সাঈদীর রায় ও যুদ্ধাপরাধ বিচারের রাজনীতি

ইমতিয়ার শামীম
Published : 8 June 2011, 02:37 PM
Updated : 21 Sept 2014, 02:59 PM

১৭ সেপ্টেম্বরে, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণার দিনেই জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হয়েছে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী– যার মাধ্যমে বিচারপতিদের অভিসংশনের ক্ষমতা ফিরে পেয়েছেন সাংসদরা। সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ড হওয়ায় জামায়াতে ইসলামী ১৮ ও ২১ সেপ্টেম্বর হরতাল ডেকেছিল। এখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটও জামায়াতে ইসলামীর গায়ে গা লাগিয়ে ২২ সেপ্টেম্বর হরতাল ডেকেছে– যদিও তা, তাদের বক্তব্য অনুযায়ী বিচারপতিদের অভিশংসন সংক্রান্ত ষোড়শ সংশোধনীর প্রতিবাদে।

সাঈদীর রায় সম্পর্কে বিএনপির পক্ষ থেকে অবশ্য কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেওয়া হয়নি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এ বিচার নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু এ হরতালই বলে দিচ্ছে, মাথাব্যথা তাদেরও আছে– তারা জনগণের চোখের ভাষা পড়তে চাইছে না, তারা চাইছে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দিতে।

বিএনপি, তাছাড়া সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও চাইছেন, ষোড়শ সংশোধনীকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরতে। বিএনপি হামেশাই একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা থেকে বহুদলীয় ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের কৃতিত্ব দাবি করে– কিন্তু কখনওই এই ব্যাখ্যা দেয় না, কেন তারা চতুর্থ সংশোধনী বাতিল করে সরাসরি বাকশালী একদলীয় ব্যবস্থার বদলে সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করেনি; কেন তারা অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে দেয়নি।

এখন আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে এর বিচারপ্রক্রিয়া, তদন্তের কাজ ও রায় যেভাবে বিভিন্ন সময় প্রভাবিত করার চেষ্টা চালানো হয়েছে বা এখনও চেষ্টা করা হচ্ছে, তাতে বিচারপতিদের অভিশংসনের বিষয়টি নিরবেই নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে। সাঈদীর রায় ঘোষণার দিনই একটি সংবাদপত্রে খবর এসেছে, যুক্তরাষ্ট্রে চারটি লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর চুক্তি হয়েছে– যাতে মীর কাশেম আলী ও মতিউর রহমান নিজামীর মামলার রায় প্রভাবিত করা যায়।

এ জন্যে মীর কাসেম আলীর ভাই মীর মাসুম আলী এবং মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে নাকীবুর রহমান নিজামী তাদের সংগঠন 'অর্গানাইজেশান ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস' এবং 'হিউম্যান রাইটস ডেভেলপমেন্ট অব বাংলাদেশ' যুক্তরাষ্ট্রে চালাচ্ছে নানা ধরনের প্রচারণা। দুটি লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে তাদের। এ দুটি লবিস্ট ফার্ম হল 'কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট ইনকরপোরেশন' এবং 'গ্রিবোস্কি গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিস'। কেসিডি আবার সাব কন্ট্রাক্ট করেছে 'ক্লোয়াক্রম অ্যাডভাইজর' এবং 'কে গ্লোবাল' নামের আরও দুটি লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে।

এইভাবে লবিস্ট ফার্মের মাধ্যমে সাঈদীর যুদ্ধাপরাধ মামলা কতটুকু প্রভাবিত করা হয়েছে, তার কোনো কিছু জানা নেই আমাদের– তবে টবি ক্যাডম্যানদের মতো কাউকে কাউকে প্রকাশ্যেই সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে। বিভিন্ন লবিস্ট ফার্ম বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার যেভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে যদি কখনও কারও অভিশংসনের প্রশ্ন আসে, তাতেও কেউ অবাক হবেন না।

যুক্তরাষ্ট্রে লবিং একটি স্বীকৃত ব্যবসা এবং কেসিডি অ্যাসোসিয়েটসের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মীর কাসেম আলী তাদের সর্বোচ্চ অর্থপ্রদানকারী ১৪০ জন ক্লায়েন্টের মধ্যে অন্যতম! আর আন্তর্জাতিক রাজনীতির জালও এমন বিস্তৃত যে, লবিস্ট ফার্মের পাশাপাশি বিভিন্ন পরাশক্তিও এসব ব্যাপারে নাক গলাচ্ছে। সাঈদীর চূড়ান্ত রায় হওয়ার কিছুদিন আগে পঞ্চমবারের মতো বাংলাদেশ সফর করে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক অ্যাম্বাসেডর-অ্যাট-লার্জ, উইলিয়াম স্টিফেন র‌্যাপ। বাংলাদেশ তাদের স্নেহের ছোট ভাই, তারা চায় বাংলাদেশের বিচারকাজ বিশ্বের পাতে তুলে দিতে!

যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিছুদিন আগেও যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল, সাঈদীর রায় হওয়ার পর তারা সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। তারা খুশি, কারণ মৃত্যুদণ্ড নয়, শেষ পর্যন্ত সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিচার বিভাগের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখার পরও বলা যায়, এ রায় দেশের মানুষকে হতাশ ও ক্ষুব্ধ করেছে। তদন্ত সংস্থার গাফলতিই হোক (যেমনটি বলছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম) আর রাজনৈতিক সমঝোতাই হোক (যেমনটি বলা হচ্ছে গণজাগরণ মঞ্চ কিংবা ক্ষুব্ধ জনগণের মধ্যে থেকে)– এই হতাশা ও ক্ষোভ থেকে রেহাই নেই আমাদের।

যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তিতে রায় দিয়ে বিচার বিভাগের আপিল বিভাগ নিজেদের সম্মান সমুন্নত রেখেছেন, কিন্তু আমরা কীভাবে পারব ওই হতাশা ও ক্ষোভ থেকে বেরিয়ে আসতে? তদন্তের দুর্বলতার ওপর গুরুত্ব দিলে রাজনৈতিক আঁতাতের অভিযোগ হালকা হয়, অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বের ব্যাপারগুলোও হালকা হয়, কিন্তু তবুও কি অস্বীকার করা যাবে, মামলাগুলো ভিন্নগামী করতে অনেক লোভের ফাঁদ পাতা হয়েছে?

বছরখানেক আগেও মাসের পর মাস জামায়াতে ইসলামী রাজনীতি ও জনজীবন অস্থিতিশীল করে রেখেছিল। যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দাবি করছিল তারা, বলছিল ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দিতে। অনেকেরই তখন মনে হয়েছিল, এত শক্তি জামায়াতে ইসলামী পাচ্ছে কোথা থেকে। এখন ভারতে যে নরেন্দ্র মোদীর দল নির্বাচিত হওয়ার পর বিএনপির খালেদা জিয়া 'প্রথম' অভিনন্দন জানানোর কৃতিত্ব নিয়েছিলেন, সেই মোদীর সময়েই সারদাহ গ্রুপের কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার সূত্রে জানা যাচ্ছে, কোন রন্ধ্রপথে জামায়াত মাসের পর মাস রাজপথ উত্তপ্ত করে রেখেছিল।

নতুন করে সে রকম পরিস্থিতির মুখে যাতে পড়তে না হয়, সরকার তা নিয়ে চিন্তা করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তবে এটাও নিশ্চয়ই তাদের বোঝার কথা, এ ধরনের ছাড় দিয়ে পরিস্থিতি আসলে শান্ত রাখা যায় না, স্থিতিশীল রাখা যায় না।

রায় যা-ই হোক না কেন, পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকবে না– কেননা রাষ্ট্রক্ষমতায় কারা থাকবে, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। সাঈদীর রায় হওয়ার কয়েক দিন আগেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাসে হামলা চালিয়ে শিবিরকর্মীরা ১৪ জনকে আহত করেছে। এ রকম ভয়াবহ ঘটনার পরও আমরা সারা দেশে তেমন কোনো প্রতিবাদ দেখিনি। সাঈদীর রায়ের পর তরুণরা তিন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে প্রতিবাদ করেছে। তার মানে যুদ্ধাপরাধের বিচার যারা চাইছেন, তারা শিবিরের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ থাকতে পারছেন না, সংঘবদ্ধভাবে প্রতিবাদও করতে পারছেন না। এখন যুদ্ধাপরাধের বিচার চাইব, অথচ এ দাবির বিরোধিতাকারী জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে পারব না, তা তো হয় না। অথচ বাস্তবে তাই হচ্ছে।

রাজনৈতিক দল ও ভোটারবিহীন ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রত্যাশী ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতিবিরোধী অনন্যোপায় মানুষ নানা কারণেই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ এখন মানুষের সেই অসহায়তা পুঁজি করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছে। অন্য কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক দল নেই, যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে– মানুষের এই অসহায়তা পুঁজি করে আওয়ামী লীগ এখন বেপরোয়া, দলের নেতাদের খুন করছে দলের নেতারাই, গডফাদারদের সাম্রাজ্যে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে দলের নেতা-কর্মীরাই, পাশাপাশি চলছে বিচারবহির্ভূত হত্যা।

নিজেদের অগ্রহণযোগ্যতা দূর করার জন্যে আওয়ামী লীগের প্রয়োজন ছিল সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে এগুনো। কিন্তু চোখ বুজেই বলা যায়, সে ব্যাপারে মনযোগী নয় তারা। প্রধানমন্ত্রীকেই এখন আক্ষেপ করে বলতে শোনা যাচ্ছে, 'আওয়ামী লীগের সব নেতাকেই কেনা যায়। কেবল শেখ হাসিনাকে ছাড়া…।' অন্যদিকে, অন্যান্য যে দলগুলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইছে, তারা রাজনীতির মাঠে যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়দানকারী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে সক্রিয় নয়– তাদের মূল লক্ষ্যও আওয়ামী লীগ। ব্লেম গেমেই তাদের আগ্রহ বেশি। তারাই যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি জাতীয় পর্যায়ে তুলে এনেছে, এই সত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে আওয়ামী লীগের 'ষড়যন্ত্র', 'আঁতাত' ইত্যাদি নিয়েই বেশি ব্যস্ত তারা।

বাস্তবতা হল, আজ হোক, কাল হোক, আওয়ামী লীগকে একটি সংসদ নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হবে। সুশাসনের ক্ষেত্রে তারা কোনো উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেনি; যুদ্ধাপরাধ বিচারের ক্ষেত্রেও যদি তারা ব্যর্থ হয়, তাহলে তাদের আরও বেশি মাশুল দিতে হবে।

বিএনপি একবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার মতো বোকামি দেখিয়েছে, কিন্তু ভবিষ্যতেও কি একই বোকামি দেখাবে? বিশেষ করে বিএনপি যখন দেখতেই পাচ্ছে, মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের সংগ্রাম আগের চেয়ে কঠিন হয়ে উঠেছে এবং পর পর দুটি পর্বে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার মধ্যে দিয়ে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণারও বিস্তার ঘটেছে? সে বিবেচনায়, পাঁচ বছর পরেই হোক আর এক-দেড় বছর পরেই হোক, আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যে এক কঠিন পরীক্ষা। এই পরীক্ষা পেরুতে হলে কেবল অর্থনৈতিক সাফল্য নয়, যুদ্ধাপরাধী বিচারের মতো ইস্যুটিতেও তাদের সফলতা দেখাতে হবে।

যে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতির জালে বাংলাদেশ জড়িয়ে আছে, তা-ও এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য করার মতো। ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের পর তার ক্রিটিক্যাল অভিপ্রকাশও ঘটেছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীন ও ভারতের উত্থান ঘটছে, তাদের মধ্যেকার সীমাহীন বাণিজ্যিক নৈকট্যও চোখে পড়ার মতো। আর তাই ভূ-রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এখন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অন্য যে কোনোও সময়ের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সরকারি দল হিসেবে বিভিন্ন শ্রেণি-আকাঙ্ক্ষার টানাপড়েনে আবদ্ধ আওয়ামী লীগের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষায় পুরোপুরি গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব নয় (যদিও শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে ধনিক শ্রেণির আকাঙ্ক্ষাই ধারণ করতে হয়)।

যুক্তরাষ্ট্রকে তাই নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশে পৃষ্ঠপোষকতা করতে হয় বিএনপিসহ বিভিন্ন 'মডারেট মুসলিম দলগুলোকে'ও– যার প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের সঙ্গেও তার নতুন নতুন দ্বন্দ্ব তৈরি হয় এবং যে দ্বন্দ্বের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগও ক্রমশ 'মডারেট মুসলিম দল' হওয়ার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে থাকে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাশিয়া-চীন-ভারত লবির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে থাকে।

এর মধ্যে ভারত ও চীনের মধ্যেকার পুরানো বাণিজ্যিক যাতায়াত পথ পুনরায় চালু করার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশও যুক্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ যুক্ত হতে চলেছে ব্রিকস ব্যাংকের পথযাত্রার সঙ্গেও। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী সদস্য হওয়ার নির্বাচনে ছাড় দিয়ে বাংলাদেশ সম্প্রতি জাপানকেও অর্থনৈতিক মিত্রের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। এইভাবে আন্তর্জাতিক ও অর্থনৈতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নতুন নতুন মিত্র খুঁজে নিচ্ছে। যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কূটনীতির পরিসর বাড়িয়ে চললেও এবং ৫ জানুয়ারির নির্বাচন-পরবর্তী অসহায়ত্ব কমিয়ে আনলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আওয়ামী লীগের বন্ধুত্বের পরিসর সংক্ষিপ্ত করে ফেলছে।

এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশে আরও রাজনৈতিক-কূটনৈতিক মিত্র খুঁজবে– সেটিই স্বাভাবিক। যেমন, মিত্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে সুশীল সমাজকে। বিপরীতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী বিভিন্ন সংগঠনও চাইছে আলাদা শক্তি হয়ে উঠতে। সুশীল সমাজ চাইছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে– যাতে নিজেদের আলাদা শক্তি হিসেবে, চাপ-দল হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। কিন্তু এই প্রশ্নবিদ্ধকরণ প্রক্রিয়ায় বাস্তবে বাংলাদেশের ইতিহাসই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে এবং রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মৌলবাদ মাটি খুঁজে পাচ্ছে।

সুশীল সমাজের বাইরে দক্ষিণপন্থী বিশেষত মৌলবাদী দলগুলোর সঙ্গেও সুসম্পর্ক রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। ফলে আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিও এক ধরনের রাজনৈতিক রূপ পেয়েছে এবং র‌্যাপের মতো ব্যক্তিদের এখানে ঘন ঘন সফর করতে হচ্ছে। র‌্যাপকে বলতে হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধ বিচারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল হিসেবে কারও বিচারের পক্ষপাতি নন তারা। বলতে হচ্ছে, তারা মৃত্যুদণ্ডে পক্ষপাতী নন– যদিও ইরাকে সাদ্দামের মৃত্যুদণ্ডের মতো বিভিন্ন ইস্যুতে সাম্প্রতিক সময়েও নিরব থাকতে দেখা গেছে তাদের।

আবার, সুশীল সমাজের সংগঠনগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারের বিভিন্ন পর্যায়ে কার্যত নিরব থাকছে এবং নিরবতার মধ্যে দিয়ে জঙ্গিবাদ-চর্চায় ইন্ধন যোগাচ্ছে। বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার জন্যে সুশীল সমাজ দীর্ঘ কয়েক বছর ধরেই প্রচেষ্টা চালাচ্ছে– কিন্তু এ ধরনের ইস্যুগুলোতে তাদের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান না থাকায় তারা তাদের সম্পর্কে জনগণের সন্দেহ বাড়িয়ে চলেছে।

দুর্নীতি-অনিয়ম-সন্ত্রাস বিষয়ক উদ্ঘাটনের মধ্যে দিয়ে সুশীল সমাজের বিভিন্ন সংগঠন আওয়ামী লীগ বা বিএনপিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারলেও, ঐতিহ্যিক রাজনৈতিক আদর্শিক ক্ষেত্রে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন করপোরেট প্রকল্পের ক্ষেত্রে এসব সংগঠনের কথিত 'নিরপেক্ষ' অবস্থান তাদেরও প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে।

এ রকম পরিস্থিতিতে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এমনকি বাসদ-সিপিবির মতো রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে যে ঐক্য গড়ার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে, তা-ও শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রেরই পক্ষে যাচ্ছে– ফলে সুশীল সমাজের প্রচেষ্টায় বামদের সমর্থন যুক্ত হয়েও কোনো আশার জায়গা তৈরি করতে পারছে না। সরকারবিরোধী স্রোতে দাঁড়ানো বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক দল রাজনৈতিকভাবে নিজেদের জনপ্রিয়তা তৈরির ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধ বিচারের ইস্যু কাজে লাগাতেও ব্যর্থ হচ্ছে।

ইস্যুটি আওয়ামী লীগকে অজনপ্রিয় করে তোলার রাজনৈতিক উপাদান হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে তারা বরং প্রকারান্তরে আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারের প্রক্রিয়া দুর্বল করে তুলেছে। আওয়ামী লীগ সরকার লাভবান হবে, এই ভীতি থেকে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টার ব্যাপারে কার্যত নিরব থেকে তারা আস্থাহীনতার জন্ম দিচ্ছে, জনগণকে আওয়ামী লীগের ওপরেই আরও নির্ভরশীল করে তুলছে।

এর আগে ট্রাইব্যুনালে কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার পর সংক্ষুব্ধ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল। এবার সাঈদীর এ রায় হওয়ার পরও মানুষ সংক্ষুব্ধ। তবে সেই সংক্ষুব্ধতার প্রকাশ ঘটাতে তারা রাস্তায় নেমে আসেনি, বরং নিমজ্জিত হয়েছে নিজস্ব হতাশার গহ্বরে। আবার যারা রাস্তায় নামার খানিকটা চেষ্টা করছে, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে আমরা এর মধ্যেই তাদের হুঁশিয়ারি করতে দেখেছি এই বলে যে, 'ফাঁসির রায় পায়নি বলে রাস্তা আটকাতে পারে না। আদালতের রায় নিয়ে অসন্তোষ থাকলেও সড়ক আটকে বিক্ষোভ করা যাবে না।'

কেউ কেউ খুশি থাকার চেষ্টা করছেন এই ভেবে যে, এ রায়ের ফলে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী যুদ্ধাপরাধী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে; কিন্তু এটি ভাবা হচ্ছে না যে, এ রায় কেন্দ্র করে রায়ের আগে পরে দলগতভাবে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক শক্তিরও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

আশঙ্কার ব্যাপার হল, মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, রাজনৈতিক বোঝাপড়ার কারণে কিংবা মামলার দুর্বলতাজনিত কারণে ট্রাইব্যুনালের কোনো মৃত্যুদণ্ডই শেষ পর্যন্ত টিকতে পারবে না, আর যারা বিভিন্ন সাজা পাচ্ছেন বা পাবেন যে কোনো সময় তারাও রেহাই পাবেন।

এই আশঙ্কার বাস্তব ভিত্তিও রয়েছে। কেননা সংবিধানে রয়েছে একটি ধারা– ৪৯তম ধারা– যে ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পারেন কোনোও আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের দেওয়া যে কোনো দণ্ড ক্ষমা করে দিতে, স্থগিত করতে কিংবা কমিয়ে দিতে। এই ধারার বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক ব্যবহার আমরা এর মধ্যেই দেখেছি। প্রবল প্রতাপশালী সন্ত্রাসীরা এই ধারার কল্যাণে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেয়েছে, পর্যায়ক্রমে তাদের অন্যান্য সাজা থেকেও নিষ্কৃতি পেতে দেখা গেছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার কোনো রাজনৈতিক বিচার নয়, কিন্তু চল্লিশ বছর পর এ বিচার করার উদ্যোগ নেওয়ার সময় বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধীর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-সংশ্লিষ্টতার কারণেই শেষ পর্যন্ত তা একটি রাজনৈতিক আকার পেয়েছে– যুদ্ধাপরাধী সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলো একে চিহ্নিত করতে চাইছে রাজনৈতিক বিচারকাজ হিসেবে। এইভাবে তা একটি রাজনৈতিক রূপ পেয়েছে– এবং তাই ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলে সংবিধানের ৪৯ ধারাকেই যে সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর কাজে লাগানো হবে, তা বলাই বাহুল্য।

সাঈদীর মামলার রায়ে আমরা হতাশ, কিন্তু এই হতাশা আরও তীব্র করে তুলবে ভবিষ্যতে সংবিধানের ৪৯ ধারার অপব্যবহার। কাজেই দ্রুত এ ধারায় এমন পরিবর্তন আনা উচিত, যাতে ভবিষ্যতে এটি অন্তত আন্তর্জাতিক অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হয়।

লেখাই বাহুল্য, এ দাবি কখনওই অভিশংসন-ভীত বিএনপির দাবিনামায় যুক্ত হবে না। যেমন অতীতে যুক্ত হয়নি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি।

ইমতিয়ার শামীম: লেখক, সাংবাদিক।