অবকাঠামো বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর দাবি বাঁধ নির্মাণের: তথ্য সেবা বুঝে না কুকরী মুকরীর বাসিন্দারা

বীর বাঙালী
Published : 4 Jan 2012, 11:20 AM
Updated : 4 Jan 2012, 11:20 AM

পর্যটনের অপার সম্ভবনাময় দ্বীপের মধ্যে দ্বীপ সাগর কন্যা কুকরী মুকরী। উপকূলীয় জেলা ভোলা থেকে বিচ্ছিন দূর্গম এক জনপথ। ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার একটি ইউনিয়ন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঝুঁকির মধ্যে থাকা এ বিচ্ছিন্ন জনপথের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে এবং দূযোর্গে খবরাখবর জানতে চালু হয় তথ্য প্রযুক্তির সেবা। ২০১০ সালের নভেম্বরে ইউএনডিপি'র প্রশাসক ও নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হেলেন ক্লার্ক এ প্রযুক্তি উদ্বোধনের জণ্য আসেন কুকরী মুকরীতে। কুকরীর ইউনিয়ন পরিষদের ভবনে স্যাটেলাইন ও ইন্টারনেট সেবায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে কথা বলেন। সে সময় রেড এলার্ট জারি করা হয় পুরো উপকূলীয় এলাকায়। এর আগে চর কুকরী মকরী পরিষদে দেয়া হয় দুটি ল্যাপটব। ইন্টারন্টে কানেকশন। ল্যাপটপ চারালোর জন্য স্থাপন করা হয় সৌর বিদ্যুৎতের। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা খরচ। এ যন্ত্রের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন কুকরী মুকরীর বাসিন্দাদের সুখ দুখের সব খবর জানবে সরকারসহ বিশ্ববাসি। হেলেন ক্লার্ক এ তথ্য সেবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চরকুকরীতে সফরকে ঘিরে রাতারাতি পাল্টে ফেলা হয় অহেলিত উন্নয়ন বঞ্চিত জনপথের চেহারা।

দেশের ৪ হাজার ৫শ ১ টি ইউনিয়ন পরিষদে এক যোগে তথ্য সেবা চালু করতে এর উদ্বোধন এর জন্য বেছে নেয়া হয় চর কুকরী মুকরীকে। বুঝানো হয় সরকারের ডিজিটাল সেবা পৌছে দেয়া হচ্ছে সবচেয়ে দূর্গম এলাকায়। কিন্তু যাদের জন্য এতো আয়োজন সে কুকরী মুকরী বাসী জানেনা তথ্য সেবা কাকে বলে। সরেজমিন কুকরীর বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায় এসব তথ্য।

বন্যা জলোচ্ছাস, ডাকাতি ,শোষন, জুলুম, নাগরিক অধিকার বঞ্চিত হওয়া সহ নানা প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা এ মানুষগুলো তথ্য সেবা কাকে বলে তা মর্ম কথা জানতে চায়না। নিরাপত্তা ও মৌলিক চাহিদা কাকে বলে তাও জানেনা। শুধু এটা জানে খেয়ে পরে শন্তিতে বেঁচে থাকা। চরের উন্নয়ন, বন্যা নিয়ন্ত্রন বাধ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনের নিরাপত্তা। তাদের দাবী বহু পুরোনো এ চরে এতো মানুষ ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকতে হলে সবার আগে প্রয়োজন বাধেঁর। কোন বাধঁ না থাকায় সামান্য জোয়ায়ে ঢুবে যায় বাড়িঘরসহ চরের রাস্তাঘাট। চলাচলের জন্য ভালো কোন রাস্তা নেই চরে। এছাড়া বড় ধরনের অসুখে পড়লে চিকিৎসা সেবার জন্য কোন ডাক্তার নেই। ছেলে মেয়েদের পড়ালেখার জন্য কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগন্য। নদীতে ডাকাতির কারনে নিরাপত্তা নিয়ে মাছ শিকার করতে পারেনা জেলেরা। প্রকৃত সুবিধাভোগিরা বয়স্কভাতা,ভিজিডি ভিজিএফ সুবিধা থেকে সবসময় বঞ্চিত থাকে। এসব সুবিধা লুটে নেই ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা। এমন অভিযোগ চরবাসির। যোগাযোগের কোন আধুনিক ব্যবস্থা নেই। ঝুঁকি নিয়ে এখনো তাদের চলাচল করতে হয়। ২০ হাজার পরিবাররের জন্য প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলায় পর্যপ্ত সাইক্লোন সেল্টার নেই। এতোসব না থাকার মধ্যে তথ্য সেবা তাদের কি কাজে আসবে প্রশ্ন অনেকের।

চর ককরী মুকরীর অবস্থানঃ
ভোলা জেলা সদর থেকে সর্বদক্ষিনে বঙ্গোপো সাগরের কোলঘেষা মেঘনার বুকে বেসে আছে চর কুকরী মুকরী। কুকরী মুকরী নামে সাথে থাকা চর শব্দটি এখন ব্যবহার করা না হলেও এখনো সকলে এটিকে চর কুকরী মুকরী হিসেবেই চিনে। প্রায় ৪৫০ বছর আগে সাগরের কুলে মেঘনার বুকে জম্ম নেই এ চরটি। তখন এ চরে কোন বসতি ছিলো না। ১৯০৪ সালে চর কুকরীতে মুকরীতে প্রথম বসতি শুরু হয় মানুষের। কিন্তু নামকরন হয় তারও অনেক পরে । অর্থাৎ১৯১২ সালে এ চরে পাখি শিকারে আসেন প্রিন্স ব্রাউন নামে এক বিট্রিশ যুবরাজ। সেই মূলত এ চরের নাম রাখেন কুকরী মুকরী। তখন এ চরে পটুয়াখালীর আওতায় থাকলেও ১৯৭৪ সালে এটি চরফ্যাশন উপজেলার আওতায় আনা হয়্। ইউনিয়ন পরিষদ হিসেবে এ চর স্বীকৃতি লাভ করে১৯৯২ সালে। পুরো ইউনিয়নের আয়োতন ৪০.৩৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে কুকরী মুকরী বাজার ১৫ বর্গ কিলোমিটার। বর্তামানে এ চরে ২০ হাজার লোকের বসতি। ২০ হাজার একর জমি থাকলেও চাষযোগ্য জমির পরিমান মাত্র ৫ হাজার একর।শিক্ষার হার মাত্র ১৮.৫৫ ভাগ। স্বভাবগত কারনে এ চরে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ অনেক কম। তবে ১৯৩৮ সালে প্রথম একটি প্রাথমিক স্কুল করা হয় এ চরে। জেলে পেশার মানুষই এ চরে বেশি। বাকীরা কৃষিসহ অন্যান্ন পেশার সাথে জড়িত। এ চরে কোন বাধ না থাকায় জলোচ্ছাস বা বন্যায় বাড়িঘরসহ পুরো চর তলিয়ে যায়। তখন বসবাসকারী মানুষকে পানিতে ভেসে কাটাতে হয় কয়েকদিন। এছাড়া রাস্তাঘাট নেই । আশ্রয়য়ের জন্য কোন পর্যাপ্ত সাইক্লোন নেই। বিদ্যুৎ নেই। চরফ্যাশন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় যোগাযোগ খুবই দূর্গম। কোন খবরের কাগজ বা সংবাদ জানতে পারে না চরের মানুষ। ট্রলারযোগে ১ ঘন্টা পাড়ি দিয়ে চরকচ্ছপিয়া ঘাটে আসলে সেখান থেকে আরো দেড় ঘন্টা পথ গাড়ি দিয়ে উপজেলা শহরে আসতে সময় লাগে চর এলাকার মানুষের। প্রধান যোগাযোগ ট্রলার । একটি ছোট্র লঞ্চ থাকলও তা খুবই ঝুকিপূর্ণ। এ চরে এক তৃতীয়ংশ মানুষ পটুয়াখালীর গলাচিপা ও বাউফল উপজেলার বিভিন্ন এলাকার। তবে তারা সবাই চরফ্যাশন উপজেলা অর্থাৎ চরকুকরী মুকরীরর ভোটার। বসবাসকারী পরিবারগুলোর মধ্যে অনেকে ভূমিহীন। এখনো অনেক পরিবার আছে যারা সরকারের খাস জমিতে বসবাস করছে। নানা জটিলতায় জমির বন্দোবস্ত পায়নি।

চরের উপকূলীয় বন এলাকায় বর্তমানে প্রায় ২ লাখের বেশি হরিন রয়েছে। এছাড়া জঙ্গি মহিশ গরুসহ রয়েছে জন্তু জানোয়ার। প্রতিবছর শীতে এ চরের আশে পাশে বসত গড়ে অতিথি পাখিসহ দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। এ ইউনিয়নের আওতায় চরপাতিলা ডালচর নামে আরো দুটি চর রয়েছে। তবে ঢালচরকে আলাদা ইউনিয়ন করা হয়েছে বেশ কয়েকমাস আগে। বছরে শুধু আষাঢ় থেকে পৌষ মাস এ ৬ মাস ধান চাষ হয় চরে। বাকী সময় লবন পানির জন্য চাষ করা যায় না। চর কুকরী মুকরীতে কুকরী বাজার , মনুরা ও ডাকাইত্তাসহ ৩ টি বাজার রয়েছে। এর মধ্যে মনুরা ও ডাকাইত্তা বাজার চালু থাকে বর্ষার সময়। ওই সময় এ বাজারে শুরু মাছ কেনাবেচা হয়। এসব তথ্য চরের বসিন্দা মোঃ জাফর, শান্তি রঞ্জন জেলে রফিকুল সহ আনেক জানান। তারা আরও জানান কালা বাদশার নেতৃত্বে চলে নদীতে জাকাতি। প্রতিদিন জেলেদের নৌকা মাছ নিয়ে যায় তারা। মুক্তিপন দিয়ে ফিরে আসতে হয় অপহরন করা জেলেদের।

এলাকা বাসীর দাবীঃ দিনমজুর রত্তন, ব্যবসায়ি জামালসহ অনেকের একটাই দাবী তথ্য প্রযুক্তির আগে চরের উন্নয়ন করা দরকার। নদীতে ডাকাতি বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তথ্য প্রযুক্তির সুফল জেলে চাষী ও দিন মজুররা কোন দিনই পাবে না। এগুলোর চেয়ে দরকার বাধ, রাস্তাঘাট ও সাইক্লোন সেল্টার চিকিৎসা সেবা ও নিরাপত্তা।