পলিসিমেকার’স জার্নাল: ফ্রম নিউ দিল্লি টু ওয়াশিংটন ডিসি

লীনা দিলরুবালীনা দিলরুবা
Published : 2 Sept 2021, 05:38 PM
Updated : 2 Sept 2021, 05:38 PM


ভারত সরকারের পদ্মভূষণ পুরস্কারে ভূষিত অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর (১৯৫২) জন্ম ভারতের কলকাতায়। লেখাপড়া করেছেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল, দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ এবং লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স-এ। তিনি অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের তত্ত্বাবধানে লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ ও ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের কার্ল মার্ক্স অধ্যাপক কৌশিক বসু ২০০৯-২০১২ মেয়াদে ভারতের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এবং ২০১২-২০১৬ মেয়াদে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদের দায়িত্ব পালন করেন। কৌশিক বসুর জীবন কেটেছে উন্নয়নের নীতি নির্ধারণের কাজে। তাঁর পিতা কেশবচন্দ্র বসু ছিলেন কলকাতার মেয়র, পরে রাজ্যস্তরের নির্বাচনে জিতে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার স্পিকার হয়েছিলেন।

তিনি কেন অর্থনীতিবিদ হতে চেয়েছিলেন? অন্য অনেক অর্থনীতিবিদ যেমন বলেন, পৃৃথিবীর মানুষকে সাহায্য করার ইচ্ছে থেকেই তাঁরা অর্থনীতিবিদ হয়েছেন, কৌশিক বসু সে দাবি করেন না, 'আমি অর্থনীতিবিদ হয়েছি কারণ আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের ধাঁধাগুলো আমাকে বিমোহিত করে'। মার্ক্সের অনুরাগী এই অর্থনীতিবিদ কার্ল মার্ক্স-এর অর্থনৈতিক চিন্তাকে গ্রহণ করতে না পারলেও তাঁর দার্শনিক প্রতীতিকে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি সাম্যের দুনিয়ার স্বপ্ন দেখেন, একই সঙ্গে প্রত্যাশা করেন সেই দুনিয়ায় পৌঁছানোর বাস্তবসম্মত উপায়ও তৈরি হোক। রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী এবং নেহেরুর ভক্ত এই বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ছবি আঁকা, ভ্রমণ, এবং দর্শনশাস্ত্রে সমান আগ্রহী। তিনি হিউম, বার্টান্ড্র রাসেল, অমর্ত্য সেন, কেনেথ অ্যারোর দর্শন দ্বারা প্রভাবিত একজন সংশয়বাদী মানুষ, যিনি রাসেলের কাছ থেকে শিখেছিলেন: সব কিছুকেই প্রশ্ন করা যায়, করা উচিত। প্রশ্নের ঊর্ধ্বে কিছু নেই। হিউমের সংশয়বাদ তাঁকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে।

ভারত এবং বিশ্বব্যাংকে দুটো গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রাচীন প্রকাশনা সংস্থা সাইমন অ্যান্ড শুস্টার থেকে সম্প্রতি 'পলিসিমেকার'স জার্নাল: ফ্রম নিউ দিল্লি টু ওয়াশিংটন ডিসি' শিরোনামে কৌশিক বসু যে গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন এতে সে-সময়কার তাঁর জার্নালগুলো প্রকাশ পেয়েছে, যা ডায়েরির মতো করে লেখা হয়েছিল। বইটি মূলত ডায়েরিই, ভূমিকায় কৌশিক বসু বলেছেন বিভিন্ন টীকা, এলোমেলো শব্দমালা, কিছু ঘটে যাওয়া ঘটনা যেগুলো নীতি প্রণয়নে তাঁর সাত বছরের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার নির্যাস। ডায়েরিটি তিনি খুব পরিকল্পিতভাবে লেখেননি, লিখেছেন পরবর্তী পর্যায়ে পাতা উল্টিয়ে দেখার জন্য আর তাঁর নাতি-নাতনিদের জন্য, তারা যদি পড়ে। এটা যে বই হবে এই পরিকল্পনা তিনি পরবর্তীতে যখন বাস্তবায়ন করবেন বলে ভেবেছেন তখনও এটিকে ডায়েরির মতো করেই লিখেছিলেন। বইটির ভাষা খুবই প্রাঞ্জল। গম্ভীর ভঙ্গী এড়িয়ে কৌশিক বসু যেভাবে তাঁর ভারসাম্যপূর্ণ সহজ হাস্যরসাশ্রয়ী অথচ শাণিত বক্তব্যগুলো বইতে উপস্থাপন করেছেন সেটি পাঠককে নির্জলা আনন্দ উপভোগের সুযোগ করে দিয়েছে। তিনি যেন আতিশয্যকে প্রশ্রয় দিতে চান না, তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের এবং তৃপ্তির জায়গা আড়ম্বরপূর্ণ উপমা এড়িয়ে ভাষার ব্যবহার। কিছু কিছু বিষয়ের প্রতি তাঁর বিরূপ মনোভাব কোথাও কোথাও স্পষ্ট হলে উঠলেও বিদগ্ধ শব্দের খেলায় তিনি যেভাবে রাষ্ট্রব্যবস্থা, বিভিন্ন তত্ত্ব, পারস্পরিক বিরোধিতা এবং প্রতিদ্বন্দি¦তার মত বিষয়কে রসাত্মকভাবে উপস্থাপিত করেছেন সেটি প্রশংসার দাবি রাখে।

ভারতের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পেয়ে কর্নেল ইউনির্ভাসিটি থেকে ছুটি নিয়ে ভারতে আসার আগে তাঁর প্রাথমিক উপলব্ধি ছিল, তিনি যাচ্ছেন একটি ভালো সমাজ এবং ভালো অর্থনীতি গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে। একই সঙ্গে তিনি ভাবছিলেন, এসব অঙ্গীকার পালনে তিনি যে কোনো দেশেই কাজ করতে পারতেন, কিন্তু ভারতের মতো একটি দেশ যেখানে বিপুল দরিদ্র লোকের বাস এবং এখানেই প্রোথিত রয়েছে তাঁর শেকড়, বলাইবাহুল্য এই দেশটির সঙ্গে তাঁর সহজাত বোঝাপড়াও রয়েছে, সব মিলিয়ে তাঁর উপলব্ধি হয়েছিল এই দেশেই তিনি নিজেকে সবচেয়ে ফলপ্রসূভাবে ব্যবহার করতে পারবেন।

সচিব পদমর্যাদার সমতুল্য প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টার (সিইএ) মূল কাজ ভারত সরকারকে বাণিজ্য ও অর্থনীতি সম্পর্কিত বিষয়ে পরামর্শ দেয়া। প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সরাসরি অর্থমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট করেন। কৌশিক বসু যখন এই পদে যোগ দেন তখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন প্রণব মুখার্জি। শিক্ষক থেকে একজন পাবলিক ফিগারে পরিণত হওয়া কৌশিক বসু কাজে যোগ দিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সমস্ত ধরনের যোগাযোগে বেশ স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি প্রণব মুখার্জির একটি উপদেশকে শিরোধার্য করে নিয়েছিলেন, 'একবার যখন আপনি বিখ্যাত কেউ হয়ে যাবেন, অনেক সমালোচনা শুনতে হবে, এমনকি কিছু নীচ, বোধবুদ্ধিহীন আক্রমণেরও শিকার হতে হবে। এক্ষেত্রে যে কৌশলটা নিতে হবে তা হলো এ ধরনের তথ্য এক কান দিয়ে গ্রহণ করা, দ্রুত সেটিকে প্রক্রিয়াকরণ করা এবং চটজলদি অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়া।'

ভারতের মতো বিপুল জনগোষ্ঠীর একটি দেশে যেখানে অর্থনীতির নানা সূচকের অবস্থা বেশ নাজুক সেখানে প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টার উত্তপ্ত চেয়ারে বসে মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনে ধরাসহ নানান বিষয় তাঁকে কতটা চিন্তিত করে তুলেছিল এই বাক্যটিতে সেটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে– 'অর্থনীতি যখন ভালো চলে তখন আপনি বলেন যে এটি আমাদের নীতিসংক্রান্ত উদ্যোগের ফল। আবার অর্থনীতি যখন ঠিকভাবে চলে না তখন বলতে থাকেন যে দুনিয়ার অন্যান্য জায়গায় যা ঘটছে, এটি তারই পরিণতি।'

সময়-সময় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠক করে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রণকৌশল কি হতে পারে সে বিষয়ে তিনি বেশ ব্যস্ত সময়ই কাটিয়েছেন। সরকারের অংশ হিসেবে নিজের ব্যক্তিগত দর্শন এবং কর্মপদ্ধতি নিয়ে কৌশিক বসু জানান, 'সরকারে থাকার প্রথম কয়েক মাস আবিষ্কার করলাম যে, নানা পরিস্থিতিকে আমি এক ধরনের স্থৈর্যের সঙ্গে সামলাতে পারি। এরকম মানসিক সক্ষমতা পাওয়াটাকে আমি ভাগ্যের ব্যাপার বলে মনে করি। অন্য অনেকের মতো আমাকে নিরুদ্বিগ্ন থাকার ভান করতে হয় না। মনের গভীরে আমি জানি যে শেষ বিচারে জীবনটা হচ্ছে অর্থহীন এক প্রহেলিকা। এর বাইরে অন্য কিছুর অস্তিত্ব আছে বলেও আমি নিশ্চিত নই। পৃথিবী যদি জটিল হয় সেক্ষেত্রে অস্তিত্বহীন একটি পৃথিবীর জটিল ছবিটি সৃষ্টি করার জন্য আমার মনও যথেষ্ট জটিল হতে পারে। অবশ্যই বাদবাকি সবার মতোই জীবনযাপন করি আমি। মানুষের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ ও মেলামেশাও উপভোগই করি। কিন্তু জীবন অলীক কল্পনা ছাড়া কিছু নয়–বুকের গভীরে থাকা এই উপলব্ধিই আমাকে নিরুদ্বিগ্ন রাখে। সত্যি বলতে কী, এই অনুভূতিটার কারণেই অন্য অনেকের চেয়ে জীবন উপভোগের সুযোগটা আমি বেশি পাই।'

বিভিন্ন সেমিনারে বক্তব্য প্রদান করা এবং রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে বৈঠক ছিল তাঁর নিয়মিত কর্মসূচির অংশ। এই অভিজ্ঞতাগুলোর কখনো সরস এবং কখনো প্রাজ্ঞ বর্ণনা বইটিকে প্রাঞ্জল করে তুলেছে। ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি এবং ফোর্বস-এর দৃষ্টিতে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের একজন মুকেশ আম্বানির সঙ্গে কৌশিক বসুর সাক্ষাতের বিষয়টি উল্লেখ করার মতো। সরকারি তরফে আলোচনার সুযোগ পেলে ব্যবসায়ীরা সাধারণত নিজের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার দিকেই বেশি মনোযোগী থাকেন। ব্যতিক্রমী চরিত্র মুকেশ আম্বানির সঙ্গে একবার রাত সোয়া বারোটা থেকে পৌনে একটা পর্যন্ত জমিয়ে গল্প করেন কৌশিক বসু। তাঁদের গল্পের বেশিরভাগ জুড়ে থাকলো ভারতের উচ্চশিক্ষার হাল অবস্থা। বিষয়টি কৌশিক বসুকে খুশি করেছিল যে, মুকেশ আম্বানি কর কমানোর জন্য প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টাকে অনুরোধ করলেন না, যেটি অনেক ব্যবসায়ীই করে থাকেন।

বিভিন্ন বৈঠকে ভারতের কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আলাপ-আলোচনা করার অভিজ্ঞতাগুলোকে কৌশিক বসু গুরুত্বের সঙ্গে দেখতেন। এই বৈঠকগুলোতে থাকত ভিন্ন সংস্কৃতি, কথার স্বরাঘাত, এবং ভাষার মেলবন্ধন। একটি বৈঠক এর কথা তিনি উল্লেখ করেন যেখানে উত্তরাঞ্চলের প্রধানমন্ত্রী কথা বলছিলেন হিন্দিতে, পাঞ্জাব, বাংলা এবং বেশিরভাগ রাজ্যের প্রতিনিধিরা কথা বলছিলেন ইংরেজিতে, পন্ডিচেরির প্রতিনিধি কথা বলছিলেন তামিল ভাষায়। কৌশিক বসু জানান, কয়েকজন চিফ মিনিস্টার যে ভাষায় কথা বলছিলেন সেটি ঠিক কোন ভাষা এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন।

বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন পুরো বইতে নানানভাবে আলোচনায় এসেছেন। অমর্ত্য সেনকে কৌশিক বসু আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ চিন্তকদের একজন বলে মনে করেন, এ প্রসঙ্গে তিনি প্রশ্ন রাখেন–অমর্ত্যকে কি আমরা রুশোর মতো একই বেদিতে রাখতে পারি? এরপর কথাটার একটি ব্যাখ্যা হাজির করেন কৌশিক বসু। তিনি বলেন, অমর্ত্য সেন হয়তো আগামি কয়েকশো বছরে সে জায়গাটায় উপনীত হবেন। বস্তুত এ ভাবনাটি তাঁর মনে বাসা বাঁধে জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পর দার্শনিকদের মূল্যায়ন করার প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গিয়ে। তিনি বলেন, যদি এটি সত্যি হয় যে কালের পরিক্রমায় অমর্ত্য সেন রুশোর অবস্থানে উন্নীত হবেন তাহলে এ প্রশ্নটিও জাগে, আমাদের মধ্যে কি বুদ্ধিজীবীদের জীবদ্দশায় তাঁদের অনুধাবন করার নাকি তাঁদের মৃত্যুর পর তাঁদের অতিমূল্যায়নের প্রবণতা আছে?

এছাড়াও অমর্ত্য সেনকে নিয়ে ডায়েরির একদিনের ভুক্তির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হবে, সেদিন একটি সম্মেলনে যোগ দিতে বেশ সকালে কৌশিক বসু গালফ এয়ারে করে বাহরাইন হয়ে আম্মান যাওয়ার উদ্দেশে দিল্লি ত্যাগ করেন। সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল জর্ডানে, এইচডিসিএ সম্মেলন। এইচডিসিএ'র মানে হচ্ছে হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ক্যাপাবিলিটিস অ্যাসোসিয়েশন। এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন অমর্ত্য সেন, মার্থা নুসবাম-এর সহযোগিতায় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটি বস্তুত গবেষকদের একটি গ্রুপ যাঁরা সক্ষমতার ওপর গবেষণা করেন। কৌশিক বসু জানান এঁদের মধ্যে এমন কেউ কেউ ছিলেন, যাঁরা এ কৌশলের প্রতি অনেকটা গুপ্তসংঘের মতো আনুগত্য পোষণ করেন। তাঁদের কথা শুনলে তাঁর মতো লোক যারা এগুলোকে নতুন পথের সন্ধানদানকারী কোনো ধারণা বলে মনে করে না, তাঁদের মনে হতে পারে যে, এ মানুষগুলোর মধ্যে এক ধরনের প্রশ্নহীন পরিপূর্ণ আত্মনিবেদন রয়েছে। এ সংগঠনটি নিয়ে লেখকের মনোভাব এমন যে, তিনি যেন একটি ধর্মের জন্মপ্রক্রিয়া দেখছেন। তিনি ধারণা করেন, নিশ্চয়ই এভাবেই নতুন ধর্মের জন্ম হয়। কোনো একটা ধারণা থেকে এর শুরু হয়, যেটি ব্যতিক্রমী ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি প্রচার করেন। তবে এরপর সবই ভাগ্যের ব্যাপার। এরপর অনেক মানুষ একসঙ্গে একই ধরনের আচরণ করতে থাকে, কোনো কোনো শিষ্যের মধ্যে দেখা দেয় ধর্মপ্রচারকের মতো উৎসাহ। কৌশিক বসু লেখেন–এরপর দুশো বছর পর আমরা একটি 'সেন ধর্মে'র মতো জিনিস পাই। বিষয়টি নিয়ে নিজের বিস্ময় বজায় রেখে কৌশিক বসু লেখেন, 'ভাবতে অবাক লাগে, অমর্ত্য সেন, যিনি যুক্তি মেনে চলেন, যিনি নাস্তিক এবং গুপ্তসংঘের ধারণার বিরুদ্ধে, তাঁর কেমন লাগবে যদি তিনি বুঝতে পারেন যে, ভবিষ্যতের একটি ধর্মের প্রধান পুরুষের মতো কিছু একটা হতে চলেছেন তিনি। আমার অনুমান হচ্ছে, নিজের নামে কোনো একটা ধর্মের নাম হওয়াটা এতই রোমাঞ্চকর ব্যাপার যে তিনি যদি এতে ইন্ধন না-ও জোগান, অন্তত সক্রিয়ভাবে এর পথে বিরোধিতাও করবেন না।'

ভারতের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টার মর্যাদাপূর্ণ কাজটি ছিল চুক্তিভিত্তিক। চুক্তির তিন বছর মেয়াদ শেষে দিল্লির ব্যস্ত জীবন কাটিয়ে কৌশিক বসু পাড়ি জমালেন আমেরিকায়, ফিরে যাবেন তাঁর পুরনো পেশা শিক্ষকতায়। এ-সময়ই তিনি প্রস্তাব পেলেন বিশ্বব্যাংক থেকে। পদটা ভীষণ আকর্ষণীয়, বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদের পদ। ২০১২ সালের ১ অক্টোবর কৌশিক বসু বিশ্বব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে যোগদান করেন। শুরু হয় তাঁর জীবনের নতুন এক অধ্যায়ের।


বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করার সময়টুকুর কথা বইতে সবিস্তারে লিখলেও সে-সময় তাঁর লেখালেখি সংখ্যায় কমে এসেছিল, হয়েছিল গভীর। ডায়েরির এসব অংশে নানা দেশে নিজের ভ্রমণের কথা বলেছেন তিনি এবং জানিয়েছেন সেখানে কী শিখেছেন। এছাড়া তখন যেহেতু তিনি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য সেহেতু বৈচিত্র্য এসেছে লেখার ধরনেও। এক জায়গায় তিনি বলেছেন, কিভাবে তিনি বারাক ওবামাকে অনুরোধ করেছিলেন নরেন্দ্র মোদিকে গ্রহিষ্ণুতা ও বৈচিত্র্যের গুরুত্ব সম্বন্ধে বোঝাতে। বসু জানিয়েছেন, ২০১৫ সালে মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তিনি নিজেও তাকে এসব কথা বলেছিলেন।

২০১৫ সালের ডিসেম্বরে কৌশিক বসু বাংলাদেশ ভ্রমণে আসেন। এখানে তিনি 'বিশ্ব অর্থনীতি, বাংলাদেশ ও আঞ্চলিক সহযোগিতা: সমস্যা ও সম্ভাবনা'র ওপর বক্তৃতা প্রদান করেন। তিনি দেখা করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা শুরুই করলাম এই বলে যে আমাদের বাবা-মা আজ বেঁচে থাকলে তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাতের কথা শুনে খুবই খুশি হতেন, কারণ সীমান্তের ওপার থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে গভীর আগ্রহের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেছি আমরা। আমাদের পিতামাতা শেখ মুজিবুর রহমানের বড্ড ভক্ত ছিলেন। লেখক বলেন, কোনো ভাবনাচিন্তা ছাড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবেই কথাগুলো তাঁকে বলে ফেললাম বটে, তবে এটি আমাদের কথাবার্তাকে সহজ করে তুলল।

তিনি এ সফরের একটি বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলতে ভোলেননি, কৌশিক বসু লিখেছেন, বাংলাদেশে গিয়ে যত বই পেয়েছি দুনিয়ার আর কোনো দেশে গিয়ে ততগুলো পাইনি। তিনি এও জানিয়েছেন যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাদের প্রায় সবাই তাঁর হাতে একটি বই ধরিয়ে দিয়েছিল।
'পলিসিমেকার'স জার্নাল: ফ্রম নিউ দিল্লি টু ওয়াশিংটন ডিসি' তথ্য এবং তত্ত্বে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠেনি। যান্ত্রিক ও গতানুগতিক পুনরাবৃত্তি দিয়ে তিনি তাঁর ভাষাকে যেমন মুমূর্ষু করে তোলেননি, তেমনি বিষয়গুলোকেও একরৈখিক করে রাখেননি। একদিকে ভাষার শৈল্পিক অভিঘাত অন্যদিকে নানা বিচিত্র বিষয়ের সকৌতুক উপস্থাপনা বইটির অন্যতম আকর্ষণীয় দিক।

একদিনের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন যেবার বিশ্বব্যাংকের বাৎসরিক সভা শেষে তিনি একটি এলজিবিটি গ্রুপের সঙ্গে বৈঠক করেন। এখানে অনেকেই এসেছিলেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় এবং জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে যে সমকামভীতি দেখা যায় তার বিপক্ষে কথা বলতে। সেই সঙ্গে এটি দেখাতে যে, এর এক ধরনের অর্থনৈতিক দণ্ড রয়েছে।

সেখানে 'দ্য কস্ট অব হোমোফোবিয়া' শিরোনামে একটি প্যানেল আলোচনায় অনেক দ্বিধা নিয়ে অংশ নেবার পর কৌশিক বসু বলেন যে এ বিষয়ে তাঁর কিছুটা আগ্রহ আছে কারণ তিনি দেখেছেন কীভাবে ভারতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ এববং সমকামীদের ঘৃণা এবং বৈষম্যের চোখে দেখা হয়। তিনি আরো উল্লেখ করেন, সমকামিতাকে অনেক জায়গায় অপরাধ হিসেবেও দেখা হয়। সমকামিতার পক্ষে নিজের অবিচল এবং দৃঢ় অবস্থান জানিয়ে তিনি বলেন, সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে দেখাটাই একটি অপরাধ। শেষে সমকামিতা নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ভারতের পেনাল কোড ৩৭৭-এর বিরুদ্ধে তিনি ইতিপূর্বে লেখালেখি করেছেন। এসব কথার পর কৌশিক বসুর মনে হয়েছে শ্রোতাদের সঙ্গে তাঁর এক ধরনের যোগাযোগ তৈরি হয়েছে এবং তার ভিত্তিতে তিনি তাঁদের একটি মজার গল্প শোনাতে পারেন।

কৌশিক বসু বলেন, ষোল বছর আগে যখন তিনি ওয়াশিংটনে বসবাস করতেন, তখন তাঁর মা কয়েক সপ্তাহ থাকবার জন্য ভারত থেকে তাঁদের কাছে বেড়াতে আসেন। একদিন তিনি এবং তাঁর স্ত্রী পারিবারিক এক গে-দম্পতির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। তাঁর মায়ের মতো একজন গতানুগতিক ধার্মিক নারী কিন্তু সহজাতভাবে উদার এমন একজন মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে যেতে কৌশিক বসু এবং তাঁর স্ত্রী কিছুটা দ্বিধা করছিলেন, কারণ তাঁরা জানতেন যে বয়স্ক মানুষজন অভ্যাসগতভাবে কিছুটা আবোলতাবোল কথাবার্তা বলে থাকেন। যাক। তাঁরা সেই গে-দম্পতির বাসায় যান এবং দেখেন তাঁর মা খুব সচ্ছন্দভাবে এবং আগ্রহ নিয়ে তাদের সঙ্গে মিশে গেছেন। তিনি তাঁদের সঙ্গে গল্পগুজব করেন এবং বয়স্কজনোচিত লজ্জা ঝেড়ে ফেলে সেই দম্পতিকে বলে বসলেন, তিনি তাঁদের বাড়িটা একটু ঘুরে দেখতে চান।
'তোমাদের শোবার ঘর কোথায়? ওহ্! তোমরা দুজন এখানে থাকো?' সেই দম্পতির শোবার ঘর দেখে তাঁর মা এমন মন্তব্য করার পর তিনি এবং তাঁর স্ত্রী সবকিছু মিলিয়ে মায়ের আচরণে মনে মনে খুশি হয়ে উঠেছিলেন। ফেরার সময় হল। তাঁরা যখন গে-দম্পতির বাড়ি থেকে বিদায় নেবেন কৌশিক বসুর মা সেই দম্পতিকে বলে বসলেন, 'তোমাদের চমৎকার জীবনযাপন দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। এখন তোমাদের দরকার দু'জন নারী। তাতে করেই তোমাদের দু'জনের জীবনযাপন আদর্শ হয়ে উঠবে।'

বইটি লিখতে গিয়ে চারপাশে কী ঘটছে সে ব্যাপারে তিনি পুরোপুরি সংবেদী ছিলেন। একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে লেখাপড়ার দিকেই তাঁর ঝোঁক ছিল সেখান থেকে উচ্চপর্যায়ের কূটনীতি, সরকারি ও আন্তঃসরকারি কাজের ভুবনে প্রবেশ এবং সেখানে সাত বছর কাটিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটি যে তাঁকে শেকড়হীন অনিকেত অবস্থানে ঠেলে দেয়নি বরং কাজগুলো যে তিনি বেশ উপভোগ করেছেন এ কৃতিত্ব বহুলাংশে তাঁরই। ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রীতি, স্নেহ-মমতা যেমন বইতে স্থান পেয়েছে, তেমনি পেশাগত সম্পর্কগুলোর বিষয়েও তিনি আন্তরিক মতামত দিয়েছেন।

বসু যেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন সেগুলোকেও প্রায়ই সমালোচনার বাণে বিদ্ধ করেছেন। বইতে বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা করলেও স্বীকার করেছেন, চরম দারিদ্র্য নিরসনে এটি কিছু ভূমিকা রেখেছে। তিনি জোসেফ স্টিগলিজের দৃষ্টান্ত থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন যিনি বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ থাকার সময়ও আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের অতিমাত্রায় রক্ষণশীল বলে সমালোচনা করেছেন। আত্ম-দর্শনে কৌশিক বসুর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতেই হবে, নিজেকে নিয়ে কৌতুক করায়ও জুড়ি নেই তাঁর। অর্থ, যশকে তুচ্ছ জ্ঞান করা এই অর্থনীতিবিদের বামপন্থার প্রতি দুর্বলতা আছে, তবে যেসব অর্থনীতিবিদ চিন্তার বদলে আবেগকে প্রাধান্য দেন তাঁদের সমালোচনা করতেও ছাড়েননি। মানবতাবাদী এই মানুষটির লেখাপড়া আর গবেষণার প্রতি আনুগত্য বৈষয়িক আসক্তিকে তাঁর মনের ত্রিসীমানায়ও ঘেঁষতে দেয়নি। তিনি যেন জানতেনই বাইরের পৃথিবীর জন্য তাঁর বড় কাজ অপেক্ষা করে আছে তাই সারাজীবনভর নিজেকে গড়ে তুলেছেন তিল তিল করে। বইতে স্বভাবগতভাবে যুক্তির ওপর প্রচুর জোর দিয়েছেন তিনি; এও বলেছেন, পৃথিবীতে যা ঘটে চলেছে সেটি তাকে প্রভাবিত করে না কারণ তিনি মনে করেন সবকিছুই পূর্বনির্ধারিত। তাঁর লেখনী থেকে যে চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেটি হচ্ছে সমাজ গঠনে অর্থনীতিবিদদের ভূমিকা ও তাদের প্রভাব।

স্বজাতির শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা নয় বরং বিশ্বমানবতার প্রতি তাঁর সহানুভূতিশীল মনোভাব বইটিকে অনন্য করে তুলেছে। কৌশিক বসুকে সবসময়ই দুর্নীতি, আত্মীয়তোষণ এবং অর্থনীতির দুর্বল কর্মক্ষমতার মতো বিষয়গুলো উদ্বিগ্ন করেছে। দীর্ঘ ঐতিহ্যের প্রভাব মেনে শাসন ক্ষমতায় থেকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া এবং কাজ সম্পাদন করার বিচার-বিবেচনা নিয়ে যারা ভাবেন তাঁরা তো বটেই, মূল্যবোধের ক্ষেত্রে যারা ভেতর-বাইরে চেতনার অন্বেষণ করছেন তাঁদেরও বিশেষভাবে বইটা পড়া দরকার।