১৫-ই শাবান এর রাতের বিশেষ ফজিলত

সেলিম আহমেদ
Published : 4 July 2012, 04:21 AM
Updated : 4 July 2012, 04:21 AM

ইসলামে যে ক-টা রাত খুবই তাৎপর্যপূর্ণ,তার মধ্যে ১৫-ই শাবানের মধ্যরাত বা লাইলাতুল বারাতের রজনী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক রাত।এই রাতের নফল এবাদত,বন্দেগীর এতো ফজিলত ও মর্যাদা যে স্বয়ং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন রেওয়াতে এর বর্ণনা করেছেন।যদিও আজকের নানান মতাদর্শের আলেম-উলামাবৃন্দ ভিন্ন-ভিন্নভাবে এই রাতের ব্যাখ্যা উপস্থাপণের চেষ্টা করে প্রকারান্তরে নিজেদের অজান্তেই এই রাতের মাহাত্ত্য কিঞ্চিৎ মাত্রা কমানোর সাথে সাথে এই রাতের নফল এবাদত বন্দেগীর কোন বিরুধীতা এখন পর্যন্ত কেউ-ই করেননি।উলামা-মাশায়েখবৃন্দ নানান মতের ও ইজমা ও ক্কেয়াসের ব্যাখ্যায় যৎসামান্য পার্থক্য করতে গিয়ে নফল এবাদত বন্দেগীর সাথে সকলেই একমত পোষণ করেছেন।

হাজার রাত্রির উত্তম এই রাত্রির তাৎপর্য বর্ণনা করতে গিয়ে শো-ইয়াব-ঊওল-ঈমান গ্রন্থে পৃষ্টা নম্বর ৩৮৩,ভলিউম নম্বর ৩ এর হাদিস ৩৮৩৫ এ সাঈয়্যেদূনা মা আয়েশা রাজিআল্লাহু তাআলা আনহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্ললাহু আলায়হিওয়াসাল্লাম থেকে উদ্বৃত করে বলেছেন যে, আল্লাহ আজ্জা ওয়াজাল্লাহ এই রাত্রিতে অর্থাৎ ১৫ শাবানের এই লাইলাতুল বারাতের রাত্রে বান্দার হিসেবের খাতা খুলেন,যারা আল্লাহর দরবারে তিনির ক্ষমা প্রার্থনা করেন,গুনাহের জন্য মাফি চান,আল্লাহ পাক তাদেরকে মাফ করে দেন,এই রাত্রে বান্দাহর আগামী বছরের সকল হিসাব-নিকাশ,জীবন-মৃত্যুর হিসাবনামা,রুজী-রোজগার এককথায় সব কিছু ফেরেস্তাদের কাছে দিয়ে থাকেন।সেইজন্য এই ১৫ শাবানের রাত্রির এতো অধিক গুরুত্ত্বপূর্ণ।

এই রাত্রিতে লোকজন নফল নামায,তাসবীহ,তেলাওয়াত,জিকির-আযগার,কবর জেয়ারত,সালাতুল তাসবীহর নামায পরতে পারেন,তা অধিক মর্যাদা পূর্ণ।

শায়েখ সাঈদূনা কুতুব তার কুতুব-উদ-দীন কিতাবে উল্লেখ করেছেন, শবেবরাতের রাতে চার রাকায়াত নফল নামায,প্রতি রাকায়াতে সূরা এখলাছ ৫০ বার করে একসালামে আদায় করলে আল্লাহ পাক বান্দার ৫০ হাজার বছরের সমপরিমাণ গুণাহ মাফ করে দিবেন।
অন্য এক রেওয়াতে জান্নাতের মালিকীন মা ফাতেমাতুজ-জোহরা রাজিআল্লাহু আনহুমা থেকে শায়েখ কুতুব উ-দ্দীন তার কিতাবে বর্ণনা করেছেন,এই রাতে যে আট রাকায়াত নফল নামায(কোন কোন বর্ণনায় পুরো শাবান মাসের যে কোন রাত বা শুক্রবার রাতে অথবা এই রাতে) একসালামে এবং প্রতি রাকায়াতে সূরা ফাতেহার পরে ১১বার সূরা আল-এখলাস পড়বে,এবং একসাথে একসালামে এই ৮ রাকায়াত নফল নামায আদায় করবে,নামায শেষে রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর সালাম ও দূরুদ পড়ে আম্মাজান ফাতেমা-তুজ-জোহরা রাজিয়াল্লাহু আনহুমার উপর ঈসালে সাওয়াব পেশ করবেন,মা ফাতেমা বলেছেন,যেই পর্যন্ত সেই বান্দা বা বান্দীকে জান্নাতে সুপারিশ করে প্রবেশ করাতে না পারবেন,তিনি সেই পর্যন্ত জান্নাতের গেইটে পা রাখবেননা।

প্রিয় পাঠক ভেবে দেখুন আল্লাহ পাকের কতো বড় নেয়ামত এই লাইলাতুল বারাতের রাতের।এমনিতেই সব রাত্রেরই মর্যাদা বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে,কিন্তু এই বিশেষ রাতের মর্যাদা এবং এর নফল এবাদতের বিশেষ তাৎপর্য যেন আরো বিশেষায়িত হয়ে আছে এই সব কারণে।

আমাদের সমস্যা সংকুল জীবনে কতো রাতইতো আমরা কতো অবহেলা ও হাসি-তামাসা করে পার করে দেই,আমাদের উচিৎ আমাদের সকল কৃত-কর্মের জন্য আল্লাহর দরবারে কায়-মনোবাক্যে আল্লাহর দরবারে তওবা-ইস্তেগফার করে মাফি চাওয়া।কারণ আল্লাহ পাক মাফি চাওয়া,আর তওবাকারীকে বড় পছন্দ করেন।এই জন্য আল্লাহর আরো এক নাম রাহমানুর রাহীম।

এই রাতে নফল এবাদত বন্দেগী করে পরদিন রোযা রাখার মধ্যে বিশেষ ফজিলত বিভিন্ন রেওয়াত ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।সম্ভব হলে ঐদিন, এবং পরেরদিনও রোযা রাখা উচিৎ।কারণ শাবান মাস সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, শাবান মাস হলো আমার(রাসূল সাল্লাল্লাহু)আর রমজান মাস হলো আল্লাহর কাছ থেকে বান্দার তাকওয়া অর্জনের মাস।এই মাসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশী- বেশী করে রোযা রেখেছেন।সাঈদূনা আনাস রাজিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বর্ণনা করেছেন,কোন একজন সাহাবী এসে রাসুনুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এই মাসে এতো বেশী রোযা রাখার কারণ জানতে চাইলে হুজুর এর জবাবে উপরোক্ত কথা উদ্বৃত করে বলেছেন,এই মাসে ১৫ শাবান আল্লাহ পাক বান্দার হিসাবের খাতা ফেরেস্তাদের হাতে দিয়ে দেন,আর আমি চাই আমার খাতা আল্লাহর দফতরে রোযা অবস্থায় উঠুক।রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বলে দোয়া করতেন, হে আল্লাহ আমাকে শাবান মাসের সব ফজিলত দিয়ে মালামাল করে দেও আর রামাদান পর্যন্ত পৌছে দিয়ে এর সমস্ত নেয়ামত দিয়ে বকশিস করে দেও।

তবে এই রাত্রে আল্লাহ পাক আজ্জা ওয়াজাল্লা সব বান্দাদেরকে মাফ করে দিলেও কতিপয় বান্দাদের মাফ করবেননা যেই পর্যন্ত সেই সব হক্ক পরিপুর্ণভবে আদায় করে তওবা-ইস্তেগফার করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলো-

০১) শিরক বা আল্লাহর সাথে শরীক করা
০২) পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান বা বাবা-মাকে কষ্ট বা আঘাত দেওয়া সেই সব ছেলে-মেয়ে
০৩) জেনা বা ব্যাবিভাচার কারী
০৪) মদ-জোয়া-আর সুদ দেওয়া-নেওয়া, গ্রহণ ও গ্রহীতাকারী
০৫) আত্নীয়তার সম্পর্ক যে ছিন্ন করে…

সাঈদূনা আয়েশা রাজিআল্লাহু তাআলা আনহা কর্তৃক বর্ণিত আছে যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,আল্লাহ পাক বিশেষ চার রাত-এ তিনির খাস রহমের দরজা বান্দার জন্য খোলে দেন,আর তা হলো-

০১) ঈদ-ঊল-ফিতর এর রাত
০২) ঈদ-ঊল-আযহার রাত
০৩) ১৫-ই শাবানের রাত-যে রাতে কোন কোন লোক এই আগামী বছর মৃত্যু বরণ করবেন,হজ্জ্ব ব্রত পালন করবেন বলে লেখা হয়ে থাকে
০৪) আরাফাতের বা হজ্জ্বের রাত থেকে ফজর পর্যন্ত।

সহীহ হাদীস থেকে বর্ণিত আছে,এই রাতে কবর জেয়ারত বিশেষ এক ফজিলত,হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এই রাতে জান্নাতুল বাক্কীতে জেয়ারত করেছেন বলে আম্মাজান আয়েশা রাজিয়াল্লাহু তাআলা আনহা থেকে বর্ণিত আছে।

কাণজুল ঈমান কিতাবের ১৬ নম্বর ভলিউমের ২০০ নম্বর পাতায় ৪৫৫৩৬ নম্বর হাদীসে কবর জিয়ারতের ফজিলত বর্ণনা করে উল্লেখ করা হয়েছে, যে কেউ তার পিত-মাতা কিংবা উভয়ের একজনের বা কোন মুসলমানের কবর সওয়াবের নিয়তে কবর জিয়ারত করবে,আল্লাহ আজ্জা ওয়াজাল্লা তাকে গ্রহণযোগ্য হজ্জ্বের সওয়াব প্রদান করবেন,এবং যে কবর জেয়ারত করে,তার মৃত্যুর পরে ফেরেস্তারা তার কবর ভিজিট করবেন।

সুতরাং এই রাতে সকলেরই চেষ্টা করা উচিৎ মা-বাবার কিংবা বুজুর্গানে দীনের বা মুসলমানের কবর জেয়ারত করা।তাছাড়া যাদের মা-বাবা ইন্তেকাল করেছেন,তাদের জন্য ঈসালে সওয়াব ছাড়াও প্রতি শুক্রবারে মা-বাবার কিংবা উভয়ের একজনের কবর জেয়ারত করার বিশেষ ফজিলত রয়েছে,ঐদিন কবর জেয়ারত করে সূরা ঈয়াসীন তেলাওয়াত করলে আল্লাহ পাক গুণাহ মাফ করে দেন বলে বৈরুত এর দার-ঊল-কুতুব-উম্মিয়াহ থেকে প্রকাশিত ঈবনে আদ দ্য জিল ক্কামিল কিতাবের ২৬০ নম্বর পৃষ্টায় উল্লেখ করা হয়েছে।

কোন প্রকারের উৎসব, আতশ-বাজী কিংবা হৈ-হুল্লূড় করে অযথা সময় নষ্ট না করে এবং গুণাহের এই সব কাজ না করে আমাদের সকলের উচিৎ হলো এই রাতে দোয়া-দূরুদ আর নফল ঈবাদত বন্দেগী করে রাত পার করা এবং নফল রোযা রাখা,আত্নীয় বন্ধু এবং বিশেষ করে মা-বাবাকে খুশী করা,যাতে আল্লহা পাক এবং তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে খুশী করা,মনে রাখবেন সকল দোয়ার আগে-পিছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরুদ পড়ে দোয়া শুরু এবং শেষ করবেন,তাতে দোয়া সরাসরি আল্লাহর দরবারে ক্কবুল হবে।আজকের রাতের সকল ফায়দা ও ফজিলত হাসিলের তাওফিক যেন আল্লাহ পাক আপনাকে আমাকে সকলকে দান করেন,আমিন।

Syed Shah Salim Ahmed
Salim932@googlemail.com
tweet@salim1689
4th June 2012/ 14th Shaban)in here in UK).