সাবধান: অনলাইনেও এমএলএম প্রতারনার ডিজিটাল ফাঁদ!

ম, সাহিদ
Published : 11 April 2012, 11:00 AM
Updated : 11 April 2012, 11:00 AM

আজ থেকে প্রায় দুই মাস আগে ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১২ ইং "স্বপ্নের ফেরিওয়ালা মলম বেপারিদের না জানা কথা" শিরোনামে এমএলএম ব্যবসা নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম।তারপর ঘটে গেল অনেক কিছুই আর এ ব্যবসা নিয়ে পত্রিকা,ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়তো আছেই সাথে ব্লগ এবং ফেইসবুকে চলছে নানান গরম আলোচনা। তাই এ বিষয় নিয়ে আর কিছু লিখছি না তবে এরই মত আর এক প্রতারনার ডিজিটাল ফাঁদ নিয়ে আজ কিছু লিখছি।

উম্মে সালমা মিতা কোটবাড়িস্থ কুমিল্লা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের কম্পিউটার বিভাগের শেষ বর্ষের একজন ছাত্রী। বাড়িতে বসে আউটসোসিংয়ের কাজ করতে চান। এক বন্ধুর কাছ থেকে একটি পিটিসি (পেইড টু ক্লিক) সাইটের নাম জানতে পারেন। জানতে পারেন, সেখানে একাউন্ট খুললে তার একাউন্টে বেশ কিছু বিজ্ঞাপন আসবে। সেগুলেতে ক্লিক করলেই তার একাউন্টে অর্থ জমা হতে থাকবে। একাউন্ট খুলতে কোন অর্থের প্রয়োজন পড়বে না। উম্মে সালমা মিতা অতি উৎসাহী হয়ে একাউন্ট খুললেন এবং দিনরাত বিজ্ঞাপনে ক্লিক করতে থাকলেন। মাস শেষে তিনি তার একাউন্টে দেখলেন ৩০ ডলার জমা হয়েছে। তিনি অর্থ তোলার প্রক্রিয়া শুরু করতে চাইলেন। কিন্তু ওয়েবসাইটটি থেকে জানিয়ে দেয়া হলো, তার একাউন্ট মেয়াদোর্ত্তীন হয়ে গেছে। তাই তিনি কোন অর্থ পাবেন না। তাকে আবারও নতুন করে পরর্বতী মাসের জন্য শুরু করতে হবে। একমাসের সময় ও শ্রম দুটো খরচ করেও প্রতারিত হলেন উম্মে সালমা মিতা।

এভাবে পিটিসি সাইটগুলো অনলাইনে চটকদার প্রচারনা ও প্রতারনা আশ্রয় নিয়ে আয় করছে লাখ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে পিটিসি সাইট নির্মাতা বিজ্ঞাপন ও সাইট ভিজিটর দেখিয়ে গুগল এর অ্যাডড্রেস থেকে আয় করছে। পিটিসির সাইট গুলোতে কাজ করতে হলে একাউন্ট খুলতে হয়। একাউন্ট খুলতেই দাবি করা হয় পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। একাউন্ট খুলার পর নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে দিনের হিসেবে দেয়া হয় বিজ্ঞাপন। সে বিজ্ঞাপন গুলোতে ক্লিক করা হলে সাইটটির পক্ষ থেকে লোভনীয় অর্থের প্রস্তাব দেয়া হয়। পাশাপাশি এই সাইটটিতে নতুন কারও নিবন্ধন করিয়ে দিলে নির্দিষ্ট কমিশন দেয়ার কথাও বলা হয়। অনেক ক্ষেত্রে বলা হয়, যত বেশী জনকে নিবন্ধন করাতে পারবে তাদের সবার কাছ থেকে তত বেশী কমিশন একাউন্টে জমা হবে। এভাবেই পিটিসি সাইটসহ বিভিন্ন মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম পদ্ধতিতে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকরা।

পিটিসি সাইটগুলো প্রচারনায় ব্যবহার করা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটে ফেইসবুক, টুইটার, বিভিন্ন ব্লগ ও ফোরাম সাইটগুলো। অনেক ক্ষেত্রে লোভনীয় অর্থের বা আউটসোসিংয়ের লোভ দেখিয়ে বিভিন্ন লিংকে ক্লিক করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। ঢাকা, রাজশাহী, কুমিল্লা, সিলেট চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখন অনলাইন এমএলএম প্রতারনার ফাঁদ পাতা। প্রতারনা করছে এমন অভিযোগ উঠেছে ডোল্যান্সার, অনলাইন অ্যাড ক্লিক, বিডিএস ক্লিক সেন্টার, অনলাইন টু ওর্য়াক, বিডি অ্যাড ক্লিক, পেইড টু ক্লিক, স্কাইল্যাঞ্চার, পিটিসি ফর বিডি, অ্যাড সোসিং, ডো ল্যান্সার ক্লিক ও টু পেইড সহ আরো বেশ কিছু সাইটের বিরুদ্ধে। এই ওয়েবসাইট গুলো দেশের বিভিন্ন স্থানে অনলাইন এমএলএম ব্যবসা নিয়ে বিভিন্ন প্রচারনা চালাচ্ছে। এসব সাইটগুলোর রেফারেন্স বিভিন্ন বন্ধু বা অনলাইন লিংক থেকে পেয়ে অনেকেই প্রথমে উৎসাহী হচ্ছেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই অর্থ না পেয়ে সাইটগুলোর ব্যবহার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এই ক্ষেত্রে লগ্নি করা অর্থ ও শ্রম দুটোই বৃথা যাচ্ছে। আর প্রতারনার ফাঁদ ফেলে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে সাইটগুলো। অনেক ক্ষেত্রে বিনামূল্যে একাউন্ট খুলেও প্রতারিত হয়েছেন অনেকেই।

কম সময় ও পরিশ্রমে বেশী অর্থের লোভ দেখিয়ে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) এখন অনলাইনেও প্রতারনার ফাঁদ পেতে বসেছেন। "মেক মিলিয়নস নাউ, নো ম্যানেজার" বা "ওয়ার্ক ইওয়োর ওউন স্টার্ট ১৫ হাজার ডলার পার উইক"-এ রকম অনেক চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট বা বিভিন্ন ওয়েবসাইটে দেয়া হচ্ছে। আবার এমএলএম সম্পকৃত মেইলও বিভিন্ন উৎস থেকে ইনবক্সেও এসে জমা হচ্ছে। অনেক সময় পরিচিত কারোও উপদেশ বা পরামর্শেও এমএলএম ব্যবসা করে এমন ওয়েবসাইটে একাউন্ট খুলছেন অনেকে। কিন্তু প্রতারক চক্রের প্রতারনার শিকার হচ্ছেন নতুনরা।

অনলাইন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনলাইন এমএলএম প্রতিষ্ঠান গুলো প্রতারনা করছে। কারণ, এমএলএম প্রোগাম চালুর পর শতকরা ৯৮ শতাংশ দ্রুতই ঝড়ে পড়ে অর্থাৎ প্রোগামটি আর চালিয়ে যেতে চায়না। তারা দ্রুত সেখান থেকে অর্থ তুলে নিতে চায়। অথাৎ মাত্র দুই শতাংশ প্রোগামটি চালিয়ে যায়। এই দুই শতাংশ ধারণা করেন, অনলাইন এমএলএম করে তারা শিগগিরই হয়ত লভ্যাংশ পাবে। কিন্তু র্দীঘ সময় ধরে তারা অর্থের মুখ না দেখে হতাশ হয়ে পড়ে এবং প্রোগামটি ছেড়ে দেয়। তখন প্রতিষ্ঠানটি প্রতারনায় আশ্রয় নেয়। কারণ, প্রতিষ্ঠানটি আগে ভাগেই তাদের প্রোগামটির সফলতা ব্যাপারে নিশ্চিত থাকে। এমএলএম প্রতারনার আরেকটি কারণ হচ্ছে, সে কোন উপায়ে দ্রুত অর্থ পেতে চাওয়ার বিষয়টি। প্রোগামটির প্রথম ব্যাক্তি তার পরে যারা শুরু করে তাদের সবাইকেই প্রতারিত করে দ্রুত অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।

মাল্টিলেভেল মার্কেটিং ব্যবসার মাধ্যমে সাধারনত ছোট প্রতিষ্ঠান গুলো তাদের পন্য বিক্রি করে ও গ্রাহক বাড়ায়। যারা এ কাজের সঙ্গে জড়িত থাকে তারা অল্প পরিমান লভ্যাংশ পায়। তাদের উদ্দেশ্য পন্যটি জনপ্রিয় করে তোলার, যাতে ব্যবসার প্রসার ঘটে। কিন্তু বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে এমএলএম প্রতিষ্ঠান গুলো পন্য বিক্রি নিয়ে বসে নেই। তাদের লক্ষ্য নতুন গ্রাহককে তাদের প্রোগামের সাথে যুক্ত করা ও তাকে তাদের পন্য কিনতে বাধ্য করা ও পন্যটি অন্যের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য করা। আর পুরো প্রোগামটি নির্মাতা সবার কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে প্রোগামটি বন্ধ করে দেয়।

অনলাইনে যেসব এমএলএম পন্য বিক্রি করা হয় সেগুলোর দাম বাস্তবে সে পন্যটির দামের তুলনায় অবিশ্বাস কম বলা হয়। পাশাপাশি অনলাইনে এমএলএম প্রচারনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রের সেলিব্রেটি বা তারকাদের নাম ব্যবহার করা হয়। এমএলএমের প্রচারনায় বিজ্ঞাপন হিসেবে বিভিন্ন তারকার নাম ব্যবহার করে বলা হয়, তিনি এমএলএমে যোগ দিয়েছেন এবং প্রচুর আয় করেছেন। এমনকি এমন কাউকে উদাহরন হিসেবে টেনে এনে বলা হয়, যে তিনি সফল হয়েছেন। এমন চটকদার বিজ্ঞাপনের সংঙ্গে আদতে ঐই তারকার বা ব্যাক্তির কোন সংশ্লিষ্টতা থাকে না। এমএলএম প্রোগামে যুক্ত হওয়ার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয় যে তাকে পরর্বতী সময় প্রোগাম বিক্রির জন্য কাজ করতে হবে। তবে, এ প্রোগ্রামে যুক্ত হতে হলে আগে কিনতে হবে এমএলএম প্রতিষ্ঠানের কোনো প্রোগাম। তাই অনলাইন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা প্রতারনা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রোগামটির যদি কোন অর্থ মূল্য না থাকে এবং তার জন্য যদি অর্থ পরিশোধ করতে বলা হয় তবে সেটি প্রতারনা। যদি কোন বিজ্ঞাপনের জন্য অর্থ পরিশোধ করা হয়, তবে তা প্রতারনা ছাড়া আর কিছু নয়। অনেক ক্ষেত্রে নমুনা বা স্যাম্পল বিজ্ঞাপন দেখতেও অর্থ দাবি করে অনেক সাইট। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, একটি প্রতিষ্ঠান তাদের পন্য বিক্রি করবে, কিন্তু তার পন্যের বিজ্ঞাপন কেনার জন্য আগে অর্থ ছাড় করতে বলবে? যদি কোন প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন কেনার জন্য অর্থ দাবি করে বা তাদের বিজ্ঞাপনি প্রচারনার জন্য অর্থ দাবি করে, তবে তারা নিশ্চিত প্রতারনা করছে।

এমএলএম প্রতিষ্ঠানটির দাবি থাকে, তাদের অবশ্যই ডিস্টিবিউটরকে বিশ্বাস করতে হবে। আর এ শর্তটিই তাদের প্রতারনার হাতিয়ার। বিষেশজ্ঞরা বলেন, যদি দুই শতাংশও বিশ্বাস করে এবং প্রোগাম বিক্রি করতে শুরু করে ও অন্যদের একাজে উৎসাহ দেয় তবে সেটা এমএলএম কোম্পানীর জন্য বিশাল সাফল্য। কিন্তু ৯৮ শতাংশ এই সাইটি থেকে সরে যাওয়ার দরুন এই দুই শতাংশ কখনো সফলতা পায় না। তারাও প্রতারনার শিকার হয়। যদি কেউ সফল হওয়ার দাবি করে, সে ক্ষেত্রে অন্যদের সঙ্গে প্রতারনা করে তার সাফল্য এসেছে এটা মানতেই হবে।

আউটসোসিংয়ের সঙ্গে অনলাইনে এমএলএম এর পার্থক্য রয়েছে। তাই অনলাইন এমএলএম সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে তবেই সেখানে বিনিয়োগ করার ভাবনা ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে সচেতনতাই সবার আগে জরুরী। অনলাইনে এমএলএম প্রতারনার ফাঁদ করাতে সচেতন হন ও প্রতিষ্ঠানটি সর্ম্পকে তথ্য জেনে সেখানে কাজ করার কথা ভাবুন।

সহযোগিতায়-
স্থানীয় সাংবাদিক বন্ধু শরিফুল আলম (ভোরের কাগজ)
বিশেষ ধন্যবাদ মিতুকে।
ছবি-ইন্টারনেটের কল্যানে।