‘অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা’: আজ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস

বীর বাঙালী
Published : 9 Jan 2012, 06:47 PM
Updated : 9 Jan 2012, 06:47 PM

''মৃত্যুর দুয়ার ভেঙে অমরত্ব লভিয়াছ/তুমি জ্যোতির্ময়/পূর্ণ কর স্বাধীনতা মুক্ত কর ভয়/ তোমারই আজ জয়।'' ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি আজ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বিজয় অর্জনের পর ১৯৭২ সালের এই দিনে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে রক্ত­াত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন।

জীবন-মৃত্যুর কঠিন চ্যালেঞ্জের ভয়ঙ্কর অধ্যায় পার হয়ে সারা জীবনের স্বপ্ন, সাধনা ও নেতৃত্বের ফসল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে মহান এ নেতার প্রত্যাবর্তনে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় পূর্ণতা পায়। এ কারণেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি একটি অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। স্বয়ং জাতির জনক তাঁর এ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন 'অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা।'

১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন- 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণার পর ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। অপারেশন সার্চলাইট নামের এ অভিযানের শুরুতেই পাক হানাদাররা বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানমণ্ডির বাসা থেকে বন্দী করে নিয়ে যায়। গ্রেফতারের আগমুহূর্তে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু।

গ্রেফতার করে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী করা হলেও তাঁর অনুপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর নামেই চলে মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালি যখন প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলেছে, বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে প্রহসনের বিচারে ফাঁসির আসামি হিসেবে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সেলের পাশে তাঁর জন্য কবর পর্যন্ত খোঁড়া হয়েছিল। কিন্তু বাঙালির স্বাধীনতা, মুক্তির প্রশ্নে ফাঁসির আসামি হয়েও বঙ্গবন্ধু ছিলেন অবিচল, আপোসহীন। স্বাধীনতাকামী জনতা দীর্ঘ নয় মাস মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশকে স্বাধীন করার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতেও বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তোলে।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলেও বাঙালি জাতির মনে ছিল না স্বস্তি, বিজয়ের আনন্দ। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী জাতির জনকের ভাগ্যে কী আছে- এ নিয়ে এ ভূখণ্ডের প্রতিটি মানুষ ছিল বিচলিত, আতঙ্কিত। চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়ার পর বিশ্বনেতারা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। পরে পরাজিত পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত বন্দীদশা থেকে বঙ্গবন্ধুকে সসম্মানে মুক্তি দিতে বাঁধ্য হয়।

বাঙালি জাতির মহান এক বিজয়ের ফলেই বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ফিরে আসেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর লন্ডন-দিল্লী হয়ে তিনি ঢাকায় পৌঁছান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হানাদারমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন বিজয়ের মালা পরে।

সেদিন বাংলাদেশে ছিল এক মহাউৎসবের আমেজ। গোটা বাঙালি জাতি রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিল কখন তাঁদের প্রিয় নেতা, স্বাধীন বাংলার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রাখবেন। পুরো দেশের মানুষই যেন জড়ো হয়েছিল ঢাকা বিমানবন্দর এলাকায়। বিমানবন্দর থেকে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পর্যন্ত রাস্তা ছিল লোকে লোকারণ্য। অবশেষে বন্দীর নাগপাশ ছিন্ন করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বিজয়ের বেশে নামলেন বিমান থেকে। পা রাখলেন লাখো শহীদের রক্ত­াত স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে। গোটা জাতি হর্ষধ্বনি দিয়ে তেজোদীপ্ত 'জয় বাংলা' সে­াগানে তাঁদের অবিসংবাদিত প্রিয় নেতাকে স্বাগত জানায়।

স্বাধীন প্রিয় বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু। দীর্ঘ ৯ মাস পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের গণহত্যার সংবাদ শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা দেন- "রক্ত দিয়ে হলেও আমি বাঙালি জাতির এই ভালবাসার ঋণ শোধ করে যাব।" কথা রেখেছেন জাতির পিতা। হিংস্র পাক হানাদাররাও যাঁর গায়ে আঁচড় দেয়ারও সাহস দেখাতে পারেনি, স্বাধীন দেশে বাঙালি নামক একশ্রেণীর কুলাঙ্গার-বিশ্বাসঘাতকের হাতে তাঁকে জীবন দিতে হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিজের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর কথা রেখে গেছেন।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। কর্মসূচি যথাযোগ্য মর্যাদায় স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালনে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সংগঠন নিয়েছে বিস্তারিত কর্মসূচি।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি:
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুৃজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসটিকে যথাযোগ মর্যাদায় পালন করতে আওয়ামী লীগ দিনব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
দলীয় দপ্তর সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার সকাল সকাল সাড়ে ছয়টায় দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু ভবন ও সারাদেশে সংগঠনের কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে।
এরপর সকাল ৭ টায় ধানমন্ডির ৩২ নং রোড়ের বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতীকৃতীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হবে। বিকেল তিনটায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভা। জাতীয় সংসদেরন উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিতত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন প্রধানমন্ত্রী এবং দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগে উপ দপ্তর সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু সর্বস্তরের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান জানান। স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যবহিত পর পাকিস্তানের দখলদার সামরিক জান্তা তাঁকে গ্রেফতার করে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে আটক রাখে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের বন্দিশালায় অসহনীয় নির্যাতনের মধ্যে এবং প্রহসনের বিচারে ফাঁসির আসামি হিসেবে মৃত্যুর প্রহর গুণছিলেন। তাঁর জন্য কবর পর্যন্ত খনন করা হয়েছিল।

অপর দিকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে বিশ্বব্যাপী অভূতপূর্ব জনমত গড়ে উঠেছিল। সব মহাদেশের অযুত কোটি মুক্তিকামী মানুষ এবং বিশ্ব নেতারা তাঁর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হলে পাকিস্তানি বর্বর শাসকগোষ্ঠী বাঁধ্য হয়ে তাঁকে মুক্তি দেয়। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির বিজয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি তরান্বিত করে; তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে আমাদের মাঝে ফিরে আসেন। স্বয়ং জাতির জনক তাঁর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে আখ্যায়িত করেছিলেন 'অন্ধকার হতে আলোর পথে যাত্রা' হিসেবে (অ ঔড়ঁৎহবু ভৎড়স ফধৎশহবংং ঃড় ষরমযঃ)।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন, সমবায় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সংগঠনের সব শাখাকে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী, সমর্থকসহ সব শ্রেণী-পেশা এবং সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
[সংবাদের কিছু তথ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ইতিহাস থেকে নেয়া হয়েছে।]

####
কামাল শাহরিয়ার
সহ-সম্পাদক
দৈনিক ভোরের ডাক
০১৭২৫৩৭৫৭৯০