নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে বিভিন্ন দেশে যখন সংকটের শুরু তখনও বাংলাদেশে এতটা আতংক ছড়িয়ে যায়নি। ঠিক সেরকম একটা সময়ে ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে গেলাম কলকাতা। থাকতে হবে এক মাস। উদ্দেশ্য সত্যজিত রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে (এসআরএফটিআই) ডিজিটাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্টের ওপর একটি সংক্ষিপ্ত কোর্সে অংশ নেওয়া।
খুব উৎসাহ নিয়ে ক্লাস শুরু করলাম আমরা বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ১৬ জন সাংবাদিক। কিন্তু দিন দিন করোনাভাইরাস নিয়ে যত খবর পাচ্ছিলাম তাতে আশঙ্কা বাড়তেই থাকলো। একসময় ভারত ভিসা স্থগিত করে দিলো। বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিলো বিদেশ থেকে যেই দেশে ফিরবে তাকে বাধ্যতামূলক হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে।
কলকাতায় যতটুকু এদিক-ওদিক যেতাম সেটাও বন্ধ করে দিলাম। মেট্রোতে ওঠা একটু আগেই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। নিউ মার্কেট এলাকা, কলেজ স্ট্রিট যাওয়াও হলো না। ভাগ্য ভালো কিছু ওষুধ কেনার ছিলো সেটা আগেই সেরে ফেলেছিলাম। ক্লাস শেষ করে এসআরএফটিআইতেই আড্ডা। সেখানে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী মুয়িদ আর ওপার বাংলার অর্ক প্রচুর সময় দিয়েছে।
দেশে ফেরার বেশ আগেই নির্ধারিত এয়ারলাইন্স তাদের সূচি স্থগিত করলো। ফেরা হলো অন্য এয়ারলাইন্সে। এয়ারপোর্টে প্রাথমিক পরীক্ষা করে বলে দেওয়া হলো ১৪ দিন ঘরে থাকতে হবে।
এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হবে বুঝতে পেরেই আগেই এক বন্ধুকে বলে রেখেছিলাম নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস যেমন ডাল, চাল, পেঁয়াজ, ডিম ইত্যাদি যেন পৌঁছে দেয়। তিনি দিয়েছিলেন বলেই খেতে পাচ্ছি এখনও।
গণমাধ্যমের একজন প্রতিবেদকের জন্য সম্পূর্ণ ঘরে বসে থাকাটা যে কত কষ্টের সেটা আমার পেশার লোকমাত্রই বুঝতে পারবেন। অন্য অনেক পেশায় ঘরে বসে কাজ করা যায়। কিন্তু একজন রিপোর্টার কীভাবে করবেন? তার ওপর কোনো ধরনের মানুষের সংস্পর্শে আসা যাবে না। এ যেন আরেক যুদ্ধ। পুরো বিশ্বই এই যুদ্ধ করছে।
আমি ঢাকা শহরের যে বাসায় থাকি সেখানে একাই বসবাস করি। রান্না নিজেরই করতে হয়। ঘরের অন্য কাজ তো আছেই। এদিকে বাজারে যাওয়া নিষেধ। প্রতিদিনকার প্রয়োজনীয় ওষুধ আগেই কেনা ছিলো বলে এখন পর্যন্ত রক্ষা। ওষুধ শেষ হলে কী হবে সেটাই ভাবছি।
একটি সুপারশপে অনলাইন কেনাকাটার সুযোগ আছে বলে কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় বাজার করতে পেরেছি। কিন্তু এখানেও তো মানুষের সংস্পর্শে আসতে হচ্ছে। আবার এমনও নয় যে যা অর্ডার করছি তাই পাচ্ছি। হয়তো একটা মাছের অর্ডার করলাম, দেখা গেল সেটা পাচ্ছি না। কিংবা সাবান চাইলাম যেটা, সেটা ওদের মজুতে নেই। অনলাইনে পেমেন্ট করার এটাও একটা ঝামেলা। অন্য সময় হলে সাধারণত এ সমস্যা হতো না।
ডেলিভারির লোক বাসার নীচে আসলে প্রথমে জিনিসপত্র রাখতে বলছি। তারপর টাকা এমনভাবে দিচ্ছি যাতে তার আর আমার মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব থাকে। ঘরে ফিরে সাবান আর স্যানিটাইজার ব্যবহার তো রয়েছেই।
এরকম অবস্থার মধ্যেই দিন কাটছে। কাজ করছি একটু ভিন্নভাবে। রিপোর্টার হিসেবে প্রতিদিন যেসব সোর্সের সঙ্গে দেখা হতো, এখন তাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখতে হচ্ছে। সরকারের প্রেস রিলিজ, মন্ত্রীদের ভিডিও ফেইসবুকে পাওয়া যাচ্ছে। সেগুলো থেকে খবর তৈরি করা লাগছে। সবটাই যে আমি করছি এমন নয়। আমার সহকর্মীরাও করছেন। সবকিছু মিলিয়ে একটি ২৪ ঘণ্টার সংবাদ মাধ্যম চলছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই আগে ভাবতাম আজ কী অ্যাসাইনমেন্ট আছে সেটা নিয়ে। আর এখন? পুরো দিন কাটাবো কী করে সেটা ভেবে। শুরুটা হয় গান দিয়ে। আমার মত মানুষের জন্য রবীন্দ্রনাথ অনেক কিছুই লিখে এবং সুর করে গেছেন। নজরুল ইসলাম রেখে গেছেন অনেক কিছু। হিমাংশু দত্ত, শচীন দেব বর্মন, সলিল চৌধুরী, সুধীন দাশগুপ্ত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষ, রবীন চট্টোপাধ্যায় তো রয়েছেনই।
আগে সকালে উঠে খাবার তৈরি করে খেয়ে কখন বের হব সেটার একটা তাড়া থাকতো। এখন নেই। তাই একটু করে আলস্য উদযাপন করছি। 'ধীরে বহে' নদীর মত সব কাজ একটু ধীরে। খাওয়া শেষ, তারপর খবর নিয়ে পড়ে থাকা। অফিস কাজ দিলে সেটা করা। নিজের কাজের জায়গাগুলোর খবরাবর রাখা। এসব করতেই দুপুর। হয় আগে রান্না করা খাবার গরম করে খাওয়া না হয় ওই কাজের (!) ফাঁকে রান্না করে নেওয়া।
দুপুরে বই, বিকেলে বই, সন্ধ্যার পর সিনেমা বা সিরিজ। তবে সমস্যা একটা হয়েছে। এসআরএফটিআই ছোট্ট একটু ক্ষতি করেছে। সিনেমা দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটা বদলে দিয়েছে। নিছক বিনোদনের জন্য সিনেমা দেখার জন্য বসলেও খুঁটিয়ে দেখার অভ্যাস করে দিয়েছে। আর সেই সাথে সিনেমা বা সিরিজের মধ্যে কোনো ব্র্যান্ডের প্রমোশন হচ্ছে কি না সেটা খুঁজে বেড়াচ্ছি। এই এক জ্বালা! আগে সিনেমা বা সিরিজের ট্রেইলার বা প্রোমো ওরকমভাবে দেখতাম না, এখন খুঁজে হলেও দেখছি।
সবচেয়ে বড় যে কাজটা করতে হচ্ছে সেটা হচ্ছে নিজের সাথে একটা যুদ্ধ। একা থাকতে থাকতে প্রচণ্ড বিরক্ত লাগে। হতাশ হয়ে পড়তে হয়। হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এটি। প্রতিনিয়ত একটা হতাশা গ্রাস করে। সবকিছুর ওপর বিরক্তি তৈরি হয়। কোনো কিছু কিনতে যেতে পারছি না। বাসার কাছের দোকানদার জানে আমি বিদেশ ফেরৎ। অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকাবে, তাই যাই না। যাওয়া উচিতও না। কোনো কোনো সময় যুক্তিবোধটাই হারিয়ে যেতে বসে। আবার শান্ত হতে হয়। এই যে কাজটা সেটা একারই করতে হচ্ছে।
যাই হোক, নতুন ভোর আসবে। মানুষ বারবার ঘুরে দাঁড়ায়। এবারও দাঁড়াবে। যদিও মূল্য দিতে হচ্ছে অনেক। শেষে একটাই কথা বলবো সাবধানে থাকুন, যতদূর সম্ভব আলাদা থাকুন। যারা এখনও ভয়াবহতা বুঝতে পারছেন না তাদের সুমতি হোক। সংক্রমিত হবেন না, করবেনও না।