শ্যামাসুন্দরী খাল বাঁচাতে সোচ্চার নগরবাসী

সজীব হোসাইন
Published : 28 Nov 2016, 05:03 PM
Updated : 28 Nov 2016, 05:03 PM

এক সময় মানুষের কাছে আশীর্বাদ বলে গণ্য হতো রংপুরের ঐতিহ্যবাহী শ্যামাসুন্দরী খাল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় এখন তা পরিণত হয়েছে অভিশাপে পরিণত হয়েছে। ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে রংপুর শহরের অধিকাংশ এলাকা ছিল জঙ্গলাকীর্ণ নিম্নাঞ্চল। শহরে ম্যালেরিয়া, পাণ্ডুরোগ ও প্লিহা রোগের প্রাদুর্ভাব ছিলো অতিমাত্রায়।

রাজা জানকি বল্লভ ছিলেন রংপুর পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান। তিনি ১৮৮১ সালে রাজা উপাধি লাভ করেন এবং ১৮৮৫ সালে নবগঠিত রংপুর জেলা বোর্ডের সদস্য হন। সে সময়কার সিভিল সার্জন পি এইচ বোনারের এক মন্তব্য প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, সমগ্র জেলার ভূমিস্তর ছিল নিচু। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। এর ফলে মশার উপদ্রপ দেখা দিত এবং ম্যালেরিয়া রোগ ছড়িয়ে পড়ত।

১৮৫২ সালে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে  মৃত্যুবরণ করেন রাজা জানকি বল্লভের মা শ্যামাসুন্দরী। মায়ের মৃত্যু জনিত সন্তাপ এবং নগরবাসিকে ম্যালেরিয়া রোগ থেকে বাঁচানোর অভিপ্রায়ে রাজা জানকি বল্লভ রংপুর শহরের পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে উন্নত করার লক্ষ্যে শহরের মাঝদিয়ে একটি প্রণালী খননের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৮৯০ সালে প্রণালী খননের কাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৮৯৪ সালে। এই প্রণালীর নামকরণ করা হয় প্রয়াত মাতা শ্যামাসুন্দরীর নামে।

শ্যামাসুন্দরী প্রণালী খননের পর রংপুর পৌরসভার জলাবদ্ধতার অবসান ঘটে। পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থার হয় স্থায়ী সমাধান। পরিবেশের উন্নতি ঘটে, মশার উপদ্রব কমে যায় এবং মৃত্যুর হারও কমতে থাকে।

১৯০৮সালের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক যে পঞ্চবার্ষিক জরিপ হয় সেখানে রংপুর শহরকে সমগ্র বিভাগের মধ্যে সর্বাপেক্ষা স্বাস্থ্যকর শহর বলে উল্লেখ করা হয়। রংপুর সদরে মৃত্যুর হার কম হওয়ার পিছনে শ্যামাসুন্দরী প্রণালীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

কথা বললে সত্তর বছর বয়সি মো. রহমত আলী জানান, যুদ্ধের আগেও এই খালের পানি খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার হত। পানি চকচক করত। আর এখন গন্ধ আর মশার উৎপাতে বাড়িতে থাকাই কঠিন।

জনকল্যাণের যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে রাজা জানকি বল্লভ প্রণালীটি খনন করেছিলেন সেই শ্যামাসুন্দরী তা আজ দখলদারদের দখলে এবং সিটি কর্পোরেশনের পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা যোগ হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণ অভাবে দীর্ঘদিন আগে নাব্যতা হারানো খালটি এখন বিলীনের পথে। তবে আশার কথা হলো রংপুর জেলা প্রশাসন নগরবাসীদের সহযোগিতা নিয়ে খালটি পুনরুদ্ধার এবং সংস্কারে জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সিটি কর্পোরেশন, জেলা পরিষদ, এলজিইডিসহ অন্যান্য দপ্তরগুলির সাথে আলোচনা করা হয়েছে। সিটি কর্পোরেশনকে অনুরোধ জানানো হয়েছে খালে সংযুক্ত এলাকায় প্রয়োজনীয় ডাস্টবিনের ব্যবস্থা করার জন্য যাতে খালে কেউ ময়লা না ফেলে। একই সাথে নাগরিক সম্পৃক্ততায় যোগ হয়েছে তরুণদের নিয়ে নাগরিক সাংবাদিকতা। ইতোমধ্যে ৪৯ জন সদস্য নিয়ে খালের বিভিন্ন স্থানে বসানো হয়েছে জেলা প্রশাসনের ডাস্টবিন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঐতিহ্যবাহী খালটি সংস্কার ও এর দুপাশের সৌন্দর্য বাড়াতে ২৫ কোটি টাকা খরচ করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। তবে, অনিয়মের কারণে পুরোটাই গচ্ছা গেছে। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে স্থানীয় সরকার বিভাগের কেউ কিছু বলতে রাজি হননি।

এ ব্যাপারে নাগরিক সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে গত ২২ নভেম্বর রংপুর জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার বলেন, 'নতুনভাবে গড়ি শ্যামাসুন্দর শ্যামাসুন্দরী' স্লোগান নিয়ে সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা এই নান্দনিক খালটি পুনরূজ্জীবিত করবো। কারণ শ্যামাসুন্দরী খাল শুধু রংপুরে নয়, গোটা বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য খালের একটি।'

তিনি জানান বলেন, 'ইতোমধ্যে নগরবাসীর সাথে খালটি নিয়ে একাধিকবার মতবিনিময় করেছি। সবাই চায় খালটি আবার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাক। শ্যামাসুন্দরী খাল রংপুরের একটি বৃহৎ সম্পদ। এটাকে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সবার। তাই তিনি সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।'

এলাকাবাসী জানান, 'শ্যামাসুন্দরীকে ঘিরে সিটি করপোরেশন বাসীর বিনোদনের ব্যবস্থাও হতে পারে। প্রণালীর দুই ধারে বৃক্ষরোপন করে মানুষের বসবার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পানিতে বোটিং-এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ থেকে যেমন শহরের মানুষ বিনোদন লাভ করতে পারবে পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশন এর আয়ের একটি খাত সৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া প্রণালীতে মাছ চাষ আয়ের একটি ভাল উৎস হতে পারে।'

'একইসাথে উৎসমুখ ও শেষ অংশে আধুনিক প্রযুক্তির সুইচ গেইট স্থাপনের মাধ্যমে স্বচ্ছ পানি প্রবাহের মাধ্যমে মাছ চাষ করা যেতে পারে। আর এতে যেমন লাভবান হওয়া সম্ভব তেমনি মশাসহ পানি বাহিত রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।'

এ ব্যাপারে কথা বললে রংপুর সিটি মেয়র সরফুদ্দিন আহম্মেদ ঝন্টু বলেন, 'দীর্ঘদিন খনন না করায় খালটি ময়লা-আবর্জনায় ভরে গেছে। এর বদ্ধ, পচা পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে এবং এতে অবাধে মশার বংশবিস্তার হয়েছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য এটি এখন এক বড় হুমকি। ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটি সংস্কার করতে আরো ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা লাগবে। একই সাথে তিনি খালটি পুনরুদ্ধার এবং সঠিক রক্ষণাবেক্ষণে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।'