দুর্বল হয়েছে ডানপন্থি বিরোধীদল, বামপন্থিরা কতদূর?

পুলক ঘটকপুলক ঘটক
Published : 14 Dec 2011, 05:11 PM
Updated : 10 Jan 2019, 02:04 PM

ক্ষমতায় যাওয়ার অনেক পথ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্টরা বিভিন্ন পন্থায় ক্ষমতায় গিয়েছিল। বাংলাদেশে জাসদ একটি পন্থা অবলম্বন করে ৭৫ এর ৭ নভেম্বর ক্ষমতায় যেতে চেয়েছিল। তারা যদি সফল হতো তাহলে দেশের পরবর্তী ইতিহাস অন্যরকম হতো। বিএনপি এবং জাতীয় পার্টিও (দল গঠনের আগেই) একটা পন্থায় ক্ষমতায় গিয়েছিল। সম্প্রতি পাকিস্তানে তেহরিক-ই-ইনসাফ নামের তৃতীয় বা চতুর্থ সারির একটি দল ক্ষমতায় গেছে।

ক্ষমতায় যাওয়ার এসব পন্থাকে একেকজন একেক নাম দিয়ে থাকে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নাম দেওয়া হয় '… বিপ্লব'। আওয়ামী লীগও একটি পন্থায় এবার সংসদে এবং সরকারে একচেটিয়া অবস্থান নিয়েছে। তাদের এই পন্থাটির আমি কোনও নাম দিতে চাইনা। তবে নির্বাচনের নামে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি যা করছিল তার নাম- 'শুধুই ক্ষমতার লড়াই'। এর মধ্যে গণতন্ত্র ছিল বা গণতন্ত্র সুসংহত করার ইচ্ছা ছিল, তা বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। জামায়াত এবং ইসলামী দলগুলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে না। গণতন্ত্র তাদের আদর্শই নয়। বিএনপি চাইছিল, যেভাবেই হোক ক্ষমতায় যেতে এবং ২১ অগাস্ট গণহত্যার বিচারকে পদানত করে তারেক-বাবরসহ তাদের অনুসারি সবাইকে ক্ষমতায় পুর্নবাসিত করতে। এই ক্ষমতার লড়াইয়ে আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগীরা জয়ী হয়েছে, বিএনপি ও তার সহযোগীরা হেরেছে। এতে ডানপন্থি বিরোধীদল দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে গেছে।

এখন সংসদে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ। সরকার গঠনে কোনও দলের বা জোটের সমর্থন নেওয়ার কোনও প্রয়োজন আওয়ামী লীগের নেই। সঙ্গত কারণে তারা সে পথেই এগিয়েছে। জোটের সঙ্গে কী, সরকার গঠনে নিজ দলের সঙ্গেও আলোচনার প্রয়োজন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব মনে করেনা। নতুন বাস্তবতায় বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং রাজনীতিতে ভিন্নমতের স্থান একেবারে ক্ষীণ হয়ে গেছে। সংসদে বিরোধীদলের কার্যকর অস্তিত্ব দেখছি না। এখন নির্বাচিত বাম নেতারা যদি নিজেদের ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষাকে দূরে ঠেলে সাহস করে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে একটা অবস্থান নেয়, তাহলে একটা ন্যূনতম সম্ভাবনা তৈরি হয়। এর জন্য দলগত ও আইনগত যে ভিত্তি দরকার সেটাও দুর্বল। আওয়ামী লীগের প্রতীক নিয়ে এবং শুধু আওয়ামী লীগের শক্তির উপর নির্ভর করে যারা সংসদে গিয়েছেন, তাদের বিরোধিতা আওয়ামী লীগ মেনে নেবে কেন? এজন্য প্রয়োজনে প্রাপ্তিটাকেও ছেড়ে দেওয়ার সাহস বাম নেতাদের থাকতে হবে।

মেনন, ইনু…, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে কী আপনাদের বিন্দুমাত্র ভিন্নতা নেই? যদি ভিন্নতা না থেকে থাকে, তাহলে কেন আওয়ামী লীগে যাচ্ছেন না? আর যদি ভিন্নতা থাকে, তাহলে ভিন্ন অবস্থান নিচ্ছেন না কেন? আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধীদল হিসেবে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি নয়, অধিকতর প্রগতিশীল শক্তির হাল ধরার সময় কখন আসবে? ১৪ দলের শরিক সবগুলো দলের জন্য আমার একই কথা। নিজস্ব ফোরামে এই কথা অনেকবার বলেছি। আজ আবার বলছি, ভাল হয় ১৪-দলের নেতারা যদি সকল প্রকার পদ-পদবীর আকর্ষণ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক-সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা বিকশিত হওয়া দরকার। জনগণের মাঝ থেকে নতুন শক্তির উত্থান হওয়া দরকার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষে রাজনীতিকে প্রবাহিত করতে হলে এর কোনও বিকল্প নেই।

সরকার গঠনের ক্ষেত্রে জোটের সঙ্গে কোনও আলোচনার প্রয়োজন আওয়ামী লীগ এর আগেও দেখায়নি। যারা মন্ত্রী হয়েছিলেন, তারা মন্ত্রী পরিষদ সচিবের একটি ফোন পাওয়াকেই নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন হিসেবে ধরে নিয়েছেন। সরকারে যোগ দেওয়া বা না দেওয়ার প্রশ্নে রাজনৈতিক পর্যায়ে কোনও আলোচনার ব্যাপারই ছিলনা। বরং কোনও একটি পদ-পদবীর আশায় আওয়ামী লীগের সহযোগী বামদলগুলোর কতিপয় নেতাকে যেভাবে ব্যক্তিত্বহীন র্ধণা দিতে দেখেছি, তা দেখে বিতৃষ্ণাবোধ হয়েছে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যে রাজনীতিক এবং রাজনীতির সঙ্গে আমার বোধ, বুদ্ধি ও আবেগপূর্ণ অবস্থান, তাতে চির ধরেছে। আমার মনে হয়, এটা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়েছে। তবুও মনে করি, ঘুরে দাঁড়াতে হবে, দেশের প্রয়োজনে…. সবাইকে।

আমার একটা ভয় ছিল, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি এর হাত ধরে অনেক অতি প্রতিক্রিয়াশীল দল ও ব্যক্তি এবার বড় রকমের রাজনৈতিক শক্তি পাবে। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি বলে স্বস্তিবোধ করছি। বরং আওয়ামী লীগের হাত ধরে বাম ধারার দুটি দল – ওয়ার্কার্স পার্টি এবং জাসদ থেকে বেশ কয়েকজন নেতা সংসদ সদস্য হয়েছেন। এভাবে নির্বাচিত হলে দলীয় স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখা, কিংবা মানুষের কাছে নিজেদের আলাদা রাজনীতি পৌঁছানো কঠিন। তবুও ভরসা রাখতে চাই।

বিদ্যমান রাজনীতিতে বহুধাবিভক্ত বামদলগুলো দুইটি ধারায় অবস্থান নিয়েছে। যে ধারাটি আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে আত্মবিসর্জনের মধ্যে আছে, তাদের প্রতি আশা রেখে এতক্ষণ যা বলার বললাম। কেউ গায়ে মাখবে বলে মনে হয় না। এবার বলবো সিপিবি-বাসদের কথা, যারা আওয়ামী লীগ বিরোধিতায় ক্ষেত্রবিশেষে চরমপন্থার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

নব্বইয়ের দশকে সিপিবি খণ্ডবিখণ্ড হয়ে দলটির তৎকালীন সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক গণফোরামে, সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নাহিদ আওয়ামী লীগে এবং দলের পাঁচ সংসদ সদস্যসহ অন্যান্য বড় নেতাদের অধিকাংশ সিপিবি ছেড়ে বিভিন্ন দলে যোগ দেওয়ার পর সিপিবির মূলধারা হিসেবে টিকে যায় মনজুরুল আহসান খান এবং মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের নেতৃত্বাধীন বর্তমান পার্টি। তখন থেকেই সিপিবি আওয়ামী-বান্ধব অবস্থান ছেড়ে দিয়ে একলা চলো, কিংবা নানাবাম ও মধ্যপন্থি নিয়ে আওয়ামী-বিএনপির বাইরে বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার ঘোষণায় লেগে আছে। সিপিবি-বাসদ এবারের নির্বাচনেও স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখায় ভাল হয়েছে বলেই আমার মত। দুই জোটের একটিতেও যোগ না দিয়ে নিজেদের বক্তব্য নিয়ে তারা মানুষের কাছে গেছেন। এর ফলে তারা নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেও একটি মিনমিনে স্বতন্ত্রধারার অস্তিত্ব টিকে রইল। এই মিনমিনে ধারাটিকে শক্তিধর ধারায় পরিণত করার জন্য বলিষ্ঠ ও প্রজ্ঞাবান নেতৃত্ব চাই।

জাতীয় সম্পদ রক্ষায় এবং মানুষের পক্ষে বিভিন্ন আন্দোলনে বাম আন্দোলনের এই ধারাটি যথেষ্ট সক্রিয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ের দুইটি আন্দোলনে এই ধারার বাম নেতাকর্মীদের অবস্থান কটূ বলেই আমার মনে হয়েছে। সরকারি চাকরিতে 'ইতিবাচক পক্ষপাতে'র প্রগতিশীল ধারণা বিসর্জন দিয়ে সিপিবি-বাসদের নেতাকর্মীরা যখন একটি প্রতিক্রিয়াশীল দাবির পক্ষে সক্রিয় বা উস্কানিমূলক মদদ জোগায়- তখন সেটা রাজনীতিতে শুভচিন্তার অনেক বড় পরাভব। প্রতিক্রিয়াশীল দাবির সঙ্গে গণসম্পৃক্ততার সবচেয়ে বড় নজির হল সাম্প্রতিক কোটা বিরোধী আন্দোলন। সেই জোয়ারে গা ভাসিয়েছিল বামরাও। কোটা ব্যবস্থার পক্ষে বামপন্থি দলগুলো এখন পর্যন্ত কোনো প্রগতিশীল প্রস্তাবনা প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়েছে। সমাজের পিছিয়ে পরা অংশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রণোদনামূলক বিকল্প কোটা ব্যবস্থার প্রস্তাবনা কই? চিন্তাচেতনায় বামপন্থিদের এতটা দেউলিয়াত্ব অতীতে দেখা যায়নি।

দ্বিতীয়ত, একটি অপরাধমূলক সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েকজন ছাত্রের বিয়োগান্তক পরিণতিতে আবেগতাড়িত তারুণ্য যখন মাঠে নামল, তখন সেই আন্দোলনকে সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ দেওয়ার জন্য বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সিপিবি-বাসদ নেতা কর্মীরাও নির্বিচারে হাওয়া দিতে শুরু করেছিলেন। বিএনপি-জামায়াতের উদ্দেশ্য ছিল সরকারকে ফেলে দিয়ে নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ প্রশস্ত করা। বাম নেতাদের উদ্দেশ্যটা কী ছিল?

ছাত্রদের আবেগের যৌক্তিকতা ছিল সন্দেহ নেই। গণপরিবহণে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার যে দাবি, সেটাও ছিল যৌক্তিক। কিন্তু এই আন্দোলনের শেষ কী? সরকার পতন আন্দোলন? নিশ্চয় ছাত্রদের একসময় ঘরে ফেরার দরকার ছিল। দাবি বাস্তবায়নের মাধ্যমেই আন্দোলন সমাপ্ত হওয়ার কথা। সেটা না করে ছাত্রদের সুনির্দিষ্ট দাবির আন্দোলনকে সরকার পতন আন্দোলনে রুপান্তর করার চেষ্টা ছিল। এটা মূলত তারুণ্যের আবেগকে রাজনীতিতে অপব্যবহারের প্রতারণামূলক কৌশল। এটা নৈতিক রাজনীতি হতে পারেনা। এর মধ্যে জামায়াত-বিএনপি এর ফায়দা লাভের সম্ভাবনা থাকলেও বামপন্থিদের কী প্রাপ্তিযোগ- তা আমার মাথায় ঢোকেনি। সৎ রাজনীতিবিদরা 'শুধুই সরকার বিরোধী' চিন্তা থেকে প্রতিহিংসার পথে হাঁটেনা। এরকম সংকটে বরং সরকারকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে যাওয়াই সৎ রাজনীতি।

এই উভয় আন্দোলন সামাল দিতে সরকার শক্তি প্রয়োগ করেছিল। পুলিশ ও দলীয় কর্মীরা একযোগে হামলা চালিয়েছে। ফলে তারুণ্যের বিরুদ্ধে অগণতান্ত্রিকভাবে সামর্থ্য প্রদর্শনের নতুন নজির তৈরি হয়েছে। ছাত্রদের রাজপথ থেকে সরিয়ে নেয়ার এবং শান্তি পুন:স্থাপনের জন্য গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টা গ্রহণে দেশের রাজনীতি সামগ্রিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র সজীব রাখা রাজনীতিবিদদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিএনপি বাইরের চাপ সামাল দিয়ে এবং দলের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সুগঠিত শক্তি হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে হিমশিম খাবে। জামায়াত এবং ধর্মভিত্তিক অন্যান্য দলের জন্য দেশের মাঠ বেশি উর্বর। তবে ইসলামপন্থি বা মৌলবাদী রাজনীতির জন্য আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক সবগুলো শক্তি প্রতিকূল। তা সত্ত্বেও এই রাজনীতি যদি বড় হয়ে ওঠে তাহলে সংঘর্ষ ও রক্তক্ষয় অনিবার্য – যা কোনও মতেই কাঙ্ক্ষিত নয়। এই মুহূর্তে শক্ত বিরোধীদল হিসেবে বামরা অবস্থান নিতে পারবে- তার কোনও লক্ষণ দেখছিনা। তবুও বলছি, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই করার জন্য এবং একাধারে উন্নয়ন ও গণতন্ত্র বজায় রাখার জন্য আকাঙক্ষা দরকার। এজন্য ব্যক্তি আকাঙ্ক্ষা এবং বিদ্বেষ দুটোই পরিহার করা জরুরি।