একুশ কোনো শোকগাথা নয়: পর্ব-১

সাইফ ভূঁইয়া
Published : 6 Feb 2012, 11:40 AM
Updated : 6 Feb 2012, 11:40 AM

****
আমি প্রথম যখন কথা বলতে শিখেছি তখন নাকি "মা" শব্দটি সর্বপ্রথম উচ্চারণ করেছিলাম! বিজাতীয় ভাষা আমাদের উপর চাপিয়ে দিলে কেমন হত!!
ভাষা আন্দোলনের সকল লড়াকু সেনানী, আর আত্ম-উৎসর্গকারী সকল শহীদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি। "আমরা তোমাদের ভুলবো না"।

****
একুশ আমার অহংকার! একুশ আমাদের দৃপ্ত চেতনা, স্বাধিকার, প্রতিরোধে ছিনিয়ে আনা এক গৌরব গাঁথার নাম। ৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলনে
আত্ম-উৎসর্গকারীরা বিশ্বের দরবারে আমাদের পরিচিত করেছে আত্ম-মর্যাদাবান, লড়াকু এক জাতি রূপে।
২১শে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস, ভাষার জন্য আত্মত্যাগ পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও নেই!

****
শহীদের আত্মত্যাগকে মর্যাদাবান করতে গোটা বাঙালি জাতি অকৃপণ, উদার ভাবে তাঁদের ভালবাসা ঢেলে দিয়ে এসেছে যুগ যুগ ধরে।
একুশের চেতনায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম উজ্জীবিত হয়েছে।
ভাষার মাস এলে সাজ সাজ রব চারিদিকে। প্রাণের মিনার সাজে অপরূপ সাজে।
বর্ণিল দেয়াল লিখন, কালজয়ী কৃতি সন্তানদের অমর বাণী থেকে নির্বাচিত কথামালা বুকের স্পন্দন বাড়িয়ে দেয়।
চারুকলার ছাত্র-ছাত্রীরা গোটা মাস ধরে দেয়ালে দেয়ালে তুলির আঁচড়ে ছড়িয়ে দেয় আমাদের অনুচ্চারিত শ্লোগান।

অন্যদিকে একুশের ঐতিহ্যে লালিত বাংলা একাডেমী সাজে নতুন সাজে। শুরু হয় বাঙালীর প্রাণের মেলা। বই মেলা। একাডেমী চত্বরে গোটা মাস জুড়ে বটমূলে চলে অনুষ্ঠান মালা।
মেলায় আগত সারি সারি দর্শক মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে থাকে ঠিক যেন কাঠের পুতুল।
মেলার অনেক আগে থেকেই লেখক-প্রকাশক ব্যস্ত; ভালো মানের লেখা চাই, ভালো মানের প্রচ্ছদ চাই, ভালো পরিবেশক চাই, শত ব্যস্ততার মাঝে ছুটে চলে লক্ষ্মীবাজার, বাংলাবাজার,আরামবাগ, আজিমপুর, নীলক্ষেতের প্রেসগুলোতে। কি-বোর্ডে ঝড় উঠে। নতুন লেখক বেশ রোমাঞ্চিত! ছাপার হরফে নিজের নাম! নাওয়া-খাওয়া নেই, চলে প্রুফ দেখা।
নতুন মলাটের ছবি চাই। ফ্লাশ জ্বলে উঠে! মলাট বুকে চেপে ধরে, ঠিক যেন সদ্য জন্ম নেয়া নতুন শিশু। অপেক্ষা ভালো লাগেনা।
ফোন বাজে ঘন ঘন। সদ্য বাঁধানো বই। এখনো ভেজা। ছুটে চলে স্টলে স্টলে। আবারও ফোন বাজে ঘন ঘন।

সবাই হাজির বই মেলায়। ছোট ছোট দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে আড্ডার ঝড় তুলে। নবীন, প্রবীণে আজ কোন প্রতিযোগিতা নেই, আজ কোনও বিদ্বেষ নেই,
সকলে পরিশ্রান্ত তবু ক্লান্তি বোধ নেই।
অটোগ্রাফ শিকারি, ফ্লাশ লাইটের আলোয় ঝলসে যায় মেলায় আগত কিশোর-কিশোরীর মুখ!
দুই-বাংলার বিখ্যাত লেখকদের কার কার বই এলো চোখে মুখে প্রশ্ন নিয়ে ঘুরে মেলা ময়। ধুলায় ধুসর। নিরাপত্তা তল্লাশি….। বাহ!

****
একুশ তুমি আমার অহংকার।।

একুশের প্রথম প্রহরকে ঘিরে হাইকোর্ট চত্বর, শাহবাগে বসে ফুলের মেলা। সারারাত জেগে ফুলের ডালা সাজানো, কত বাগানের গাঁদা, ডালিয়া, গোলাপ ফুল উজাড় হয়ে যায় নিমিষেই!
মালীর মুখ অমলিন! "পাগল ছেলের দল"! মনে মনে বলে, নিয়ে যাও সব, বর্ণে-বর্ণে রঙিন হোক গোটা শহীদ মিনার"।

রাজধানী ঢাকা সহ সারাদেশে স্কুল-কলেজ গুলোতে জড়ো হয় রাত জাগা এক-ঝাঁক তরুণ-তরুণী, প্রভাত ফেরিতে যাব, প্রভাত ফেরিতে!
প্রভাত ফেরির নিরাপত্তার কারণে ঢাকার অনেক রাস্তাই বন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে নিউমার্কেট হয়ে আজিমপুর গোরস্থানে।
সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার শুয়ে আছে পরম শান্তিতে। ছোট, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী এই প্রথম শহীদের কবরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বড়দের সাথে !
নগ্ন পা। হাতে ফুলের তোড়া। ইতিহাসের পাতায় দেখা ছবিগুলো কাঁপা-কাঁপা চোখের সামনে ভেসে উঠে " রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই"!
শিশুটি এখন আর শিশু নেই। তার বুকে শানিত প্রতিজ্ঞা, ইস্পাত কঠিন! এদেশ আমার!

নগ্ন পায়ের লাইন এগিয়ে চলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীগুলো সাদা শাড়িতে একেকটি অপ্সরা যেন ! বুকে কালো-ব্যাজ, মলিন মুখ !
মুখে গান "আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি..আমি কি ভুলিতে পারি.."
বুকের ভেতর চেতনায় শানিত দৃপ্ত অঙ্গীকার। এদেশ আমার!

মিছিল এগিয়ে চলে মন্থর গতিতে। সামনেই শহীদ মিনার! পাঞ্জাবি-পাজামায় ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী সব শ্রেণী পেশার মানুষ অবাক তাকিয়ে দেখে 'শহীদ মিনার ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে'!
তারা রাজপথে! বুকে সুদৃঢ় অঙ্গীকার। রক্ত দিয়ে বর্নমালা, স্বাধীনতা এনেছি। রক্ত দিয়ে রুখে দিব দেশ-বিরোধী সকল অপ-শক্তি।

আজকের রাজপথ ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চের ভাষার দাবিতে সচিবালয় ঘেরাও, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সহ ৬৫ জনের গ্রেফতার, আমতলায় গাজীউল হক সহ সকল ভাষা সৈনিকের গর্জন
—১৯৫২ সালে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বন্দুকের গুলিতে লুটিয়ে পড়া লাশের সারি.. নীরব নিথর। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের রক্তে রঞ্জিত রাজপথের মত সাদা কালো মনে হয়!

(চলবে)

একটি আবেদন: বেশি বেশি বই কিনুন। বিশেষ করে নতুনদের, সহমত ব্লগারদের বই। প্রিয়জনদের বই উপহার দিন। আপনি-ই পারেন একটি সৃজনশীল, একটি সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখতে।