙ্গবন্ধু-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগকে নতুন জীবন দিয়েছেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনাকেই আওয়ামী লীগকে ভবিষ্যতের জন্য সচল, সক্রিয়, কর্মক্ষম থাকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও করতে হবে। তিনি তার দায়িত্ব সম্পর্কে যে সচেতন আছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশের কিছু নেই।

দুই.
শেখ হাসিনার রাজনীতি করার কথা ছিল। তার পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তেমনটা চাননি বলেই তার বিয়ে দিয়েছিলেন একজন রাজনীতির বাইরের মানুষ, পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, শেখ হাসিনাকেই দায়িত্ব নিতে হয়েছে পিতার স্বপ্ন পূরণের। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখতেন, তা বাস্তবায়নের কঠিন সাধনায় নিজেকে ব্রতী করেছেন শেখ হাসিনা। প্রায় চার দশকের রাজনৈতিক জীবনে শেখ হাসিনা অনেক অসাধ্য সাধন করেছেন। চিরবৈরি বিএনপিকে তিনি 'সাইজ' করেছেন। অন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেও তিনি নিয়ন্ত্রণে এনেছেন। দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা-অনিশ্চয়তা চলছিল তার অনেকটাই দূর করেছেন। তিনি শত্রুকে মিত্র করার রাজনৈতিক কৌশলে সিদ্ধহস্ত। তবে এতে মিত্ররা বিশ্বাস হারাচ্ছে কিনা তা নিয়ে তাকে খুব চিন্তিত বলে মনে হয় না। সমালোচকদের কেউ কেউ বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার জন্য নীতি-আদর্শের সঙ্গে আপস করতে পিছপা হন না। ক্ষমতায় না থাকলে নীতি-আদর্শ বাস্তবায়ন করা হবে কীভাবে, সেটা অবশ্য তারা বলেন না। ক্ষমতায় থাকতে হবে আবার নীতি-আদর্শও বাস্তবায়ন করতে হবে। কাজটি কঠিন। কঠিন পথেই হাঁটছেন শেখ হাসিনা।

রাজনীতিতে বিশ্বব্যাপী একটি নতুন প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আদর্শবাদী অবস্থান দুর্বল হয়ে ক্ষমতায় থাকার কৌশল বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। রাজনীতিতে 'ক্ষমতা' যেহেতু শেষ কথা, সেহেতু ক্ষমতায় থাকার জন্য যা যা করা দরকার তাই তাই সফলভাবে করতে পারাটাই হালের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। এটা যে কেবল বাংলাদেশে শেখ হাসিনা অনুসরণ করে সুফল পেয়েছেন তা নয়, বাংলাদেশের মতো আরো কিছু দেশেও এই রীতি অনুসরণ করা হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের মতো দল কিংবা শেখ হাসিনার মতো নেত্রী কেন ৩০ ডিসেম্বরের মতো একটি নির্বাচনে যেতে বাধ্য হলো বা হলেন তা নিয়ে কোনো গভীর আলোচনা কোথাও হতে শোনা যায় না। শুধু বলা হচ্ছে, দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে। মানুষ তার পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারছে না। রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস এখন আর জনগণ নয়। বিভিন্ন গ্রুপ, গোষ্ঠাী, এজেন্সি এবং পেশাজীবীরা এখন রাজনৈতিক শক্তির প্রকৃত উৎসে পরিণত হয়েছে। কারা ভোটে জিতবে, কারা সরকার গঠন করবে তা নির্ধারণের মালিক এখন জনগণ বা ভোটাররা নন। এটা এখন ঠিক করে ওই শক্তিশালী চক্র। ওই চক্রের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা যার হাতে তিনিই আসলে প্রকৃত ক্ষমতাবান। এই যে ভারতের নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনের আগেই বললেন যে তিনি তিন শ আসনের বেশি জিতে সরকার গঠন করবেন এবং সেটাই যে সত্য হলো,  তা কীভাবে কাটায় কাটায় মিলে গেল? নরেন্দ্র মোদি কি জ্যোতিষ শাস্ত্র জানেন? না, ব্যাপারটা ঠিক তা হয়। জনগণ ভোট দিয়ে সরকার গঠন করে এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য যে সরকার গঠনের কিছু নেপথ্য কারিগরিও এখন সক্রিয় থাকে বা আছে। এই নেপথ্য কারিগররা যাকে বা যাদের সরকারকে দেখতে চায় তারাই শেষ পর্যন্ত ভোটে জেতে, তাদেরই ভোটে জেতানো হয়। নরেন্দ্র মোদিকে ভারতীয় ক্ষমতাবানরা ক্ষমতায় দেখতে চেয়েছে, তার পক্ষে সেভাবেই সব যন্ত্র কাজ করেছে এবং তিনি তার আশানুরূপ ফলও পেয়েছেন। তার গেম প্ল্যান ভালো ছিল। তিনি সফল হয়েছেন।

বাংলাদেশের ব্যাপারটাও অনেকটা সে রকমই। শেখ হাসিনা আবার প্রধানমন্ত্রী হবেন, আওয়ামী লীগই যে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবে এটা অনেকেরই জানা ছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট আবার ক্ষমতায় আসবে এটা ছিল কিছু কিছু মানুষের স্বপ্ন-কল্পনা। বিএনপি ছিল ক্ষমতার মোহে অন্ধ। তারা নিজের ক্ষমতার আসনে ভাবতে পছন্দ করে। কিন্তু ক্ষমতায় যেতে হলে ক্ষমতার যেসব কেন্দ্রের দোয়া বা ছাড়পত্র লাগে বিএনপি তা জোগাড়ের চেষ্টা করেনি বা চেষ্টা করেও  সফল হয়নি। মানুষ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে চেয়েছে। বিএনপি নানা কারণেই ব্যাপক মানুষের পছন্দের তালিকায় ছিল না। বিএনপিকে মানুষ বড় জোর একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকায় দেখতে চেয়েছে। কিন্তু মানুষের এই মনের ভাষা বিএনপি বুঝতে পারেনি। আওয়ামী লীগ পেরেছে। তাছাড়া যারা ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে তারা চেয়েছে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরে আসুক।

আওয়ামী লীগও ভোটের আগে থেকেই জেতার ব্যাপারে ছিল আত্মবিশ্বাসী। তারা যদি অনিয়ম-কারচুপির আশ্রয় না নিতো তাহলে হয়তো তাদের ভোটের পরিমাণ একটু কমতো। বিএনপি হয়তো ঠিকই ৬০/৭০ আসনে জিততো। কিন্তু তারা সঠিক পথে না হেঁটে ভুল পথে হেঁটেছে। মানুষ যেহেতু আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতায় দেখতে চেয়েছে তাই সেটা বাস্তবে হওয়ায় তারা আর উচ্চবাচ্য করার প্রয়োজন বোধ করেনি। অনিয়মের বিষয়টি মানুষের কাছে প্রাধান্য পায়নি। বিএনপির বিজয় আওয়ামী লীগ ছিনিয়ে নিয়েছে এমনটা মানুষের কাছে মনে হয়নি। তবে সব মিলিয়ে নির্বাচনকে ঘিরে যা হয়েছে তা মানুষকে হতাশ করেছে। আওয়ামী লীগের হয়তো একটি পরিকল্পনা ছিল যে নির্বিঘ্নে সরকার চালাতে গেলে বিরোধী দলকে দুর্বল করতে হবে। তারা সেটা করেছে। ভোটের পর এখন বিরোধী দলের দিক থেকে কোনো বড় ধরনের বিপদের আশঙ্কা নেই। তবে আওয়ামী লীগের সামনে বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজের দল এবং সহযোগী সংগঠনগুলো। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ১৪-দলের মুখপাত্র মোহাম্মাদ নাসিম একদিন বলেছেন,  আওয়ামী লীগে ভেজাল ঢুকে পড়েছে। খাদ্যে ভেজাল যেমন মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি দলের ভেজাল একই সঙ্গে দল ও সরকারের জন্যও বিপদজনক। দেশে ভেজালবিরোধী অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে দলের ভেতরও ভেলালবিরোধী অভিযান পরিচালনার ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন আওয়ামী লীগের এই প্রবীণ নেতা।

তবে আওয়ামী লীগের সামনে সবচেয়ে বড় বিপদ হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ। একসময়ের ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটি যেন পণ করেছে যে তারা শেখ হাসিনার সব সাফল্য ম্লান না করে ছাড়বে না। তারা নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে নিজেদের জড়াবেই। অপরাধ এবং ছাত্রলীগ একসঙ্গে চলার প্রতিজ্ঞা করে কার্যত সরকারকে এক বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলেছে।

ছাত্রলীগের ব্যাধি নিরাময়ের জন্য হোমিও চিকিৎসায় আর কাজ হবে না। বড় অপারেশন লাগবে। সেটা করা হবে, নাকি সাময়িক উপশমের জন্য টোটকা চিকিৎসার ওপরই ভরসা করা হবে সেটা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে এটা বোঝা যাচ্ছে যে, বিষয়টি শেখ হাসিনার নজরে আছে। তিনি 'শুদ্ধি' অভিযান শুরু করেছেন। বিতর্কিত, সমালোচিতদের নেতৃত্ব থেকে বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই অভিযানের সাফল্য নিয়ে কারো কারো মধ্যে সংশয় আছে। এটাকে আইওয়াশও মনে করা হচ্ছে। তবে শেখ হাসিনা সবাইকে তার ওপর ভরসা রাখতে বলেছেন। তিনি এটা বলতেই পারেন। কারণ তার ওপর ভরসা রাখলে যে হতাশ হতে হয় না, তার প্রমাণ তিনি একাধিকবার দিয়েছেন। তিনি যা বলেন, তা তিনি করেন। তিনি ফাঁকা বুলিতে বিশ্বাস করেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো একটু সময় লাগে কিন্তু তিনি কোনো প্রতিশ্রুতির কথা ভোলেন না।