সৌদি আরবে ৮ বাঙালির শিরশ্ছেদ: আমরা বক্তৃতায় পরিপক্ক বেশ

সাইফ ভূঁইয়া
Published : 11 Oct 2011, 02:05 AM
Updated : 11 Oct 2011, 02:05 AM

সৌদি আরবে ৮ বাংলাদেশীদের শিরশ্ছেদ ঘটনায় গোটা দেশে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা হচ্ছে। অনেকে সৌদি আরবকে অসভ্য- বর্বর জাতি হিসাবে আখ্যা দিয়ে যাচ্ছেন।
সবাই যে আবেগ প্রবণ হয়ে এসব লিখছেন তা আমি মনে করিনা। অনেকে ঘোলা পানিতে মাছ ধরার চেষ্টা করছেন,অনেকে কূটনৈতিক উদ্যোগ আর সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে এসব সমালোচনাকে ইন্ধন দিচ্ছেন বলে আমি মনে করি।

কারো সম্পর্কে দূর থেকে বসে অনেক কথা বলা যায়,অনেক পুঁথি পাঠ করেও আলোচনা বা তর্ক চালিয়ে যাওয়া যায়। এই যে পক্ষ-বিপক্ষ এটা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মেনে নিতে কারোরই আপত্তি থাকার কথা নয়।

আমরা যদি বিষয়টিকে এভাবে দেখি যে, "একটা দেশ কোন আইনের ভিত্তিতে চলবে সেটা সেই দেশের নিজস্ব নীতিনির্ধারকরাই ভালো বলতে পারবেন, কিম্বা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, অখণ্ডতা রক্ষার অধিকার তাদের রয়েছে।" অনেকে রাজ-পরিবারের সমালোচনা করেন,(পরিবার তন্ত্র তো আমাদের নিজ দেশেই স্থায়িত্ব পেয়েছে!) অনেকে এদের আইনে মানবাধিকার খুঁজে পান না!

আমরা বেকারত্বের বোঝা সইতে না পেরে চাকরী নিয়ে, হজ্ব কিম্বা উমরাহ করতে এই দেশে আসছি। অনেকে অবৈধ ভাবে থেকেও যাচ্ছি। এখানে আসার পরপরই ভুলে যাচ্ছি এটা সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ নয়। এখানের আইন অমান্য করার শাস্তির কথা ভুলে গিয়ে জড়িয়ে পড়ছি অপরাধে।

যারা সৌদিআরবের পক্ষ নিয়ে কথা বলছেন অনেকে তাদেরকে সৌদি বংশোদ্ভূত বলে সম্বোধন ও করেছেন! তারা এটা ভুলে যান কেন আমরা চাইলেও কিন্তু তাদের বিদ্যমান আইন বদলে দিতে পারবনা।
দেশটির বিদ্যমান আইনের প্রতি আমার যথেষ্ট সম্মান জন্মে গেছে। আমি এখানে এসে দেখেছি আইনের শাসন,ঘুষ-দুর্নীতি,চুরি,ছিনতাই, রাহাজানি, হত্যা-ধর্ষণ মুক্ত দেশ কাকে বলে! আর যে দেশে এমন আইনের সফল বাস্তবায়ন হয়ে থাকে সেদেশের সমালোচনা করছি শুধু মানবাধিকার, নারী অধিকার ইত্যাদি বলে!

বিশ্বের অনেক দেশে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি বা জনগণের নির্বাচিত দল ক্ষমতায় আছে আপনারা যারা গালি দিছেন তাদের বলি ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখুন সমস্ত বিশ্বের অপরাধ চিত্র পেয়ে যাবেন।

কেউ অপরাধ করলে তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে,সুবিচার করতে হবে এটাই সভ্যতার নিয়ম। আর বিচার মানে যেহেতু অপরাধের শাস্তি তাই শাস্তিটাও হওয়া উচিত দৃষ্টান্ত মূলক। আমাদের দেশে হঠাত করে এসিড নিক্ষেপের ঘটনা বেড়ে গিয়েছিল, আইন করে দোষীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর দেশব্যাপী এসিড নিক্ষেপের ঘটনা কিন্তু কমে গেছে! সৌদি আরব প্রচলিত নিয়মে সর্বোচ্চ সাজা প্রাপ্তদের প্রকাশ্যে শাস্তি এই জন্য-ই দেয় যাতে করে সবাই অপরাধ থেকে দুরে থাকে।

পশ্চিমাদের সুরে আমরা সুর মিলিয়ে বলছি মানবাধিকার গেছে! পশ্চিমা বিশ্ব তথা পরাশক্তি গুলোর মধ্য-প্রাচ্য নীতির কারণে আমরা অধিকাংশ আরব রাষ্ট্রে অস্থিরতা, পট পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। এই পশ্চিমা বিশ্বের মধ্য-প্রাচ্য প্রীতি বা নীতির অন্যতম কারণ হল তাদের নিজস্ব স্বার্থ তথা আরবদের খনিজ সম্পদ। পশ্চিমারা নানা ব্রান্ডের, নানা রঙের গাড়ি বানায়,বিমান বানায় কিন্তু তাদের কাছে জ্বালানির কোন মজুদ নেই। যেহেতু তাদের জ্বালানির প্রয়োজন সেহেতু তারা গোটা মধ্য-প্রাচ্যকে কুক্ষিগত করতে আপোষহীন ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তারা ইরাক. সিরিয়া, লিবিয়া, বাহরাইন, কুয়েত,ইরান কার পেছনে নেই!
ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবির প্রতি তাদের মাথা ব্যথা নেই,ইসরাইল দিনের পর দিন স্বাধীন ফিলিস্তিনের দাবিতে আন্দোলন কারীদের নিশৃংস ভাবে হত্যা করলেও মানবতা গেল মানবতা গেল বলে কারো টু শব্দটিও নেই।

সৌদি আরবের মুসলিমরা ফ্যানাটিক নয়। একজন বিন-লাদেনকে সোভিয়েত আফগান যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নকে মার খাওয়াতে মদদ দিয়ে আমেরিকা তাকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী বানিয়েছিল নিজেদের প্রয়োজনে। আবার প্রয়োজন ফুরাতেই তাকে হত্যাও করেছে।

গোটা বিশ্ব যখন অর্থনৈতিক মন্দায় আক্রান্ত,খোদ মার্কিন মুল্লুক যেখানে তাদের বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে সচল করতে হিমসিম খাচ্ছে তখন সৌদি আরব তার উচ্চ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে। দেশটিতে এখন বিদেশি বিনিয়োগ হচ্ছে। আইটি ক্ষেত্র,কম্পিউটার,গার্মেন্টস,চামড়া ও চামড়া-জাত পণ্য সহ নানা ব্যবসায় সৌদি আরবের অনেক বেসরকার প্রতিষ্ঠান ভারতে বিনিয়োগ করছে। সুযোগটা আমরাও নিতে পারতাম।

অনেকে বলছেন অপরাধীর শাস্তি চাই আবার বলছেন এভাবে কেন,এটা অমানবিক! আমি বলি একবার ভাবুন সেই মিসরীয় পরিবারটির কথা যাকে হত্যা করা হয়েছে শুধু এই কারণে যে সে চুরি করতে বাধা দিয়েছিল!! বিনা দোষে দোষী একজনকে ৮জনে মিলে পিটিয়ে মেরে ফেললেন আর শাস্তি ভোগ করবন না এটা মানবাধিকারের দেশ বাংলাদেশ সম্ভব, এখানে নয়। অনেকে বলছেন তারা ন্যায় বিচার পায়নি। তাদের বলি অভিযুক্তদের ৩জন নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় মৃত্যুদণ্ডের সাজা থেকে রেহাই পেয়েছেন।

এদেশের প্রচলিত আইনে অপরাধী তখনই ক্ষমা পেতে পারে যদি অভিযোগকারী তার অভিযোগ তুলে নেন কিম্বা অপরাধীকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। এই ঘটনাটির পিছনে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা ছাড়া আমি অন্য কোন কিছু দেখিনা। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ মিসরের ওই পরিবারটির কাছে ক্ষমা পাবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এবং তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। তারা রক্তপণ (ব্লাডমানি) গ্রহণ করে ক্ষমা করতে রাজি হলে প্রাণগুলো রক্ষা পেতো। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ঐ মিশরীয় পরিবারটিকে সাজা প্রাপ্তদের প্রাণ ভিক্ষা দেয়ার জন্য কোন রকম উদ্যোগ তারা নিয়েছিলেন বলে আমার জানা নেই।

পরিশেষে শুধু এটুকু বলতে চাই এদেশে কর্মরত প্রায় ২০ লাখ বাঙালির মধ্যে গুটিকয়েক অপরাধী,অসাধু নাগরিকের জন্য আমাদের ভাবমূর্তি অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেছে। এদের কুকীর্তির খবর যখন শুনি বা দেখি তখন লজ্জায় মাথা হেট হয়ে আসে। তারা এদেশে যে ধরনের অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে তার ফিরিস্তি দিতে গেলে নিজ দেশেরই বদনাম! সমালোচনার নামে অনেকে ইসলাম এবং শরিয়ত বিদ্বেষী বিতর্কে অবতীর্ণ হয়েছেন,আপনারা সমালোচনা করুন গঠনমূলক আলোচনা করুন সমস্যা নেই।

শুধু এটুকু মনে রাখবেন ২০ লাখ বাঙালির এদেশে থাকা না থাকা এখন অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আপনারাই সিদ্ধান্ত নিন এদের দায় জাতি নেবে কি-না! দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে ব্রতী হবেন নাকি "প্রতি ঘরে ঘরে চাকুরী দেবার ওয়াদা পূরণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সরকারকে আহবান জানাবেন"?

ছবি: ইন্টারনেট