আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ও কৃষকের বিড়ম্বনা…

ম, সাহিদ
Published : 21 May 2011, 04:21 AM
Updated : 21 May 2011, 04:21 AM

কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার রাঘবপুর গ্রামের কৃষক খোরশেদ আলম। গত ১৪ এপ্রিল প্রায় সাড়ে নয় লাখ টাকায় তিনি একটি 'কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার' (ধান কাটা ও মাড়াই একত্রে চলে এমন কল) কেনেন। ওই দিনই ধান কাটা শুরু করেন। নতুন কলে ধান কাটা দেখতে মানুষের ঢল নামে। মাত্র ৩০ শতাংশ জমির ধান কাটার পরই যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। পরপর দুটি বেল্ট ছিঁড়ে যায়। বেল্ট লাগানোর পর ডায়নামা নষ্ট হয়ে যায়। ডায়নামা সংযোগ দেওয়ার পর ব্যাটারি অকেজো হয়ে যায়। ব্যাটারি পরিবর্তনের পর সমস্যা দেখা দেয় নজেল পাঞ্জারে। তা-ও সংযোগ হয়। আবারও সমস্যা দেখা দেয় তেল সরবরাহের হুইল পাম্পে। এভাবে কয়েক দিনে কলটিতে শুধু বেল্টই লাগানো হয়েছে ৪৭টি। সর্বসাকল্যে খরচ হয়েছে দেড় লাখ টাকা।

সহজে, স্বল্প সময়ে ও কম খরচে ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়া ও বস্তা বন্দীর জন্য কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার যুগোপযোগী একটি কল। এটি দিয়ে মাত্র এক দিনে ১৬ একর জমির ধান কাটা থেকে শুরু করে বস্তাভর্তি পর্যন্ত সব কাজ করা যায়। অথচ ওই কাজ করতে ৪০০ জন কৃষিশ্রমিক লাগে বলে কৃষকেরা জানিয়েছেন।

বিদেশ থেকে আমদানি করা পুরোনো ও ব্যবহূত (রিকন্ডিশন্ড) এই কল কিনে দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষকেরা বিপাকে পড়েছেন। মাঠে নামানোর পরপরই এর নানা যন্ত্রাংশ বিকল হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় বাজারে খুচরা যন্ত্রাংশ না পেয়ে কৃষকেরাই জোড়াতালি দিয়ে এটি সারিয়ে তুলছেন। তারপর আবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কোনো যন্ত্রাংশ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আওতাধীন খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের অধীনে সরকার ২৫ শতাংশ ভর্তুকিতে কৃষকদের হাতে এই কল তুলে দেয়। অধিদপ্তর সূত্র জানায়, কৃষি-যন্ত্রাংশ পরিবেশক করোনা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও এসিআই কোম্পানি লিমিটেড কোরিয়া থেকে কলটি আমদানি করে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ২৫ জেলার ২৩৭টি উপজেলাকে অত্যাধুনিক এই কল বিতরণের আওতায় আনে। ইতিমধ্যে এসিআই ৩০০ ও করোনা ৩০টি কল আমদানি করেছে। এগুলোর মধ্যে এসিআই ২৫ জেলায় ২৫টি এবং করোনা পাঁচ উপজেলায় পাঁচটি কল বিতরণ করেছে। কৃষক ও ব্যবসায়ীরা এসব কল কিনে স্বস্তিতে নেই। কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার কিনে দেবীদ্বারের কৃষক খোরশেদ আলমের মতো বিপাকে পড়েছেন বগুড়ার কাজল মিয়া, নেত্রকোনার কৃষক সুমন মিয়া প্রমুখ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের পরিচালক শেখ মো. নাজিমউদ্দিন বলেন, কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব সৃষ্টিকারী একটি উপকরণ। বর্তমানে কৃষিশ্রমিকের আকাল পড়েছে। সময়মতো কৃষিশ্রমিক না পাওয়ার কারণে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই যন্ত্র ধান কাটাসহ একসঙ্গে পাঁচটি কাজ করতে পারে।

শেখ মো. নাজিমউদ্দিন যন্ত্রটির বিভিন্ন ত্রুটি ও সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেন, 'আমাদের বড় ধরনের কৃষিখামার, দক্ষ কারিগর ও অভিজ্ঞ চালকের অভাব রয়েছে। নতুন একটি মেশিনের দাম ২৫ থেকে ৩২ লাখ টাকা। রিকন্ডিশন্ড একটি যন্ত্রের দাম প্রায় সাড়ে নয় লাখ টাকা। চলতি বছর থেকেই এ প্রযুক্তি আমাদের দেশে চালু করা হয়েছে।'

কৃষকেরা জানান, এই কল দিয়ে এক একর জমির ধান তুলতে খরচ পড়ে চার হাজার টাকা। আর কৃষিশ্রমিকের সাহায্যে তুলতে প্রায় দ্বিগুণ খরচ পড়ে। গত ৫ এপ্রিল সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার কুটি এলাকায় কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার দিয়ে ধান কাটতে গিয়ে চাষিরা সমস্যায় পড়েন। যন্ত্রটির চেসিসের প্রায় আট ইঞ্চি জায়গায় ফাটল দেখা দেয়। ওই অবস্থায় যন্ত্রটি বাড়িতে ফিরিয়ে আনাও কঠিন হয়ে পড়ে।

দেবীদ্বার উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. সফিউল্লাহ মৃধা অভিযোগ করেন, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান তাঁদের শর্ত মানেনি। এক বছরের ওয়ারেন্টি থাকলেও প্রতিষ্ঠান কার্যকর কোনো ভূমিকা নেয়নি। ক্রেতাকে কোনো ধরনের রসিদ, কাগজপত্র, এমনকি টুলবাক্সও দেয়নি।

দেবীদ্বারের কৃষি কর্মকর্তা বশির আহাম্মদ জানান, সার্ভিসিং ছাড়াই যন্ত্রগুলো গ্রাহকদের সরবরাহ করায় অধিকাংশই বিকল হয়ে যাচ্ছে। সরবরাহ করা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত যন্ত্রগুলো সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ফেরত নিতে হবে।
যন্ত্রটির আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান করোনা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'সমস্যা বেশি হলে আমরা মেশিন ফেরত নিয়ে টাকা ফেরত দেব।'

তবে মেশিনটি অত্যান্ত যুগপোযোগী এটা সকলেই স্বীকার করছে এক কথায় কিন্তু মেশিনটি কৃষকের হাতে তুলে দেওয়ার আগে এর যথাযথ প্রশিক্ষন ও রক্ষনাবেক্ষণ নিশ্চিত করার ব্যাপারটি গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ ছিল। সম্ভবনাময় একটি লাগসই প্রযুক্তি শুরুতেই হোঁচট খাওয়ার পিছনে একমাত্র কারন কতৃপক্ষের দূরদর্শিতার অভাব ছাড়া আর কিছু নয় বলে মনে করছেন ভুক্তভোগী।