নাগরিক ব্যস্ততায় সময়গুলো হয়ে উঠেছে একঘেয়ে ,ক্লান্তি দুর করে মনটাকে চাঙ্গা করতে চাইলে আমরা অনেকই ছুটে যাই কক্সবাজার কিংবা সুন্দর বন সেখানে প্রাকৃতিক সৌর্ন্দযের লীলাভূমি , এছাড়া যে যাওয়ার মতো আরো অনেক গুলো আমাদের দেশেই বিদ্যমান তা আমরা অনেকেই জানিনা কিংবা জানলেও অনেকেরই যাওয়া হয়নি এমন একটা জায়গা নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুর- ইতিহাস-ঐতিহ্যের ও পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জেলা নেত্রকোনা। ঢাকা থেকে প্রথমে যেতে হয় ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা সড়কের শ্যামগঞ্জ বাজারে। এর পর শ্যামগঞ্জ-বিরিশিরি সড়ক ধরে সোজা যাওয়া যায় বিরিশিরিতে।সোমেশ্বরীর কূল ঘেঁষে এ জনপদের ছোট্ট একটি ইউনিয়নের নাম বিরিশিরি যেখানে সারিবদ্ধ সবুজ পাহাড় আঁকাবাঁকা নদী-ছড়া বেষ্টিত এক বৈচিত্র্যময় জনপদ। উত্তরের হিমেল হাওয়া এবং সোমেশ্বরীর স্বচ্ছ জলধারা নিমিষেই দূর করে দেবে আপনার ভ্রমন পথের ক্লান্তি যেখানে গেলেই আপনি দেখতে পাবেন অনেক কিছুই যা আপনার চোখ জুড়িয়ে দেবে করবে আপনাকে ইতিহাস সমৃদ্ধ।
এখানে উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী রয়েছে গারো, হাজং, হদি, কোচ, ডালু, বানাই প্রভৃতি উপজাতিদের বসবাস চারদিকে সবুজ বৃক্ষে মোড়ানো পাহাড়, মাঝে সমতল ভূমি। পাহাড়ি নদী সোমেশ্বরী। দু'তীর সিলিকন বেলাভূমি। স্বচ্ছ টলটলে নদীর জলের তলদেশ।দেখতে পাবেন সুসং দুর্গাপুরের বিজয়পুর গ্রামের মানুষের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে ক্ষতবিক্ষত হওয়া চীনা মাটির ন্যাড়া পাহাড়। যাকে আমারা জানি চিনা মাটির পাহাড় হিসেবে ,যে মাটি দেশের সিরামিক শিল্পের জন্য ব্যবহৃত হয়।
বিরিশিরিসহ সুসং দুর্গাপুর ও এর আশপাশের উপজেলা কলমাকান্দা, পূর্বধলা, হালুয়াঘাট এবং ধোবাউড়ায় । বাঙালী হিন্দু-মুসলমানদের সঙ্গে মিলে মিশে বাস করলেও এদের জীবনধারা অনেকটাই বৈচিত্র্যময়। তেমনি বৈচিত্র্যময় তাদের সংস্কৃতি_ যা নানা বাস্তবতায় হারিয়ে যেতে বসেছে আজ। আদিবাসীদের এ বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং চর্চার লক্ষ্য নিয়েই ১৯৭৭ সালে বিরিশিরিতে সরকারী উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় উপজাতীয় কালাচারাল একাডেমী। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠানটি বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের গিরিবাসী নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য কাজ করছে নিরলস।এখানে গেলে আপনি মুগ্ধ হয়ে দেখতে পাবেন উপজাতীয়দের ইতিহাস ও এতিহ্য কে কিভাবে লালন করে করে যাচ্ছে এ একাডেমী আগে থেকেই যোগাযোগ করলে গারো আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী নৃত্য উপভোগ করা সম্ভব।
সোমেশ্বরীর বুকজুড়ে বিস্তীর্ণ বালুকাবেলা। চর পড়ে, শুকনা মৌসুমে। এক পাশে সরু ফালির মতো বয়ে যায় খরস্রোতা নদীটি। খেয়ানৌকায় পার হয় অসংখ্য মানুষ। নেত্রকোনার দুর্গাপুরের এই জায়গাটা নতুন যে কারও কাছে অপূর্ব। নদী-চর-গ্রাম নিয়ে যারা 'অভিজ্ঞ', তাদেরও ভালো লাগবে নদী পেরিয়ে যেতে পারেন বিজয়পুর সাদামাটির পাহাড়ে। বাহন তিন রকম-রিকশা, ভ্যান-রিকশা আর মোটরসাইকেল। সোমেশ্বরীর বিস্তীর্ণ লালচে চর আর টলটলে পানি মুগ্ধ করবে সবাইকে। অপার্থিব এক সৌন্দর্য। এই শুষ্ক মৌসুমে নদীর বালুতে মিশে আছে কয়লা। সেই কয়লা তোলার কাজ শুরু হয় ভোর থেকেই। নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-জওয়ান-নির্বিশেষে কয়লা তোলে আর স্থানীয় দালালদের কাছে কম মুল্যে সেটা বিক্রি করে থাকে। সাদামাটির পাহাড়গুলো একটার পর একটা-অনেক। উঁচু, মাঝারি, ছোট-সবগুলোর মাটিই একেবারে মিহি দানার সাদা পাউডারের মতো। এসব পাহাড় থেকে মাটি নিয়ে আমাদের সিরামিক শিল্প আজ এতটা বিকশিত কোনো পাহাড়ের মাটি লাল, বেগুনি এমনকি গোলাপি।চোখ বন্ধ করে একবার ভাবুন পাহাড়ি রাস্তায় চোখে পড়বে আদিবাসীদের যাতায়াত। নারী আর শিশুই বেশি। পিঠে ঝুড়ি নিয়ে তারা যাচ্ছে সীমান্তের বাজারে।
বিরিশিরি উপজাতীয় কালচারাল একাডেমীতে প্রায় সারা বছর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠানটির নাম বার্ষিক আদিবাসী সাংস্কৃতিক উৎসব। এক সময় তা গারোদের 'ওয়ানগালা' নামে উদ্যাপিত হত। পরবর্তীতে অন্যান্য উপজাতির অংশগ্রহণের কথা বিবেচনা করে উৎসবটির নাম পাল্টে রাখা হয়। প্রতি বছর এ অনুষ্ঠানে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন উপজেলার গারো, হাজং, হদি, ডালু, কোচসহ আদিবাসীদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দল তাদের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান পরিবেশন করে। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকলের মধ্যে এক মেলবন্ধন রচিত হয় উৎসবে।সুসং দুর্গাপুরে অবস্থিত ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেয়া উপজাতি টঙ আন্দোলনের মহান নেতা মণি সিংহের স্মৃতিসৌধ, রানীকং দুর্গাপুরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। যেতে পারেন লেঙ্গুরা। পিচ করা রাস্তা, পানি কেটে চলা, সুড়ঙ্গ পথ, কখনও ধুলোর আস্তরণ, খড়খড়া সুড়কি, কখনোবা সোঁদা মাটির গন্ধ শুঁকে মোটরসাইকেল আপনাকে নিয়ে এগিয়ে যাবে একবারে বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে যেখানে আছে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ দের কবর ,সারি সারি গাছের মাঝখানে কবর গুলো আপনার মনে জাগিয়ে তুলবে আমাদের মহান মুক্তি যুদ্ধকে একপাশে বাংলাদেশ অন্যপাশে ভারত মাঝখানে পাহাড়ি নদী এ পাশে বিজিবি ও পাশে বি এস এফ পথের দু'পাশের দৃশ্য বাংলার চিরায়িত সৌন্দর্যের রূপ। মাঝখানে বয়ে যাওয়া নদীটা নোম্যান্স ল্যান্ড, অতটা পথ ঘুরতে একসাথে ঘুরতে গেলে আপনাকে শারিরিক ক্লান্তি পেয়ে বসতে পারে শুধু মাএ খানাকন্দে ভরা রাস্তা আর এবরো থেবড়ো পাহাড়ি পথ কিন্ত যতই দেখবেন ততই একরাশ মুগ্ধতা এসে ভর করবে আপনার দৃষ্টি জুড়ে।
যাদের নিজস্ব বাহন নেই তাদের ঢাকা থেকে বাসে ময়মনসিংহ, তারপর দুর্গাপুর যেতে হবে বাস বা ম্যাক্সিতে। জটিল এক যাত্রাপথ। দুর্গাপুরের হোটেল গুলশানে একটু সুস্থির হয়ে দুপুরের পর বের হওয়া। থাকার জন্য এ হোটেলের চেয়ে ঢের ভালো আদিবাসী সাংস্কৃতিক একাডেমি বা ওয়াইএমসিএর রেস্টহাউস।
***
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে: http://www.notundesh.com, ২৭ জুন ২০১২ | বুধবার