রোকেয়া থেকে যন্ত্রমানবী সোফিয়া: দাসত্ব থেকে মুক্তি কোথায়?

জাহান-ই-গুলশান
Published : 24 Nov 2011, 11:42 PM
Updated : 10 Dec 2017, 06:07 AM

রোকেয়াকে বাংলাদেশের শিক্ষিতরা কম-বেশি চেনেন। যদিও সে চেনাশোনাটা পরিপূর্ণ নয়। বরং অনেক বেশি খণ্ডিত, খর্বিত। কেবল 'মুসলিম নারীজাগরণের অগ্রদুত', 'স্কুলপ্রতিষ্ঠাতা একজন পর্দানশীন ভদ্রমহিলা' হিসেবে সমাজে রোকেয়ার একটা জুতসই ইমেজ তৈরি করা হয়েছে। সে ইমেজ কেন, কার স্বার্থে তা নিয়ে অনেক কথা আছে। আমরা আপাতত সেই আলোচনায় যাচ্ছি না। মোটের ওপর কথা, রোকেয়া আমাদের কাছে পরিচিত।

আর কদিন আগে এ দেশের পত্রপত্রিকা কাঁপিয়ে আরেকটি নাম আমাদের কাছে খুব চেনা হল, সোফিয়া। সে অবশ্য মানুষ নয়। যন্ত্র-মানুষ। তাকে নিয়ে কৌতূহল হল আমাদের। যদিও সবাই জানি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় সোফিয়া কথা বলে। তার স্রষ্টা মানুষ। তবু মানুষ ভিড় করল তাকে দেখতে– হয়তো মানুষ নিজেদের সৃষ্টিকে দেখতে চাইল। তাতে দোষের কিছু নেই। সোফিয়া দেখতে এককালের হলিউডতারকা অড্রে হেপবার্নের মতো। তাকে বাংলাদেশে আনার সময় জামা পরানো হয়েছে। যেন 'যন্ত্র তাতে কী, নারী বলে কথা!'

যন্ত্র সোফিয়াতেই আমরা মুগ্ধ। সোফিয়ার সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা, সে তার নিজের মতো করে চলতে পারে না, তাকে চালানো হয়। অথচ কত স্মার্ট, সুন্দর সে দেখতে!

সোফিয়াকে নিয়ে খবরগুলো দেখতে দেখতে কিছু প্রশ্ন এল মনে– সুবিধাবঞ্চিতদের কথা বাদই দিলাম– এই যে আমি, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা মেয়েরা– আমরা কি নিজেদের মতো পথ চলতে পারছি? নিজের মতো বলে কি কিছু তৈরি হচ্ছে আমাদের? আমরাও কি পুঁজি, পিতৃতন্ত্র আর ধর্মের শৃঙ্খল-সিস্টেমে বাঁধা নই? আমরাও কি তবে একেকজন সোফিয়া? যাদের পুরো জীবনের ওপর তাদের নিজেদের কোনো হাত নেই, তা পুরোটাই অন্যের নিয়ন্ত্রণে?

অথচ ১৮৮০ সালে রংপুরের পায়রাবন্দে জন্ম নেওয়া স্বশিক্ষিত রোকেয়া দাসত্বমুক্ত আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারী দেখতে চেয়েছেন। সেই ১৯০৪ সালে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ 'মতিচুর''স্ত্রীজাতির অবনতি' নামের প্রবন্ধে তিনি এদেশের নারীদের দুর্দশার কারণ হিসেবে দাসত্বকে চিহ্নিত করেন। তিনি জোরের সঙ্গে প্রশ্ন তোলেন,

"এই বিংশ শতাব্দীর সভ্য জগতে আমরা কি? দাসী। পৃথিবী হইতে দাসপ্রথা উঠিয়া গিয়াছে শুনিতে পাই, কিন্তু আমাদের দাসত্ব গিয়াছে কি?"

তিনিই উত্তর দেন,

"না।"

আর এ দাসত্ব যে সৃষ্টির শুরু থেকে ছিল না, রোকেয়া নিজেই ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ভিত্তিতে এর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন:

"আদিমকালের ইতিহাস কেহ জানে না বটে; তবু মনে হয় পুরাকালে যখন সভ্যতা ছিল না, সমাজবন্ধন ছিল না, তখন আমাদের অবস্থা এরূপ ছিল না।"

তিনি মেয়েদের দাসীপনার জন্য তীব্রভাবে কটাক্ষ করেছেন,

"সুতরাং আমরা আলস্যের– প্রকারান্তরে পুরুষের– দাসী হইয়াছি। ক্রমশ আমাদের মন পর্যন্ত দাস (enslaved) হইয়া গিয়াছে এবং আমরা বহুকাল হইতে দাসীপনা করিতে করিতে দাসত্বে অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি। এরূপে আমাদের স্বাবলম্বন, সাহস প্রভৃতি মানসিক উচ্চবৃত্তিগুলি অনুশীলন অভাবে বারবার অঙ্কুরে বিনাশ হ্ওয়ায় এখন আর বোধহয় অঙ্কুরিত্ও হয় না।

আর সে জন্যই পুরুষজাতির নিকট আশ্রিত হ্ওয়া ছাড়া নারীদের যে গত্যন্তর থাকে না। সেই সুযোগে পুরুষজাতিও বলেন যে, তাঁহারা আমাদিগকে বুকের ভিতর বুক পাতিয়া দিয়া ঢাকিয়া রাখিয়াছেন এবং এরূপ সোহাগ আমরা সংসারে পাইব না বলিয়া ভয় প্রদর্শন করিয়া থাকেন। আমরা তাই সোহাগে গলিয়া-ঢলিয়া বহিয়া যাইতেছি। ফলত, তাহারা যে অনুগ্রহ করিতেছেন তাহাতেই আমাদের সর্বনাশ হইতেছে।"

রোকেয়ার মৃত্যুর ৮৭ বছর পরও আমরা মেয়েরা কতজন সচেতনভাবে এই 'সোহাগে গলিয়া-ঢলিয়া বহিবার' জন্য নিজেদের প্রস্তুত না করে থাকছি? কতজন বলছি, 'অনুগ্রহ করে অনুগ্রহ কর না মোদের'?

রোকেয়া মেয়েদের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। স্বাধীনতা বলতে তিনি পুরুষের সমকক্ষতা অর্জনের বিষয়টি বুঝিয়েছিলেন। এজন্য তিনি নারীশিক্ষার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সেকালের বিবেচনায় নারীশিক্ষা নিঃসন্দেহে মেয়েদের অন্তঃপুর থেকে বেরিয়ে আসার প্রথম ধাপ ছিল। তবে একথা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, রোকেয়া কিন্তু 'পাশ করা' বিদ্যাকে প্রকৃত শিক্ষা বলেননি। তিনি দারুণভাবে বস্তুবাদী ছিলেন। যে কারণে রোকেয়ার পক্ষেই বলা সম্ভব–

"সময় সময় আমার পাখী, শাখী হইতে যে সদুপদেশ ও জ্ঞান লাভ করি, তাহা বিদ্যার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। একটি আতার পতন দর্শনে মহাত্মা নিউটন যে জ্ঞান লাভ করিয়াছিলেন, সে জ্ঞান তৎকালীন কোনো পুস্তকে ছিল না।"

আর এ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে রোকেয়ার দর্শনটি কোনো আমদানি করা দর্শনের সঙ্গে মেলানো যায় না। তিনি বরং অনেক বেশি এদেশের মাটির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন। এমনকি সাধারণত বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রে শাসকের সঙ্গে গলাগলির বা তাদের লেজুড়বৃত্তির মধ্য দিয়ে উপাধি নেবার যে ইতিহাস অনেক বিখ্যাত মানুষদের মধ্যে দেখা যায়, রোকেয়া খুব সচেতনভাবে সে পথ্ মাড়াননি। বরং তিনি 'চাষার দুক্ষু' ধারণ করেছেন। 'পাছায় জোটে না ত্যানা' যে চাষীর তার দিকে দেশবাসীকে নজর দিতে বলেছিলেন,

"কেবল কলিকাতাটুকু আমাদের গোটা ভারতবর্ষ নহে এবং মুষ্টিমেয় সৌভাগ্যশালী ধনাঢ্য ব্যক্তি সমস্ত ভারতের অধিবাসী নহে।"

তিনি এন্ডি শিল্পের পুনরুদ্ধারের জন্য্ও কাজ শুরু করেন। সুতরাং রোকেয়া নিজ ভূমিতে দাঁড়িয়েই সমস্যা দেখেছেন এবং সে সবের সমাধানের চেষ্টা করেছেন।

তবু কিন্তু রোকেয়া তাঁর মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে তীব্র সমালোচনার মধ্যে পড়েন। ১৩১২ সালের ভাদ্র সংখ্যায় নবনূরে গ্রন্থ সমালোচনায় আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ ও সৈয়দ এমদাদ আলী 'মতিচুর' গ্রন্থ সম্পর্কে লেখেন,

"'মতিচুর' রচিয়ত্রীর একটি দোষের কথা এ স্থলে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁহার গ্রন্থ মাদ্রাজের Christian Tract Society এর প্রকাশিত Indian Reform সম্বন্ধীয় অুুপ্রাণিত বলিয়াই আমাদের ধারণা।… তাঁহার মতে আমাদের সবই কু আর ইউরোপ আমেরিকার সবই সু। সমাজ সংস্কার করা এক কথা আর সমাজকে চাবুক মারা আর এক কথা। চাবুকের চোটে সমাজদেহে ক্ষত হইতে পারে, কিন্তু তদ্বারা সমাজের কোনো ক্ষতি বা অভাব পূরণ হয় না। 'মতিচুর' রচয়িত্রী কেবল ক্রমাগত সমাজকে চাবকাইতেছেন, ইহাতে যে কোনো সুফল ফলিবে আমরা এমত আশা করিতে পারি না।"

রোকেয়া এসব সমালোচনার জবাব দেন বলিষ্ঠ ভাষায়। 'মতিচুর' এর নিবেদনে তিনি বলেন,

"অপরের ভাব কিংবা ভাষা আয়ত্ত করিতে যে সাহস ও নিপুণতারর প্রয়োজন, তাহা আমার নাই। সুতরাং অদৃশ্য চেষ্টা আমার পক্ষে অসম্ভব।

আমিও কোনো ঊর্দু মাসিক পত্রিকায় কতিপয় প্রবন্ধ দেখিয়া চমৎকৃত হইয়াছি। উক্ত প্রবন্ধাবলীর অনেক অংশ 'মতিচুর' এর অবিকল অনুবাদ বলিয়া ভ্রম জন্মে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, সে প্রবন্ধসমূহের লেখিকাগণ বঙ্গভাষায় অনভিজ্ঞা।

ইংরাজ মহিলা মেরী করেলির 'ডেলিশিয়া হত্যা' উপন্যাসখানি 'মতিচুর' রচনার পূর্ব্বে আমার দৃষ্টিগোচর হয় নাই, অথচ তাহার অংশবিশেষের ভাবের সহিত 'মতিচুর'এর ভাবের ঐক্য দেখা যায়।

এখন প্রশ্ন হইতে পারে কেন এরূপ হয়? বঙ্গদেশ, পাঞ্জাব, ডেকান (হায়দারাবাদ), বোম্বাই, ইংল্যান্ড– সর্ব্বত্র হইতেই একই ভাবের উচ্ছ্বাস উত্থিত হয় কেন? তদুত্তরে বলা যাইতে পারে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবলবৃন্দের আধ্যাত্মিক একতা।"

নানা প্রতিকূলতায় রোকেয়া নিজ লক্ষ্যে অনড় অটল ছিলেন। তিনি কেবল তাঁর সাহিত্যে নারীস্বাধীনতার ছবি আঁকেননি, ব্যক্তিগত জীবনেও সে চর্চা করেছেন। মরিয়ম রশীদকে লেখা রোকেয়ার একটি চিঠি সে সাাক্ষ্য দেয়। চিঠিতে মরিয়মকে একা বাসায় থাকা প্রসঙ্গে তিনি লেখেন,

"সেলিমসহ পৃথক বাসায় থাকতে পারবে না কেন? আমি তো একাই ২২ বৎসর ধরে আছি– তা তুমি বলবে যে তুমি বুড়া মানুষ। কিন্তু ২২ বছর পূর্বে তো বুড়া ছিলুম না। ফল কথা, তুমি ভালো করে চিন্তা করে দেখ। এখন এই উন্নতির যুগে তুমি একটা আলাদা বাসায় থাকতে সাহস না করলে চলবে কেন? আজও কি আমরা মেয়েদের এমন নির্ভীক হতে সাহস দিতে পারি?"

একটি ঔপনেবেশিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক সমাজ কাঠামোতে থেকেও রোকেয়া যে সাহস নিয়ে কঠোর ভাষায় 'ধর্মের দোহাই দিয়া নারীকে পুরুষের অধস্তন রাখার' কথা বলেছেন বা 'ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধি-বিধান ব্যতীত অন্য কিছু নহে' বলে তা প্রমাণের প্রয়াস পেয়েছেন, আজকের দিনে আমরা রোকেয়ার সেই মত কতখানি ছড়িয়ে দিতে পারছি? ২০১৮ তে পা দিতে গিয়ে আমরা যে উন্নয়নের কথা বলছি, দূরদর্শী রোকেয়া তো বহু আগেই নারীকে সমাজের অংশ হিসেবে দেখে তাকে এগিয়ে নিতে বলেছেন। নয়তো এক পা নিয়ে সমাজ বেশিদূর এগুতে পারবে না।

আজকের দিনে নারীর অগ্রগতি মানে পাহাড়ে, হাওড়ে, সমতলে, গার্মেন্টেসে, ইটভাটায়, বাসাবাড়িতে ছড়িয়ে থাকা নারীকে যুক্ত করার কথা ভাবতে হবে। নয়তো 'পাশ করা বিদ্যে' নিয়ে উচ্চশিক্ষিত নারীরা আমরা কর্পোরেট বা মাল্টিন্যাশনাল স্মার্টনেস রপ্ত করব, আরও বেশি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হব, পণ্য করব নিজেকে অথবা ধর্মের কিংবা পিতৃতান্ত্রিক প্রথা-প্রতিষ্ঠানের কাছে মুক্তির তরিকা খুঁজব। যা আসলে মুক্তির সোপান নয়।

সোফিয়ার মতো চাবি দেওয়া যন্ত্র হিসেবে নয়, বরং রোকেয়ার মতো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন লড়াকু মানুষ হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার দীক্ষাটা আজ নেওয়া বড় প্রয়োজন।