লাভ ইয়োর লিভার

সাইফ ভূঁইয়া
Published : 25 Nov 2011, 02:59 PM
Updated : 25 Nov 2011, 02:59 PM

বাংলাদেশে লিভার ডিজিজে আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলেছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা লিভার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মুবিন আহমেদ খান এর উদ্ধৃতি দিয়ে বার্তা সংস্থা Xinhua জানায় বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখের বেশি মানুষ লিভার-ডিজিজে ভুগছেন। এদের মধ্যে প্রায় দেড় কোটি মানুষ হেপাটাইটিস-বি এবং ৪০ লাখ মানুষ হেপাটাইটিস-সি আক্রান্ত।
এমন একজন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবেনা যিনি জীবনের কোনো না কোনো সময় একজন গ্যাস্ট্রো-এন্টারোলজিস্টের শরণাপন্ন হননি।

আমরা চাইলেই নিজেদের অনেক ভালো রাখতে পারি। জনসচেতনতা মূলক পর্বের আমার আরো একটি লেখা দেশের সমস্ত সচেতন নাগরিকের জন্য উৎসর্গ করা হলো।

প্রথমেই জানি লিভার কি:
মানব দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটির নাম হচ্ছে লিভার এটি পেটের ডানদিকে (উপরের দিকে) অবস্থিত, ক্ষেত্র ভেদে লিভারের ওজন ১.২ কেজি থেকে ১.৯ কেজি পর্যন্ত হতে পারে।
লিভার ৫০০ এর অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজে সদা ব্যস্ত থাকে,মানবদেহের মোট ৫০০ মি.লি রক্ত হেপাটিক-আর্টারি দিয়ে প্রবাহিত করে, হেপাটিক পোর্টাল-ভেইন দিয়ে শরীরের সব ধরনের পুষ্টি সরবরাহ করে। এর প্রধান কাজগুলো হলো মানবদেহের ক্ষতিকারক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ বের করে দেয়া, চর্বি এবং অন্যান্য উপাদানকে ভেঙ্গে লিপিড প্রোটিন তৈরি করা, শরীরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত চিনি বা শর্করা জমা করে, ভিটামিন-এ, বি-১২ ,কপার, লোহা ইত্যাদি জমা করে বাইল নামক একধরনের রাসায়নিক উপাদান তৈরি করে, রক্ত দ্রুত জমাট বাধতে সহায়তা করে, দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এক কথায় লিভারকে সমগ্র মানবদেহের জ্বালানির উৎস বলা যেতে পারে।

লিভারের রোগ সমূহ:
১.ভাইরাল হেপাটাইটিস:
ক্রনিক লিভার ডিজিজে আক্রান্ত রোগীদের লিভার একধরনের এনজাইম SGPT, SGOT ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে উপাদানগুলো রক্তে ছড়িয়ে দেয় যা লিভারের প্রদাহের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত প্রদান করে। প্রদাহের কারণ খুঁজলে দেখা যাবে আক্রান্তের লিভার মূলত হেপাটাইটিস -এ, বি, সি, ডি, ই সংক্রমিত। অথবা Auto Immune Hepatitis-এ আক্রান্ত ।
২. ফ্যাটি লিভার
৩. এলকোহলিক লিভার
৪. বিভিন্ন ঔষধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় লিভার ফেইলিওর

আক্রান্ত ব্যক্তি দীর্ঘদিন যাবত কোন রকম শাররীক কষ্ট, উপসর্গ ছাড়াই স্বাভাবিক জীবন যাপন করে।
ভাইরাল হেপাটাইটিসে আক্রান্ত রোগীদের লিভারে প্রথমে ভাইরাস সেলগুলো নিজস্ব প্রোটিন বন্ধনী তৈরি করে, নির্জীব থাকে।
একসময় আক্রান্তদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ ক্রনিক সংক্রমণের শিকার হয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কিম্বা রোগীর ইম্মিউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে পড়লে ভাইরাসগুলো রাতারাতি কয়েক মিলিয়ন নতুন ভাইরাস কোষ তৈরি করে এবং লিভার সেলগুলোকে ঝাঁঝরা করে দেয়। ডাক্তারি ভাষায় একে ফাইব্রোসিস বলে। এই ফাইব্রোসিস হলো সিরোসিসের প্রথম ধাপ।
এই ৬০ ভাগের মধ্যে ২০-২৫ ভাগ রোগী দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণের ফলশ্রুতিতে লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যান্সার কিম্বা লিভার ফেইলিওরের শিকার হন।
আশার কথা হলো ১০-১৫ ভাগ রোগী এই প্রদাহ নিয়েও দীর্ঘদিন বাঁচতে পারে।
শতকরা ৫ ভাগ লিভার ক্যান্সারে অথবা এন্ড স্টেজে নানা জটিলতায় মৃত্যুবরণ করেন।
সাধারণত একটি সুস্থ লিভার ২৫% পর্যন্ত রিজেনারেট করে থাকে। কিন্তু হেপাটাইটিস ভাইরাসে আক্রান্তের লিভার কখনোই পূর্বাবস্থায় ফিরে আসেনা।

এলকোহলিক ব্যক্তি যদি মদ্যপান, ধূমপান ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে তবে তার জন্য কিছুটা আশার আলো রয়েছে ।
ধ্বংস প্রাপ্ত লিভার কোষ পুনর্গঠনে এক ধরনের হার্বাল Milk Thistle বা সিলিমেরিন অনেকটাই কার্যকর। এছাড়াও বাইল Bile এসিড নিঃসরণে Ursodeoxycholic Acid
অনেকটাই কার্যকর।

যে সমস্ত ঔষধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় লিভার বিকল হতে পারে:
১।ব্যথা নাশক (NSAID, Paracetamol), এন্টি-বায়োটিক
২। যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধিকারক ঔষধ ভায়াগ্রা, এডেগ্রা, সেনেগ্রা,ইহোমবিন (Yohombine) নির্যাসে তৈরি যৌন-উত্তেজক, সিনথেটিক যৌন-উত্তেজক ঔষধ, এনার্জি-ড্রিঙ্ক,
ফেন্সিডিল, ইয়াবা ইত্যাদি

উপসর্গ:
১। মলের রং পরিবর্তিত ( হালকা রং, বাদামী ছোপ)
২। ওজন হ্রাস/ বৃদ্ধি
৩। মাংসপেশির শৈথিল্য
৪। পেটের ডানদিকে ব্যথা
৫। রক্তপাত, দাঁত ও মাড়িতে রক্তপাত, সহজে রক্ত জমাট না বাঁধা
৬। পেটের চামড়ায় মাকড়শার জালির মত শিরা-উপশিরার উপস্থিতি
৭। চুলকানি, ত্বকে অস্বাভাবিক এলার্জিক পরিবর্তন
৬। পেটে/ পায়ে পানি আসা বা ফুলে যাওয়া
৭। মনোযোগে ব্যর্থতা, অস্বাভাবিক আচরণ করা
৮। মাথা ব্যথা
৯। পোর্টাল হাইপার টেনশন, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া
১০। অবসাদ গ্রস্হতা
১১। কোষ্ঠ-কাঠিন্য
১২। টেস্টিস ছোট হয়ে যাওা
১৩। জন্ডিস ইত্যাদি।

জটিলতা সমূহ:
রক্তে এমোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া কিম্বা কোমায় চলে যাওয়া
রক্তে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যাওয়া, প্রোটিনের পরিমাণ কমে বা বেড়ে যাওয়া
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, নিউমোনিয়া সহ অন্যান্য ইনফেকশনের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া
পোর্টাল ভেইনগুলো মাঝপথে (Portal Gateway) বাধা পেয়ে এসোফেগাসে ক্রমাগত চাপ দিতে থাকায় নাক, মুখ, গলা দিয়ে মারাত্মক রক্ত-ক্ষরণে রোগীর মৃত্যু ঘটা
ডায়াবেটিকের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া
কিডনি ফেইলিওর
শরীরে বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য বেড়ে যাওয়া
পুরুষের স্তন অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া
মেয়েদের ঋতু-চক্রের অস্বাভাবিকতা, অস্বাভাবিক মনোপোজ

চিকিৎসা:
উপসর্গ ভেদে চিকিৎসা পদ্ধতি আলাদা আলাদা
একজন দক্ষ হেপাটোলজিষ্ট/ লিভার বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে থাকা।
নিউমোনিয়া, ম্যানিনজাইটিস, ফ্লু'র টীকা দেয়া
হেপাটাইটিস আক্রান্তদের আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে ভাইরাস নির্মূল।
বিভিন্ন উপসর্গ ভেদে আক্রান্ত লিভারের শেষ অধ্যায়টিকে বলা হয় Decompensated Liver
বাংলাদেশে আজকাল রক্তের এমোনিয়া নিঃসরণের জন্য এক ধরনের বিকল্প ঔষধ আমদানি করা হচ্ছে। ঔষধটির নাম Hepa-Merz
এছাড়া দেহের জন্য অতি প্রয়োজনীয় এমাইনো এসিড যা রোগীর লিভার পর্যাপ্ত সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে তাদের শরীরের
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে Viusid নামক এক ধরনের সাপ্লিমেন্ট বাংলাদেশে পাওয়া যাচ্ছে।

এন্ড স্টেজে করণীয়:
লিভার ট্রান্স-প্লান্ট।
লিভার ট্রান্স-প্লান্ট এখনও কার্যকর সফলতা পায়নি।
এই চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল বিধায় উচ্চবিত্ত ছাড়া কারো পক্ষেই এই বিকল্প পদ্ধতি নিয়ে ভাবা ঠিক নয়।
পরিসংখ্যান গুলো বলে সফল লিভার ট্রান্স-প্লান্টের পর রোগী মাত্র ১ হতে ৫ বছর বাঁচে।

উপসংহার:
যেহেতু এধরনের রোগীর রক্তে লিভার এনজাইমের মাত্রা স্বাভাবিকর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি থাকে তাই রোগীকে পর্যাপ্ত হাঁটতে উপদেশ দেয়া হয়ে থাকে।
তেল-চর্বি জাতীয় খাবারে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা থাকে।
লাল-মাংস (খাসি, গরু, উট, ভেড়া ইত্যাদির) মাংস খাওয়া সম্পূর্ণ বারণ।
ভিটামিন-বি, সি, ই যুক্ত খাবার প্রচুর খেতে হবে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলেন, ক্যান্সার প্রতিরোধক খাবার যেমন ব্রুক্কলি, গাজর, বাধা-কপি, টমেটো, আপেল, কমলা, সেলেনিয়াম যুক্ত খাবার বেশি খাওয়া উচিত।
মাল্টি-ভিটামিন শরীরে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা, পীর-ফকির, কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি ঔষধ মোটেও কার্যকর নয়।
দুশ্চিন্তা, হতাশা মুক্ত জীবন যাপন করতে হবে।
পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে।