গ্রামীণ ব্যাংক প্রসঙ্গ – সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে কবে?

সাফায়েত আমীন
Published : 29 August 2012, 07:47 PM
Updated : 29 August 2012, 07:47 PM

নানা সমস্যায় জর্জরিত আমাদের এই দেশ ও দেশের অর্থনীতি। বিশ্বের দরবারে দারিদ্র্যপীড়িত এবং ঘনবসতিপূর্ণ স্থান হিসাবেই স্থানটি পরিচিত যার প্রতিটি পৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে দুর্নীতি। এতো কিছুর মাঝেও অল্প কিছু ব্যক্তি তাদের কাজের দ্বারা গোটা বিশ্বে হন সমাদৃত এবং তার সাথে সাথে আলোকিত হয় পুরো দেশ । নোবেল বিজয়ী ডক্টর মোহাম্মদ ইউনূস সেরকমই একজন মানুষ । তার সৃষ্ট গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচিতি এখন দেশ ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। আমেরিকা , ইউরোপসহ অন্যান্য উন্নত দেশে এখন গ্রামীণ ব্যাংকের মতাদর্শকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে নিত্যনতুন ব্যাংক। ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক এবং ইউনুস যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, এখানে উল্লেখ্য যে সারা পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত মাত্র ২০ টি প্রতিষ্ঠান আছে যারা কিনা নোবেল প্রাইজ পেয়েছে এবং এশিয়াতে এটিই সর্বপ্রথম ।

গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে আলোচনা শুরু করার আগে এর ইতিহাসটা সংক্ষিপ্তভাবে একবার আলোচনা করা উচিত। গ্রামীণ ব্যাংকের পথচলা শুরু হয় ১৯৭৬ সালে চট্রগ্রামের জোবরা গ্রামে । মাত্র ৮৫৬ টাকা নিজের পকেট থেকে দিয়ে এ প্রকল্পটির যাত্রা শুরু করেন মোহাম্মদ ইউনূস ।এরপর ১৯৭৮ সালে এটিকে রূপান্তর করা হয় কৃষি ব্যাংকের একটি প্রকল্প হিসাবে । এরপর ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন ডেপুটি গভর্নরের আগ্রহে এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রকল্প হিসাবে আরও বৃহত্তর আকার ধারণ করলো । এরপর ১৯৮৩ সালে "গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ ১৯৮৩" প্রণয়ন ও জারি করা হয় যার ফলে গ্রামীণ প্রকল্প এবার এবার পরিনিত হয় গ্রামীণ ব্যাংক এ। সময়ের সাথে সাথে এ ব্যাংকটি দ্রুত বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করে । ফলে মাত্র ৮৫৬ টাকা দিয়ে যে ব্যাংকটির সূচনা হয়েছিল আজ সে ব্যাংক বছরে ৮৪ লাখ ঋণগ্রহীতাকে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। এ বছর (২০১২) গরীব মহিলারা নিজস্ব সঞ্চয়ীআমানতে ৭ হাজার কোটি টাকা জমা দিয়েছে যার পরিমান প্রতিদিনই বাড়ছে ।

এখন মনে প্রশ্ন আসতে পারে এ ব্যাংকটির জনপ্রিয়তার পেছনে কারণগুলো কি? "মাইক্রোক্রেডিট" বা ছোট ঋণের ধারণা দিয়ে শুরু করলেও এ ব্যাংকটি একটি ব্যাপারে পৃথিবীর অন্য যেকোনো ব্যাংক থেকে আলাদা, তাহল এ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে কোন জামানতের প্রয়োজন হয় না , দরকার হয় না কোন জমাজমির দলিল দাখিলের । ফলে একেবারে অসহায় নিঃস্ব লোকজনও ঋণ নিতে পারে এ প্রতিষ্ঠানটি থেকে, চেষ্টা করতে পারে তাদের ভাগ্যকে পরিবর্তনের । কোন ঋণ গ্রহীতা বা তার স্বামী মারা গেলে অবশিষ্ট ঋণ আর পরিশোধ করতে হয় না । এছাড়াও গরীব ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাঋণ দেয়া হয় যাতে লেখাপড়া চলাকালীন প্রদত্ত ঋণের উপর কোন সুদ ধার্য করা হয় না । গরীব মানুষের সুবিধার্থে আরও অনেক ঋণ প্রকল্প চালু আছে এ ব্যাংকটির আওতায় এবং ব্যাংকটি এখন বৃহৎ পরিসরেও ঋণ দেয়া শুরু করেছে । এ ব্যাংকটির জনপ্রিয়টার অন্যতম আরেকটি কারণ হল এ ব্যাংকটির মালিকানা ঋণগ্রহীতাদের হাতেই এবং সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারও তাদের দ্বারা গঠিত পরিচালনা পর্ষদের হাতে । দেশের আনাচে কানাচে অসংখ্য গরীব নারীরা তাই গ্রামীণ ব্যাংককে নিজেদের ব্যাংক হিসাবেই চিহ্নিত করে থাকেন ।

অনেকে গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে উচ্চহারে সুদ নেবার অভিযোগ করে থাকেন । গত ৩০ জুলাই সম্প্রচারিত বিবিসি টেলিভিশনের 'হার্ডটক' টকশোতে দেখা যায় প্রধানমন্ত্রী বলছেন গ্রামীণ ব্যাংক গরীব মানুষের কাছ থেকে ৩০, ৪০ বা ৪৫ শতাংশ সুদ নেয়, কিন্তু তার দেয়া এ তথ্যটি বাস্তবসম্মত নয় । ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক রাষ্ট্রীয় সংস্থা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ সুদের হার ঠিক করেছে ২৭%। আর গ্রামীণ ব্যাংকের সর্বোচ্চ সুদের হার উৎপাদনশীল খাতে ২০%, অন্য খাতগুলোতে যথাক্রমে ৫%, ৮% ও ১০%। আবার কিছু ব্যক্তি বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে বলেন বিভিন্ন স্থানে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের নির্যাতিত হবার কথা । যেকোনো বড় পরিসরের কাজে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের দ্বারা এমন কিছু ঘটনা ঘটতে পারে তবে গ্রামীণ ব্যাংকের বেলায় এমন বিষয় কিন্তু তাদের নিয়ম নীতিতে নেই । আমাদের উচিত পুরো ব্যাপারটার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করা । আজ এই ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণ করে গ্রামীণ নারীরা স্বাবলম্বী হতে পারছে , গ্রামে নারীদের ক্ষমতায়ন পূর্বের চেয়ে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তারা আজ কুটিরশিল্প, খামারশিল্প ইত্যাদি কার্যক্রম দ্বারা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে যা কিন্তু কেউ অস্বীকার করতে পারবে না ।

নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত এ প্রতিষ্ঠান এবং ইউনূস এর বিরুদ্ধে সরকার আজ যে পদক্ষেপগুলো নিচ্ছে তা দেখে কিন্তু যে কারো মনে হওয়াটা স্বাভাবিক যে ড. ইউনূস কোন ব্যক্তিগত আক্রোশের স্বীকার। তা না হলে শুধুমাত্র বয়সের দোহাই দিয়ে তাকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পথ থেকে অপসারণ এবং এখন গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানার প্রায় সব অংশ সরকারের হাতে নেবার চেষ্টার আর কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না । কিছুদিন আগে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ জানান ইউনূসকে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রধান হিসাবে নিয়োগ দেবার জন্য, কিন্তু আমাদের দেশে আবার সেই ব্যক্তিকেই তার পদ থেকে অপসারণ করা হল বয়সের কারন দেখিয়ে ! এর কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া কঠিন । বেশ কয়েকবছর আগে TNT ল্যান্ডফোনের প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্ষমতা বাড়ানোর উদ্দেশে সরকার এটিকে প্রাইভেট কোম্পানিতে রূপান্তর করে, তাহলে গ্রামীণ ব্যাংকের বেলায় উল্টোদিকে পথচলা কেন? আমাদের দেশের সরকারি কোন প্রতিষ্ঠান কি কোনদিন এতটা জনপ্রিয়তা লাভ করতে পেরেছে ? বরং অধিকাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেই আমরা দেখতে পাই সীমাহীন দুর্নীতি এবং অনিয়ম। ডঃ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল পুরস্কার পাবার পর আমাদের উচিত ছিল ব্যাংকটির কার্যক্রম এবং মূলনীতি যেন অটুট থাকে সেদিকে লক্ষ রাখা , তা না করে বরং আমরা যদি জোর করে এর পরিবর্তন করি তবে তা গ্রামীণ ব্যাংকের মতাদর্শের বিরোধী হবে । যেই মূলনীতি এবং মতাদর্শকে সামনে রেখে গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল পুরস্কার লাভ করলো তাতে পরিবর্তন আনার অর্থ কি এই নয় যে আমাদের নোবেল প্রাইজ পাবার সিদ্ধান্তটিও তাহলে ভুল ছিল?

Globalization এর যুগে ইউনূস ও তার সৃষ্ট গ্রামীণ ব্যাংককে বিতর্কিত করার সাথে সাথে আমরাও কিন্তু নিজেদেরকে জাতি হিসাবে বিতর্কিত করে তুলছি। আমাদের উচিত ছিল ইউনূস এর ইমেজকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় স্বার্থে তা ব্যবহার করা,তা না করে আমরা তার দোষ ত্রুটি খুঁজতে শুরু করেছি এবং তার ব্যক্তিগত সম্পত্তির হিসাব নিতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে খোদ সরকার । আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যদের যদি তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির হিসাব দিতে বলা হতো তবে তারা কি করতেন কে জানে ! গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিশন গঠন করেছে সরকার , এর কি দরকার ছিল তা তারাই ভালো বলতে পারবেন কিন্তু জনগণের কাছে এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি প্রয়োজন শেয়ার ধ্বসের তদন্তের প্রতিবেদন জানা, এবং এর সুস্থ প্রতিকার । তা কি সরকার আমাদের করতে পেরেছে ? ডঃ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক বিষয়ে মিথ্যাচার করেছেন বলে জানালেন আমাদের সম্মানিত অর্থমন্ত্রী যা কিনা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সরকারের কিছু কর্মকর্তা আবার পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিলের দায়ভারও ইউনুসের কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছেন যার স্বপক্ষে কোন প্রমাণ নেই। এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে ইউনুসের জনপ্রিয়তা আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও অনেকগুণ বেশি, কাজেই তাকে নিয়ে মন্তব্য করার সময় প্রমাণ ছাড়া কথা বলা অনুচিত হবে । আজকে ডঃ ইউনূস এর সাথে এরূপ আচরণের ফলে আমেরিকা , ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাথে আমাদের কূটনীতিক সম্পর্ক দুর্বল হচ্ছে যা কিনা আমাদের মতো ক্ষুদ্র একটি রাষ্ট্রের জন্য কখনই মঙ্গলজনক নয়।

যেখানে সারা বিশ্বের অনেক দেশ গ্রামীণ ব্যাংকের Concept গ্রহণ করেছে সেখানে আমরা এখন তার পরিবর্তন আনতে চাই । সরকার চাচ্ছে গরীবের মালিকানা থেকে এটিকে সরকারি মালিকানায় আনতে , যার ফলে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত প্রদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে গরীব নারীরা। গ্রামীণ ব্যাংক যদি সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে দেশের বিত্তবানদের কোন ক্ষতি হবে না তবে তা সরাসরি হানবে দেশের গরীব এবং স্বল্প আয়ের মানুষদের উপর। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের অগণিত নারী ঋণগ্রহীতার উপর যার ফলে তারা হয়ে যেতে পারে আগের মতো নিঃস্ব এবং অসহায় । সরকারি মালিকানায় চলে গেলে গ্রামীণ ব্যাংক ধ্বংসের যে আশঙ্কা ডঃ ইউনূস করছেন তা অমূলক নয় । বিষয়টি নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের সচেতন হওয়া উচিত এবং সরকারকে পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাদের বর্তমান সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য অনুরোধ জানানো উচিত । তা না হলে ভবিষ্যতে গ্রামীণ ব্যাংকের মতো সুন্দর একটি সৃষ্টির ধ্বংসের কারিগর হিসাবেই আমাদের জাতি পরিচিতি লাভ করবো ।

সাফায়েত আমীন,

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ।