এক কিশোরীর নষ্ট হওয়া এবং আমাদের সমাজ ব্যবস্থা!!

ম, সাহিদ
Published : 28 Sept 2011, 02:20 AM
Updated : 28 Sept 2011, 02:20 AM

নাম তার নার্গিস ! হ্যা নার্গিস আক্তার তবে বিদ্রোহী কবি নজরুলের সাথে কুমিল্লার দৌলতপুরে দেখা হওয়ার সাথে সাথে কবির প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া সেই নার্গিস নয়। চেহারার দিকে তাকালে নজরুলের প্রেয়সী নার্গিসের থেকে সুন্দরে কোন অংশে কম যায় না। চোখের দিকে তাকালে নয়নের চারিপাশের নক্ষত্রের মত জমে থাকা চকচকে হিরক খন্ডের শিতল চাহিনিতে রয়েছে অনায়েসে মন কেড়ে নেওয়ার অদৃশ্য শক্তি। ঠোট দুটির দিকে নজর দিলেই সদ্য অনাবৃত কমলার আঁশ ছাড়ানো আঁড়াআঁড়ি করে সাজনো পাটি দুটি যেন কোন মৃৎ শিল্পীর হাতের নিপুন কারুকাজ। চেহারার প্রতিটি অংশের আলাদা আলাদা উপমায় সুন্দর বিবরনে সাজাতে গেলে যে কেউ আমাকে হয় পাগল নয়তো হঠাৎ কাব্যিক হয়ে ওঠার অপবাদ দিতে গিয়ে পাঠকরা কি বলে ফেলেন! তাই ভনিতা না করে চলুন মুল প্রসঙ্গে,তবে এক কথায় মেয়েটির দিকে যে কেউ হঠাৎ তাকালেই বলতে বাধ্য অসাধারন,খুব সুন্দর একটি মেয়ে। আর তার বর্তমান কর্ম কাহিনি শুনে আক্ষেপ করে বলতেই হবে এরকম একটি মেয়ে কি করে এত অল্প বয়সে নষ্ট হল। তবে পুরো জীবন কাহিনী শুনলে হয়ত…..

সাংবাদিকতা পেশায় থাকার কারনে স্থানীয় পুলিশ ষ্টেশনের সাথে সম্পর্কের একটি অলিখিত চুক্তি হয়ে গেছে। প্রায়ই থানায় যেতে হয় বিভিন্ন সংবাদের সুত্র ধরে। ঠিক সেই মনোস্কামনা থেকেই ২০ ই সেপ্টেম্বর বিকাল তিনটার দিকে আমাদের স্থানীয় থানায় গেলাম। ঠুকতেই করিডোরে পা দিতেই দৃষ্টি চলে গেলো ডান পাশের পাশাপাশি থানার দুটি সেলের দিকে,নজর যাওয়ার পিছনে আরো একটি কারন ছিল আর তা হল কোন এক মহিলা কন্ঠের কান্নার শব্দ। মহিলা সেলের দিকে তাকাতেই দেখলাম একটি প্রাপ্ত যৈবনা মেয়ে সেলের রড ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। থানার ওসি থেকে শুরু করে প্রতিটি অফিসারের সাথেই রয়েছে আমার ভাল জানা শোনা,এর মধ্যে নিজের নামের সাথে মিল থাকায় এস,আই শহিদুলের সাথে রয়েছে বন্ধুত্বপুর্ন আলাদা একটি সম্পর্ক। আর তাই সরাসরি এস,আই শহিদুলের চেয়ারের সামনে বসতে বসতে জানতে চাইলাম সেলের মেয়েটির কান্নার রহস্য। তিনি জানালেন মেয়েটিকে অনৈতিক কাজের সাথে লিপ্ত থাকার অভিযোগে দুজন দালাল সমেত থানায় নিয়ে আসার কথা। তিনি আরো বললেন একে থানায় এনে আরেক সমস্যা হয়েছে,শুধু কাঁদছে আর এর কান্নার কারনে থানায় তৈরি হয়েছে এক অপ্রীতিকর অবস্থার। দেখতে শুনতে ভাল হওয়ায় ভাল টাকার বিনিময়ে এই এলাকার কিছু প্রভাবশালী মানুষ তাকে অনেক দুর থেকে হায়ার করে এখানে নিয়ে এসেছে,তবে তাদের কাউকেই অভিযানের সময় ধরা যায়নি। দারোগার অনুমতি নিয়ে মেয়েটির সাথে কথা বলতে চাইলে দারোগা অনুমতি দিলে একান্তে প্রায় এক ঘন্টা সেলের সামনে দাড়িয়ে শুনলাম মেয়েটির জীবন কাহিনি। জানলাম আমাদের সমাজে আরো কত কি ঘটে যাচ্ছে আমাদের জানার বাইরে,যা হয়ত আমরা এত সহজে কিংবা খুব স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে নিজের মনের সাথেই করতে হবে যুদ্ধ।

আসুন এই নষ্ট মেয়েটির পরিচয় এবং পরিবার সম্বন্ধে জেনে নিই। এই বাংলাদেশের বৃহত্তর নোয়খালির বেগমগঞ্জ জেলার এক উপজেলার কোন এক পল্লি গ্রামের (এখানে পুরো ঠিকানা জানা সত্বেও দেওয়া হল না) সামসুল ইসলামের মেয়ে নার্গিস,বয়স সবে মাত্র ১৬। আর এই বয়সেই পার্থিব জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাত আর জীবন সম্বন্ধে তার অভিজ্ঞতার ঝুলি পরিপূর্ণ থেকে পরিপূর্ণতার শেষ সিমায় পৌছেছে। পিতা সামসুল ইসলামের সাথে নার্গিসের মা নুরজাহানের বিয়েটা খুব একটা ধুমধাম করে না হলেও আত্মীয় স্বজন আর গ্রামের ময়মুরুব্বিরা ইসলামের শরা-শরিয়তের কোন ঘাটতি যাতে না থাকে সে দিকে যথার্থ নজর দিয়েই হয়েছিল। বিয়ের একটি বছর না ঘুরতেই নুরজাহানের কোল জুড়ে আসে নার্গিস কিন্তু এই অল্প সময়ের ব্যাবধানেই সামসুল ইসলামের আসল চেহারা চিনে নিতে কোন সমস্যাই হয়নি তার। তার স্বামী যে এক আজব পেশায় জীবন চালিয়ে আসছে এটা জেনেও মুখ বন্ধ করে সব সহজ ভাবে মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যান্তর ছিল না নুরজাহানের। স্বামীর ভিটা ছেড়ে বাপের বাড়ি ফিরে যাওয়া কিংবা কারো কাছে কৈফিয়ত দাবী করার আগেই বাবার বাড়ির করুন দুঃসহ অবস্থার চিত্র মনে করে আৎকে ওঠাই এর প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সামসুর জিবনে নুরজাহান তৃতীয় বৌ হিসাবে আসলেও এর আগের দুই স্ত্রী তার অবৈধ ব্যাবসার পার্টনার হয়েই অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসাবে এক রকম বাধ্য মেশিনে পরিনত হয়ে দিন যাপন করে আসছে। আর এই প্রত্যাশায় নুরজাহানকেও চাপ প্রয়োগ করে বিফল হলেও অন্য রকম এক নতুন কৌশলে তার সিদ্ধান্তে অটল রইল সামসু। এরই ধারাবাহিকতায় এলাকায় মেম্বার,ওঠতি যুবনেতা এমনকি কিছু মাতব্বর টাইপের নষ্ট লোক গুলিকে নিয়েই চলতে থাকলো নুরজানকে দিয়ে টাকা উপার্জনের একটি ঘৃন্য ব্যাবসা। আর অভাবের যাতাকলে পৃষ্ট নুরজাহানও একটি সময় সব কিছু মুখ বুঝে স্বাভাবিক ভাবেই সহ্য করতে হল। এ ক্ষেত্রে এলাকার এক তরুন মেম্বার কামাল পাশা নুরজাহানের একান্তই সুখ দুখঃ এবং নিয়মিত কাষ্টমার হিসাবে হয়ে ওঠে অত্যান্ত কছের মানুষ। আর এভাবেই কেটে যায় প্রায় বছর সাত আট। এক সময় ছোট্র শিশু নার্গিসের জীবনে আস্তে আস্তে আসতে থাকে পরিবর্তন ক্রমেই কৈশরের দিকে ধাবিত হতে হতে একটি সময় তার শরিরের ভাঁজে ভাঁজে ফুটে ওঠতে থাকে নারীত্বের ষ্পষ্ট চিহ্ন। আর তখনই সেই লম্পট কামাল পাশার নজর পরে কিশোরি নার্গিসের প্রতি। একটি সময় নার্গিসের কৈশরিক দেহের নরম তুলতুলে পরশ পেতে মারিয়া হয়ে ওঠে মানুষ রুপি সেই হিংশ্র হয়নার সকল গুনাগুন সমৃদ্ধ কামাল পাশা। নুরজাহানকে খুব সহজেই মানিয়ে নিতে খুব একটা বেগ পেতে হল না তার,কারন অনেক ক্ষেত্রেই নুরজান ছিল কামাল পাশার কাছে দায়বদ্ধ। আর যা হবার তাই হল কোন এক কৌশলে নিজ মা হয়ে ওঠলেন নিজের মেয়ের সর্বনাসের প্রধান কারন। আর শুরু হল নার্গিস নামের একটি দুরন্ত কৈশরে বই হাতে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে এক যায়গা হতে অন্য যায়গায় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা নতুন নতুন মানুষরুপি পিচাশ গুলির ভোগের পণ্য।

জীবনের নানা গল্পের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা বর্ননায় ওঠে আসে আমাদের সমাজ ব্যাবস্থার নরবরে ভিতের করুন আর্তনাদ। মেয়েটি এক পর্যায়ে জানালো আমি দেশের বাড়িতে গেলে গ্রামের মানুষ আমাকে বাবা ও মায়ের কৃতকর্মের জন্য আমাকেও সমানভাবে দোষী সাব্যস্থ করতে সামন্যতম দ্বিধাবোধ করে না। পাড়ার মেয়েরো আমার সাথে মিশতে চায় না এমনকি কেউ মিশতে চাইলে তাদের পরিবারের সদস্যরা উল্টো সেই মেয়েটির উপর চরাও হয় আর তাই গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পরিবর্তে নানা যায়গাতে ঘুরে বেড়াতেই বেশী ভাল লাগে। জীবনে বড় রাজনৈতিক ব্যাক্তি হতে শুরু করে সরকারী উচ্চ পর্যায়ের অফিসারও তার বাহুডোরে ধরা খেয়েছে বলেও জানায় সে। দাগ কাটার মত একটি ঘটনা বলতে গিয়ে সেলের রডে ধরে কান্না ভেজা মুখশ্রিতে হঠাৎ দেখা দিল এক টুকরো হাসি। সিলেটের কোন এক বড় হোটেলে এক দালালের সহায়তায় এক রাত্রে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। যথা সময়ে একটি রুমে ঠুকিয়ে দেওয়া হয়,রুমে ঢুকেই দেখি ইয়া বড় দাড়ি ওয়ালা এক হুজুর মত লোক গায়ে হাতাওয়ালা গেঞ্জি ও লুঙ্গি পড়ে বসে আছেন। যাই হোক রাত্রি যাপনের পরদিন সন্ধ্যার দিকে মার্কেটে ঘুরে কিছু কেনাকাটার পর রিকসায় হোটেলে ফেরার পথে দেখি এক যায়গায় বিশাল পেন্ডেলে ওয়াজ চলছে এবং সেই মাহফিলে বক্তৃতা করছেন গত রাতে আমার সাথে একই রুমে কাটানো সেই মাওলানা সাহেব।

কেউ যদি স্বেচ্ছায় যৌন সঙ্গমে মিলিত হয় এবং তা প্রমান হলে বাংলাদেশের দন্ড বিধির ২৯০ ধারা বলে ৫০/= (পঞ্চাশ টাকা)জরিমানা কিংবা অনাদায়ে তিন দিনের বিনাশ্রম কারাদন্ড। দারোগা সাহেব আক্ষেপ করে বললেন,বাংলাদেশে সব কিছুরই দাম বাড়ে কিন্তু ব্রিটিশ আমলের করা এই আইনটিতে জরিমানা কিংবা দন্ডের পরিমান বাড়ে না। আর তাই কখনও এরকম কোন ঘটনার কথা শুনে থানা হতে বের হতে মন চায়না।কারন মাত্র ৫০ টাকা জরিমানা দিয়ে আর যাই হোক তাদের সংশোধন করা সম্ভব নয়। আমাদের চারি পাশে একটু নজর দিলে এমন অনেক নার্গিসের দেখা মিলবে একটু সচেতনতার সাথে যদি তাদের খুজে এনে সমাজে পুনর্বাসন করা যায় হয়ত এই নার্গিসদের জন্ম ভবিষ্যতের জন্য এখনই রোধ করা যেতে পারে। আর এর জন্য প্রয়োজন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন,পরিবর্তন প্রয়োজন সরকারের আইন কানুনেও।