ব্রিটেনে পড়তে আসা বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের দুর্দশা ও একজন হাফিজের ডিপোর্টেশনের করুন খবর

সেলিম আহমেদ
Published : 10 July 2012, 08:01 AM
Updated : 10 July 2012, 08:01 AM

বর্তমানে ব্রিটিশ সরকারের ইমিগ্রেশনের কড়াকড়ি ও ধরপাকড়ের সুবাধে ও নিয়ম বহির্ভূত কলেজেগুলোর প্রতি কঠোর অবস্থানের কারণে দেশ থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের ব্রিটেনে থেকে পড়া-শুনা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কঠিণ চাপের মধ্যে রয়েছেন।তার উপর যারা ইমিগ্রেশন ও বর্ডার এজেন্সীর সকল শর্তাবলী যথাযথভাবে পূরণ করে লন্ডন শহ বিভিন্ন শহরে অবস্থান করছেন,তাদের টিউশন সহ পড়া-শুনার অনুষঙ্গিক খরচ-পাতি চালানোর ক্ষেত্রে নানা কষ্ট ও বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেন।কমিউনিটির বিভিন্ন সংগঠণ ও নানান পেশার লোকদের দ্বারস্থ হয়ে সমস্যার প্রতিকার চাচ্ছেন,কেউ কেউ মসজিদ,দাওয়াতুল ইসলামী(পাকিস্থান ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতী সংগঠণ) ও তাবলীগ জামায়াতের সাথে মিশে কোন ভাবে নিজেদের জীবন চালানোর প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

চলতি বছর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় গুলো সরকারের নতুন নীতি-মালা অনুযায়ী টিউশন ফি মাত্রাতিরিক্ত হারে বৃদ্ধ্বি করায়,বাংলাদেশ, পাকিস্তান,ভারত, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া,ইন্দোনেশিয়া থেকে নতুন ছাত্র-ছাত্রী আসা একেবারেই প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে।অবশ্য ব্যাতিক্রম চায়নিজদের মধ্যে,এখন পর্যন্ত এই বৎসর আনুপাতিকহারে এশিয়ার অন্যদেশের তুলনায় ব্রিটেনে নতুন ছাত্র-ছাত্রী আসার ক্ষেত্রে চায়না এগিয়ে রয়েছেন।

বছরের এই সময়টাতে বলতে গেলে সকল বাসা-বাড়ী এষ্টেট এজেন্ট এবং অন্যান্য প্রতিষ্টানের মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ্ব সম্পন্ন করার রেওয়াজ থাকলেও এই বৎসর এখনো অধিকাংশ বাসা-বাড়ী,ফ্ল্যাট এবং এজেন্টদের কোঠা উল্লেখযোগ্য ভাবে টার্গেট পূরণে ব্যার্থ হয়েছে।এই তথ্য জানাগেলো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একোমোডেশন অফিস ও লিয়াজো অফিসার ও কিথ পাটিনসন লেটিং এজেন্ট সূত্রে।যদিও সরকার ও অন্যান্য সংস্থা চলমান অর্থনৈতিক মন্দাকে এর কারণ হিসেবে আপাততঃ দেখলেও পিটার হিরণ এষ্টেট এজেন্ট এটাকে বরং অত্যধিক তথা বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের টিউশন ফি ডাবল হারে বৃদ্ধ্বি করার কারণ হিসেবে দেখছেন।আর জব সেন্টারের ষ্টুডেন্ট বিষয়ক এনালিষ্ট মিস আমানডা পিটার হিরণ এজেন্ট এর সাথে আরো যোগ করে বলেছেন,বর্তমান আইনে বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের কাজের কর্মঘন্টার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম বা হ্রাস করার কারণে এবং কোন কোন ক্যাটাগরীতে কাজের সুযোগ একেবারে না থাকার কারণে বিদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের এই স্বল্পতা অন্যান্য বছরের তুলনায় এই বছর কম হচ্ছে বলে তিনি মনে করছেন।

বর্তমানে ব্রিটেনে যেসব বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রী আওবস্থান করছেন,অনেকেই আসার আগে কলেজ কর্তৃক যে সাপোর্ট ও সুযোগ-সুবিধার কথা শুনে এসেছিলেন,এখানে এসে তার একেবারে উল্টোচিত্র দেখতে পেয়ে অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েছেন।তাছাড়া,টিউশন সহ সকল আনুষঙ্গিক ফি পুরোটাই আসার আগে প্রদান করে এসেই যখন দেখলেন,ইউকে বিএ এজেন্সী কর্তৃক তার নিবন্ধনকৃত কলেজ বাতিল বা লাইসেন্স স্থগিত রয়েছে,সুতরাং অনির্দিষ্ট গন্তব্যের অজানা সহযাত্রী হওয়া ছাড়া তাদের আর কোন উপায় থাকেনা।কারণ একজন ছাত্র-ছাত্রী সাথে করে যে টাকা-পয়সা নিয়ে আসেন,তা দিয়ে সামান্য ক-দিন মাত্র চলে,তারপর হন্যে হয়ে খুজতে থাকেন কাজ।আর আজকের ব্রিটেনে কাজের বড় সমস্যা,স্থানীয়রা যেখানে বেকার,সেখানে একজন ছাত্র-ছাত্রী,অথচ যাদের কাজের কোন বিধান নেই,আর যাদের কাজের সুযোগ রয়েছে,উভয়েরই পরতে হচ্ছে বিরুপ অবস্থার মুখোমুখী।আর এই সুযোগে এক শ্রেণীর অসাধু,অতি মুনাফালোভী সে হউক বাংলাদেশী,পাকিস্তানী,ভারতীয় মালিক,যে দেশেরই হউক,ছাত্র-ছাত্রীদের অসহায়ত্ত্বের সুযোগে অধিক কাজ করিয়ে যে বেতন দেন তা মূলত একজন ভিখেরিকে দেওয়ার নামান্তর।এছাড়াও রয়েছে,এক শ্রেণীর ল-ইয়ার যারা ছাত্র-ছাত্রীদের ভিসা নবায়ন ও নতুন কাজের পারমিট প্রদানের সুযোগ করে দেওয়ার নামে অত্যন্ত অমানবিকভাবে এই সব অসহায় ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে মোটা অংকের ফিস আদায় করে থাকেন,যা অনেক ক্ষেত্রেই আবেদন প্রত্যাখাত হলে ফিসের অংশ বিশেষও ফেরত দেওয়াতো দূরে থাকুক বরং আরো নানান ফিস এর বিল হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের হতাশার মাত্রা আরো বৃদ্ধ্বি করে থাকেন।

এই রকম অসহায় বেশ কতিপয় ছাত্র-ছাত্রী যেমন মাসুদ,মুক্তা, রাঙ্গা,সবুঝ, সোহাগ,বাদল,ঝুমা, হাফিজ সহ অনেকের সাথে এই প্রতিবেদিকের সাক্ষাৎ হয়েছে,যাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে অতি করুণ কাহিনী।বাদল ও মুক্তা কাছ থেকে জানা গেলো কি রকম অমানবিক পরিবেশে তারা আছেন,একেতো ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা,তার উপর কাজের চরম অনিশ্চয়তা,যদিওবা কাজ মিলে ন্যূনতম ঘন্টা প্রতি ৬ পাউন্ড কেউ দিতে চায়না,ঘন্টা প্রতি কেউ কেউ ১ বা ২ পাউন্ড করে কাজ করে থাকেন,অবৈধ হওয়ার সুবাধে এমপ্লয়ম্যান্ট এজেন্সীর সহয়তাও নিতে পারছেননা,আবার সাপ্তাহিক আয় না থাকায় তেমন কোন বাসা ভাড়া খুজতে পারছেননা,তাই গাধা-গাধি করে একরুমে চার-পাচ-ছয়-সাতজন অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছেন,তার উপর রয়েছে ইমিগ্রেশনের ধর-পাকড়ের ভয়।অনেকে সলিসিটরের অযাচিত ফিসের কথা খুব কষ্টের সাথে জানালেন।যারা নামাজ-কালামে অব্যস্থ অথবা অনেকেই সুযোগ বুঝে, যারা তাবলীগ জামায়াতের সাথে মিশে যেতে পারতেছেন,তারা মুটামূটি নিজেদের থাকা-খাওয়ার ব্যাপারে অন্তত কিছুটা হলেও নিশ্চিত হতে পারছেন।কিন্তু এভাবেতো আর জীবন চালানো যায়না,অনেকের আবার দেশে বাবা-মা তাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে আছেন।

এদেরই একজন হাফিজুর রহমান,পেশায় ছাত্র,ষ্টূডেন্ট ভিসা নিয়ে ব্রিটেনে এসেছিলেন ৭/৮ বছর আগে।উদ্দেশ্য ছিলো পড়া-শুনা শেষ করে নিজের ও দেশে থাকা পরিবারের ভাগ্যের পরিবর্তন করবেন।ব্রিটেন আসার পর পরিচয় সমগোত্রীয় এক রেষ্টুরেন্ট ব্যাবসায়ীর সাথে,এক সাথে নামাজ-কালাম করতে গিয়ে পরিচয় পর্ব বেশ গাড়ো হতে থাকে।ইতিমধ্যে হাফিজের এক সেমিষ্টার শেষ হয়ে গেলে,টাকার দরকার পড়ে।কারণ দেশ থেকে টাকা আসার পথ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়,হাফিজের ভাষায়,বাবার আয়-রোজগার বলতে যা ছিলো তা ছোট-ভাই বোনের পেছনে খরচ হয়ে যায়,তার উপর মায়ের ক্যান্সারের চিকিৎসায় সব সঞ্চয় শেষ হয়ে যাওয়াতে বাবা হাফিজের জন্য আর টাকা পাঠাতে অক্ষম।হাফিজ বাধ্য হয়ে সখ্য গড়ে তুলে ঐ ব্যাবসায়ীর সাথে,উদ্দেশ্য কোন মতে যদি একটা কাজ ঝুটানো যায়,তাহলে সে বেচে যায়।ঐ ব্যাবসায়ীও মনে মনে এই রকম একজনকে খুজছিলেন।হাফিজের ষ্টুডেন্ট ভিসার মেয়াদ যখন শেষ হয়ে যায়,হাফিজকে তখন তার রেষ্টুরেন্টে ঐ ব্যাবসায়ী জায়গা দেন,কাজের সুযোগ দেন,থাকা-খাওয়া ফ্রি,রেষ্টুরেন্টে কাজে যোগ দানের পর কঠিণ শর্ত দেন,তাকে ছাড়া আর কোথাও হাফিজ একা একা যেতে পারবেনা,এমনকি মসজিদেও না।হাফিজ রাজি হয়ে কাজে যোগ দেয়,ধীরে ধীরে রেষ্টুরেন্ট এর শেফ বনে যায়,থাকা-খাওয়া ফ্রি আর তার ভিসার আবেদনের জন্য তিনি কাগজ-পত্র যোগাড় করতেছেন বিধায় আপাততঃ হাফিজকে কোন বেতন প্রদান করছেননা,ভিসা পাওয়ার পর সলিসিটারের খরচ বাদে যা বচবে,হাফিজের প্রাপ্য তখন হাফিজকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।হাফিজ নিরাপদ থাকার জায়গা আর উচ্চ বেতনের শেফের কাজের নিশ্চিয়তা এই সব পেয়ে দিনের পর দিন কাজ করে চলে,কোন বেতনের টাকা আর দেখেনা,কারণ মালিক তার প্রতি সপ্তাহের টাকা হাফিজের সলিসিটরের ফিস আর ভিসার কাজে খরচ করেন,যা থাকে তা তিনি সেভিংস এ রেখে দেন হাফিজের জন্য,হাফিজ তিনির ছেলের মতো।অথচ কখনো হাফিজের নোংরা কাপড়-চোপর ও তিনি বদলানোর উদ্দ্যোগ নেননি,এমনকি ঈদের জামায়াতেও নোংরা কাপড়-চোপর পরিধান করে হাফিজকে তিনি জামায়াতে নিয়ে আসেন,কারো সাথে মিশতে মানা তাই হাফিজ কারো সাথে না মিশে উনার সাথেই আবার চলে যায়।মাত্র বছর দুই আগেও হাফিজকে একজন তরতাজা যুবক হিসেবে দেখা গিয়েছে,অথচ আজ বড় মলিন ও একেবারে ভেঙ্গে পড়া এক বিধবস্ত যুবকের মতো লাগে।

এমনি অবস্থায় গত মাসে ইমিগ্রেশন রেইড করলে হাফিজ গ্রেপ্তার বরণ করে,ঐ মালিক ঘুণাক্ষরেও হাফিজকে উদ্দ্বারের কোন চেষ্টাতো করেনাই,উপরন্ত বিগত দুই-তিন বছরের কাজের একটি টাকাও হাফিজের এই বিপদের সময় দেয়নাই।নানান ভাওচার দেখিয়ে বলে সব টাকা হাফিজের পিছনে খরচ হয়ে গেছে।ডিপোর্টেশন সেন্টারে থেকে শেষ বারের জন্য হাফিজ যখন মালিককে বলে রেষ্টুরেন্ট এর কাজের তার বেতনের একটি অংশ যদি তাকে দেওয়া হয়,তবে ইমিগ্রেশন সলিসিটর আশা দিয়েছে,তা এপ্লিকেশনের ফিস বাবত খরচ করে হয়তো ইউরোপীয় আইনের কোন এক ধারা বলে আপাতত সে ডিপর্টেশন থেকে রক্ষা পেয়ে যাবে,তাকে যেন তার ঐ টাকা এখন দেওয়া হয়।কিন্তু হায়,প্রতারক ঐ রেষ্টুরেন্ট ব্যাবসায়ী হাফিজের এই বিপদেও সাহায্য না করে বরং তার ডিপোর্টেশনের সব ব্যাবস্থা করে ফেলে।অত্যন্ত হতাশ এবং ভগ্ন হ্রদয়ে হাফিজ গত মাসের ১৫ তারিখ আইওএর বিশেষ সহায়তা ব্রিটেন থেকে ডিপোর্টেড হয়ে প্লেনে উঠতে বাধ্য হয়।

ছাত্র-ছাত্রীগণ ব্রিটেন আসার আগে ভালো করে সকল তথ্য যাচাই বাছাই করে আসুন,এসে যাতে পস্তাতে না হয়,হাফিজের মতো করুন পরিণতির শিকার হতে না হয়।ইমিগ্রেশন এর বিস্তারিত জানতে লগ ইন করুণ www.ukba.gov.uk অথবা সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে কিংবা স্থানীয় ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে সেই কলেজ সম্পর্কিত তথ্য জেনে নিয়ে অর্থাৎ আসার আগে কলেজ এবং সলিসিটর ফার্ম সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য জেনে নিয়ে আসবেন।

সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ
Salim932@googlemail.com
09th July 2012.UK