আমার চারপাশ: দুর্নীতির খণ্ডচিত্র-১

সগীর হোসাইন খান
Published : 19 March 2016, 05:52 PM
Updated : 19 March 2016, 05:52 PM

ঘটনার তারিখ: ২৯ জানুয়ারি, ২০১৬
ঘটনার সময়: আনুমানিক রাত ০৭:৪৫

[ঘটনাটি অনেক আগেই ঘটেছে এবং আমার লিখাটাও প্রস্তুত করে রেখেছি আরো অনেক আগে। কিন্তু ব্যস্ততা আর লিখার প্রতি আগের সেই আগ্রহ না থাকায় লিখি লিখি করেও লিখা হচ্ছিল না। তাই দেরি হয়ে গেল।]

রাত তখন সবে সাতটা। আমি আর পল্লব গাবতলীতে পৌঁছে অবাক হয়ে গেলাম। যে স্থানে কমছে কম ছয়/সাতটা বাস দাঁড়ানো থাকে সেখানে কোন বাসই নেই! বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি হল? এত আগে তো বাস বন্ধ হবার কথা না!  একটু পর বুঝতে পারলাম আসল ঘটনা। পুলিশ এখানে বাস থামতে দিবে না। তাই বাস বেশ অনেকটা সামনে দাঁড়িয়েছে। যতটুকু সামনে দাঁড়িয়েছে তা আমার মত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য বেশ লম্বা রাস্তা। পল্লবকে বললাম, "দেখতো ওখানে গেলে বাস পাওয়া যাবে নাকি? যদি পাওয়া যায় তাহলে এতটুকু পথ রিকশা করেই চলে যাবো।" সে একটু সামনে এগিয়ে বলল, "ভাই একটাই বাস দাঁড়ানো আছে এবং তা ভড়ে গেছে। আপনি আর উঠতে পারবেন না।"

কী আর করার! দু'জনে রিকশা করে বাসায় যাবার চিন্তা করছিলাম।

সৌভাগ্যক্রমে একটা বাস পেলাম যেটা মোহাম্মদপুর পর্যন্ত যাবে। পল্লব আগেই বাসে উঠে দুজনের জন্য দুটো সিট দখল করে রাখল। আমি অনেক মানুষকে ধাক্কা দিয়ে, লাথি-গুতো খেয়ে অবশেষে সেই রক্ষিত আসনে বসার সুযোগ পেলাম। বসেই চিন্তা শুরু হল মোহাম্মদপুর থেকে যাবো কী করে?

মোহাম্মদপুরে নামার পর মাথায় আসল এখান থেকে ইজিবাইক আছে যেগুলো সেকশন পর্যন্ত যায়। সেই পর্যন্ত গেলে বাসায় পৌঁছা কোন ব্যাপারই হবে না। একটু কষ্ট করে কিছুদূর হেটে গিয়ে সেই ইজিবাইকে আমি আর পল্লব চড়ে বসলাম। দু'জনের আসল হল চালকের দুই পাশে।

শীতের রাত। বাতাস সেই রকম ঠাণ্ডা। বসে আছি খোলা মেলা ইজিবাইকের সামনের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার আর পল্লবের জমে যাবার মত অবস্থা। এর উপর আমি বুঝতে পারছিলাম না ভাড়া কত দিতে হবে। আগে এই যানে চড়ে বেড়িবাঁধ দিয়ে যাইনি। তাই যারা আমাদের আগেই নামছিল তাদের ভাড়া দেওয়া দেখে বোঝার চেষ্টা করছিলাম দুজনের জন্য সেকশন পর্যন্ত ভাড়া কত হবে।

ভাড়া জানতে এবং স্বভাবসুলভ গল্প জমাতে চালক ভাইয়ের সাথে কথা বলা শুরু করলাম। ভাড়া জানার জন্য জিজ্ঞাসা করলাম, "ভাই তুলনামূলক ভাবে আপনাদের ভাড়া একটু বেশি মনে হচ্ছে! আপনাদের খরচ কি খুব বেশী নাকি?" তিনি "হ্যাঁ" বলে একটু থেমে আবার শুরু করলেন কথার ফুলঝুড়ি। তার কথা শুনে বুঝলাম তিনিও গল্প করতে বেশ মাজ পানা। একটু পর নিজে থেকেই খুলে বলা শুরু করলেন তাদের খরচ কেন বেশি।

তিনি যে হিসেবটা দিলেন তা এরকম:
প্রতিদিন ইজিবাইকের জমা দিয়ে হয়  = ৬০০ টাকা
প্রতিদিনের জন্য চাঁদা দিতে হয়    = ৩০০ টাকা
তার নিজের প্রতিদিনের খরচ    =১০০ টাকা
———————————
তার দৈনিক খরচ:        = ১০০০ টাকা

এর সাথে জানিয়ে রাখলেন প্রতি সপ্তাহে তাকে সরকারি অফিসের জন্য দিতে হয় ৫০০ টাকা। খরচের হিসেবটা শেষ করে বললেন, "তাহলে ভাড়া কম নেই কি করে?"

আমিও আর ভাড়া নিয়ে কিছু বললাম না। তার সাথে নানান গল্প শুরু করে দিলাম। বিশেষ করে দেশের দুর্ণীতির অবস্থা নিয়ে তার অভিজ্ঞতা আর আমার অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নিচ্ছিলাম। সেকশন আসতেই আমি আর পল্লব ১০+১০=২০ টাকা দিয়ে নেমে পড়লাম। নামার আগে চালক ভাইয়ের নামটা জেনে নিলাম। আসার আগে হাত মিলিয়ে শুধু বললা, "ঠিক আছে রফিক ভাই, বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে ইনশাল্লাহ।"

এবার আসেন আমরা একটু হিসেবে করি।

প্রতিদিন ১০০০ টাকা করে সাত দিনে তার খরচ ৭০০০ টাকা।
এর সাথে প্রতি সপ্তাহে সরকারি অফিসে দিতে হয় ৫০০ টাকা।
মানে প্রতি  সপ্তাহে তার খরচ দাঁড়াল ৭৫০০ টাকা।

এর মধ্যে চাঁদা প্রতিদিন ৩০০ করে সপ্তাহে দিতে হয় ২১০০ টাকা এবং সপ্তাহে ৫০০ টকাা, মোট ২৬০০ টাকা। তার মানে সে যা আয় করছে তার মাঝ থেকে সপ্তাহে ২৬০০ করে চার সপ্তাহে মানে মাসে মোট ১০,৪০০ টাকা তাকে চাঁদা দিতে হচ্ছে। যা বছর শেষে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ১,২৪,৮০০ টাকা! কি একটু ধাক্কা খেলেন।
শেষ হয়নিতো! তার আগেই যদি ধাক্কা খান তাহলে কি করে হবে?

বেড়িবাঁধের মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড় থেকে অনেকগুলো ইজিবাইক চলে। বুদ্ধিজীবী পর্যন্ত পার্ক করে রাখা ইজিবাইকের সংখ্যা ৬০ থেকে ৭০'টার মত। আমি ধরে নিলাম সেটা ৫০। এর কম হবে না। তাহলে বছরে চাঁদার পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৬২,৪০,০০০ টাকা মাত্র!

নেন এবার একটু অবাক হন।