আগুনের পরশমণি ও আন্তর্জাতিক লেখক দিবস ২০১৩

nilima_chowdhury
Published : 1 Jan 2014, 03:04 PM
Updated : 1 Jan 2014, 03:04 PM

সকালের কুয়াশা ভেদ করে রবি-রশ্মি তখন হাস্যোজ্জ্বল। দিনটি ছিল ৩১ ডিসেম্বর ২০১৩, মঙ্গলবার। সময় সকাল সাড়ে দশটা। ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে সমবেত হলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রজন্মের লেখক প্রতিনিধিবৃন্দ। তারা সবাই একযোগে ফুলেল শ্রদ্ধা জানালেন শহীদ মিনারের পুণ্যবেদীতে। বছরের শেষ-সকালকে এভাবেই অভিবাদন জানালেন বাংলাদেশের কবিলেখকরা। তাঁদের হাতে ছিল ব্যানার : শান্তির পৃথিবী চাই, গণতান্ত্রিক সদাচার চাই।

আমি প্রথম এসেছি এই অনুষ্ঠানে। আমার মনে হলো, এই আয়োজন একটু অন্যরকম। বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব ঘোষিত দ্বাদশ আন্তর্জাতিক লেখক দিবস উপলক্ষে এই আয়োজনটি করেছে লেখক দিবস বাস্তবায়ন পরিষদ। বেদীতে শ্রদ্ধানিবেদনের পর লেখক দিবসের দেশব্যাপী ও দিবসব্যাপী অনুষ্ঠানমাল উদ্বোধন করলেন দেশের অগ্রগণ্য ভাষাবিজ্ঞানী, গবেষক ও কবি প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান। লেখক দিবসের তাৎপর্য ও বর্তমান পরিপ্রেক্ষিত বর্ণনা করে স্বাগত ভাষণ দিলেন এই দিবসের প্রস্তাবক ও বাস্তবায়ন পরিষদের সভাপতি কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। পুষ্পার্ঘ অর্পণের পর এই স্বতঃম্ফূর্ত সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখলেন কবি মতিন বৈরাগী, কবি বিমল গুহ, কথাশিল্পী নিশাত খান, কবি নাসের মাহমুদ প্রমুখ। তাদের বক্তব্য ছিল শান্তির সপক্ষে, গণতন্ত্রের সপক্ষে। তারা গণতন্ত্রের অপরিহার্য শর্ত হিসেবে সকল পক্ষের সদাচারের উপর গুরুত্ব আরোপ করলেন। তারা আরো বললেন, দেশ ও জনগণ আজ রূঢ় সত্যের মুখোমুখি। মৃত্যু এখন ওঁৎ পেতে আছে সর্বত্র। দেশ যেন এক চরম আতঙ্কগ্রস্ত মৃত্যু-উপত্যকা। এই মুহূর্তে আমাদের প্রধান কাজ হবে গণমানুষের জীবনের সুরক্ষা দেয়া। কেননা রাজনীতির এই নির্মম খেলায় মানুষের প্রাণই সবচেয়ে সস্তা বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। সবার উপরে মানুষ সত্য, আর মানুষের সবকিছুর উপরে সত্য তার প্রাণ, – তার জীবন। এই প্রাণকে তাচ্ছিল্য করে রাজনীতি বা ক্ষমতানীতির যথেচ্ছাচার চলতে পারে না। আমাদের কলম এসব অত্যাচার অনাচারের বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠুক।


এ অঙ্গীকার নিয়ে তারা চললেন পদব্রজে, জাতীয় কবি নজরুলের সমাধিতে। এই সেই নজরুল যিনি বিশ্বজুড়ে সুবিচার, সাম্য, মানবমঙ্গল ও অভয়সুন্দরের গান গেয়েছেন। সব মানুষের ঐক্য ও সংহতির জন্যে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়েছেন। আর বাংলা ও বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। সেই মহান কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা জানালেন লেখকবৃন্দ। কবির উপর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন কবি ও নজরুল গবেষক মজিদ মাহমুদ। তৃতীয় বিশ্বের মুখপত্র হিসেবে নজরুলকে চিহ্নিত করলেন তিনি। অতঃপর তার অসাম্প্রদায়িক চেতনার উপর গুরুত্ব আরোপ করে নজরুলের আদর্শে আমাদের বিবেক ও চেতনাকে জাগিয়ে তোলার কথা বললেন। মাজারে দাঁড়িয়েই দেশ-জাতি ও বিশ্বের শান্তিপ্রার্থনায় নেতৃত্ব দিলেন আজকের দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার সভাপতি প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান।
তারপর ছবির হাট পেরিয়ে লেখকরা এগিয়ে চললেন লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতার অগ্নিপ্রতীক 'শিখা অনির্বাণ'-এর দিকে। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। আজ থেকে বিয়াল্লিশ বছর আগে এ উদ্যানেই রচিত হয়েছিল আমাদের মুক্তির এক মন্দ্রিত পঙক্তি; ঘোষিত হয়েছিলো আমাদের স্বাধীনতার মহান সনদ । আর সেই অবিনাশী সনদ উচ্চারণ করেছিলেন হাজার বছরের রাজনীতির মহাকবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

সেদিনের সেই বজ্রদুপুরকে সাক্ষী রেখে স্বাধীনতার অগ্নি-শিখার সামনে দাঁড়িয়ে আবার শপথ নিলেন লেখকবৃন্দ। তারপর ব্যানার হাতে এই প্রজ্বালিত শিখাকে প্রদক্ষিণ শুরু করলেন কবি নূরুল হুদা। তাকে নিরবে অনুসরণ করলেন সমবেত লেখকবৃন্দ। অন্যরকম এক শিহরণ বয়ে গেলো তাদের শিরায় শিরায়। এ-যেন প্রণম্য অগ্নিকে ছুঁয়ে চিরায়ত মানবশপথেরই নবায়ন। সত্যিকার অর্থেই আগুনের পরশমণি ছুঁয়ে গেল প্রাণে প্রাণে। যেন শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতর, পবিত্র থেকে পবিত্রতর হয়ে উঠলো তাদের সৃষ্টিসত্তা। তরুছায়াশোভিত উদ্যানের মাঝে লেখক-কবিরা যেন প্রত্যক্ষ করলেন তাদের স্বপ্নাশ্রিত সোনার বাংলা। তাদের কণ্ঠে লতিয়ে উঠলো : 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।'

অতঃপর ফিরতিযাত্রা। তারই ফাঁকে উদ্যানের এক কোণায় তরুতলে দাঁড়িয়ে শ্রান্ত লেখকরা সেরে নিলেন চা-পর্ব। সেই সঙ্গে নানারকম গল্পগুজব। প্রফেসর মনিরুজ্জামান বললেন, এ-রকম একটি দিন সহজে আসে না। আর অনন্য এই স্বাধীনতা উদ্যান। হুদাভাই বললেন, এই উদ্যানেই হতে পারে ছবির হাটের পাশাপাশি 'কবিতার হাট'। গাছের গায়ে কবিরা সেঁটে দিতে পারেন তাদের কবিতা। সবাই একবাক্যে সায় দিলেন তার কথায়।


তারপর প্রায় স্বপ্নচালিতের মতো লেখকরা সেই উদ্যান পেরিয়ে রাজপথ পেরিয়ে পায়ে পায়ে চলে এলেন রাইটার্স ক্লাবের সেমিনার কক্ষে। এখানে রান্না হচ্ছিলো সাদা ভাত, ডাল, শাক ও মুরগির ঝোল সহযোগে দুপুরের আহার। আহারের আগে শেষ হলো বাকি আলোচনা। আলোচনা করলেন কবি শহীদুল্লাহ ফরাজি। শোনালেন গান গেয়েও। তিনি সুস্পষ্ট প্রস্তাব করলেন, এখন সময় এসেছে 'জীবন সুরক্ষা' আন্দোলন শুরুর করার। সবাই তার এই মানবিক প্রস্তাবে সায় দিলো। তারপর শুরু হলো উপস্থিত সকলের কণ্ঠে স্বরচিত কবিতাপাঠ। ক্লাবে এ ধরনের নিয়মিত ও অনিয়মিত কবিতার আসর চলছে দীর্ঘ কুড়ি বছরেরও অধিক কাল ধরে। চলছে শব্দচিত্রের নিরন্তর নির্মাণ ও নবায়ন। আর তার কাণ্ডারীও বলা যেতে পারে কবি নূরুল হুদা। লেখক দিবসের এই পরিক্রমাও তার কবি মনের সক্রিয় চেতনার স্বাক্ষর। সবশেষে সভাপতির ভাষণে প্রফেসর মনিরুজ্জামান বললেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের দেশ ও সমাজ যেন প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছে। অন্যের দ্বারস্থ হয়ে নয়, এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ আমাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে। সেখানেই প্রয়োজন আমাদের সৃষ্টিশীলতা ও উদ্ভাবনশীলতা। লেখক দিবসে তাই আমরা প্রাসঙ্গিকভাবেই এই সৃষ্টি, উদ্ভাবনী ও শান্তির কথা বলছি।

যখন এই অনুষ্ঠান চলছিলো ক্লাবের সেমিনার কক্ষে, তখনি ময়মনসিংহ থেকে ফোন এলো লেখক দিবস বাস্তবায়ন পরিষদের সদস্য সচিব কবি ফরিদ আহমেদ দুলালের। তিনি জানালেন ময়মনসিংহের কবিলেখকরা লেখক দিবসের অনুষ্ঠান অয়োজন করেছে মুকুল নিকেতনে। ফোন এলো মৌলভিবাজার থেকে বিশিষ্ট লোকগবেষক মাহফুজুর রহমানের, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সাহিত্য একাডেমীর সভাপতি কবি জয়দুল হোসেনের। হুদা ভাই মুঠোফোনে তাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিলেন। আরো জানা গেলো, উপরে বর্ণিত জেলা ছাড়াও এবারে প্রতিকূল অবস্থা সত্বেও চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, কক্সবাজার, খুলনা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোর, কুষ্টিয়াসহ বিভাগীয়, জেলা ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপজেলা স্তরেও লেখকরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে এই দিবসটি পালন করেছেন। লেখকদের এই সামষ্টিক চেতনা ও প্রত্যয়ী উদ্যোগ আমাদের আশান্বিত করে।


আসলে দেশ যখন অবরুদ্ধ, যখন চারদিকে সংঘাত ও সাম্প্রদায়িকতার নির্মম আক্রমণ, যখন হত্যা আর ধ্বংসের পৈশাচিক নির্মমতা, যখন মানবিক মূল্যবোধ ধুলোয় গড়াগড়িরত, যখন ক্ষমতার জন্য মৌলবাদ ও তাদের দোসর-চক্রের উত্থানে গণতন্ত্র বিপন্ন, যখন সাধারণ মানুষ দিন কাটাচ্ছে চরম আতঙ্কে, যখন বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, যখন মুহূর্তেই উড়ে যাচ্ছে শান্তিকামী মানুষের প্রাণপাখি, ঠিক সেই মুহূর্তে কবি-লেখকদের এই সচেতন সমাবেশ ও সদাচারী উচ্চারণ অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। হ্যাঁ, সদাচারী কবি-লেখকরাই পারেন দুঃখ-ব্যথিত প্রাণে সান্তনার প্রলেপ দিতে। মনে পড়ছে মহাপ্রাণ বিদ্যাসাগরের কথা : "যে কলম আর্তের কথা লিখে না সে কলম স্তব্ধ হোক"। দেশের এই জটিলতম সঙ্কটের মুহূর্তে নির্বিচার রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কবিলেখকদের কলম সোচ্চার হোক। প্রাণে প্রাণে সঞ্চারিত হোক শান্তি ও সদাচারের যুগলবাণী। লেখক দিবসের অগ্নিশপথ সফল হোক।

এবারে একটু পেছনে যাওয়া যাক। আগেই বলেছি, এটি ছিল বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব ঘোষিত দ্বাদশ আন্তর্জাতিক লেখক দিবস। "শান্তি, প্রগতি, সৃষ্টিশীলতা ও অব্যাহত মানব-কল্যাণের বাণী নিয়ে ২০০২ সাল থেকে দিবসটি উদযাপিত হয়ে আসছে। লেখক দিবসের চিরায়ত ঘোষণা 'শান্তির পৃথিবী চাই'। প্রতি বছর স্বাদেশিক ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে একটি সময়ানুগ ও সম্পূরক প্রতিপাদ্য গ্রহণ করা হয়। লেখক দিবসের এ বছরের প্রতিপাদ্যঃ 'গণতান্ত্রিক সদাচার চাই'। বর্তমানে দেশে গণতন্ত্রের নামে যে অনভিপ্রেত সংঘাত, সংঘর্ষ, হত্যা, অগ্নিকাণ্ড, ধ্বংসযজ্ঞ, সমঝোতাহীনতা, পেশাচিক নির্মমতা ও গদিদখলের অমানবিক খেলা চলছে, তার পরিপ্রেক্ষিতেই এবারের প্রতিপাদ্য নির্বাচিত হয়েছে। প্রতি বছরের মতো এবার ও লেখব দিবসের মূল অনুষ্ঠান পর্যায়ক্রমে দেশের বিভিন্ন জেলাশহরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সৃষ্টিশীলতার তৃণমূলীয় বিকাশ ও সর্বস্তরের লেখকদের সামগ্রিক অঙ্গীকারের কথা বিবেচনায় রেখেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই বিকেন্দ্রীকরণ।"
রাইটার্স ক্লাবের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। শান্তির সপক্ষে কবি-লেখকদের সামষ্টিক পতাকা সমুন্নত থাকুক। রাইটার্স ক্লাবের কর্ণধার ও তার সহযোগীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা এই সংগঠনকে একটি উজ্জ্বল মর্যাদা দিয়েছে। আমাদের লেখকদের সাংগঠনিক দূরদর্শিতা ও নিপুণ কর্মকুশলতা এ সংগঠনকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করতে পারে। শান্তি, প্রগতি ও সৃষ্টিশীলতার লক্ষ্যে কবিলেখকদের এই সামষ্টিক পথ-চলা কুসুমাস্তীর্ণ হোক।