বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে একের পর এক জটিলতাঃ শিক্ষার পরিবেশকে করছে ব্যাহত

সেলিম আহমেদ
Published : 15 July 2012, 06:08 PM
Updated : 15 July 2012, 06:08 PM

সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ, যুক্তরাজ্য থেকে-

বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রদান,চর্চা,লালন আর বিকাশের কেন্দ্র।যে জাতির বিশ্ববিদ্যালয় যত বিকশিত,যত বেশী পঙ্কিলতা মুক্ত,সে জাতির মন,মনন,মেধা,জ্ঞান-গরিমা তত বেশী উন্নত ও প্রসারিত।শুধু কি তাই,সে জাতির জ্ঞানে,বিজ্ঞানে,প্রযৌক্তিক উন্নয়নে ও করায়ত্ত্বে ততবেশী পারদর্শী ও সক্ষম,সেই জাতি উন্নয়ন ও জাতীয় প্রবৃদ্দ্বি অর্জনে অন্য সব জাতির চাইতে অগ্রসর সারির মধ্যে অবস্থিত এবং বলা যায় অনেকের কাছে বেশ ইর্ষনীয়ও। তাইতো,বিশ্বের সকল উন্নত ও উন্নয়নশীল এবং অধূনা স্বল্প ও মধ্য উন্নয়নশীল দেশের জনগণ,সরকার প্রধান,প্রশাসন ও বিরোধীদল একই সাথে মিলে-মিশে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের লালন,পরিচর্চায়,এবং তার জ্ঞান-বিজ্ঞান বিকাশে বিশেষ ও সমন্বিত উদ্যোগ, পরিকল্পনা ও ব্যাবস্থা গ্রহণ করে থাকে।বিশ্ববিদ্যালয় ও তার প্রশাসনের কাজে কোন হস্তক্ষেপ যেমন করেনা,একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্র প্রসারে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে থাকে।একটি শান্ত,সুন্দর,জ্ঞান-বিকাশের স্থানকে সেই জাতি বড় শ্রদ্দ্বা ও মর্যাদার সাথে বিবেচনা করে থাকে।আজকের যুগে যেমন লন্ডনের ক্যামব্রীজ,কিংবা অক্সফোর্ড,কুইন ম্যারী,গ্লাসগো, ব্রিষ্টল বিশ্ববিদ্যালয়,তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড,আরাকানসাসের লিটল রক,বোষ্টনের বিশ্ববিদ্যালয়,বা জাপানের টোকিও কিংবা পাশের দেশ ভারতের আলীগড় মুসলিম বা দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় যেমন সেও সব জাতিকে দেশ জাতি ও মানচিত্রের সীমা রেখা ছাড়িয়ে সারাবিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার আলোক বর্তিকা হয়ে চলেছে জাতি থেকে জাতিতে,একইভাবে ব্রিটিশ জাতি কিংবা আমেরিকান অথবা জাপানীজ বা ভারতীয়দেরও করে তুলেছে বিদ্যা,বুদ্দ্বি,জ্ঞানে-গৌরবে ও উন্নতিতে অগ্রণী ও শ্রদ্দ্বার আসনে করেছে অধিষ্টিত।

আমাদের দেশেও এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জ্ঞানার্জন ও জ্ঞান-বিজ্ঞান উন্নয়নে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ব পরিমন্ডলে ব্যাপক পরিচিতি ও ভূমিকার সহায়ক এক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল।কিন্তু বড় আফসোস আর পরিতাপের সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার প্রশাসন আজ যেন তার লক্ষ্য হারিয়ে নিছক এক নামহীন,বর্ণহীন এক বিল্ডিং সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে চলেছে।

এইতো কিছুদিন আগেও ছাত্র নামধারী কতিপয় ছাত্র সংগঠণ বিশেষত সরকারী ছাত্র সংগঠনের দলীয় তান্ডবে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ যেমন লংঘিত হতে চলেছিলো,ঠিক তেমনি করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,আর বর্তমানে ভিসি বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল আমাদের বুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়-সর্বত্র একই অরাজক,অসহনীয়,নৈরাজ্যকর এক অবস্থা বিরাজমান,যদিও বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে আন্দোলনের ধরন ও ক্ষেত্র কিছুটা তারতম্য বিদ্যমান,তারপরেও মোটামুটি সব কটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ যে ব্যাহত – তা সকলের কাছেই বেশ ভালোভাবেই দৃশ্যমান।

বুয়েটে একজনমাত্র ব্যাক্তির এতো অনমনীয়তার কারণে গোটা বিশ্ববিদ্যালয় আজ অস্থির,এক উত্থাল, শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ বিরাজমান।ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষকবৃন্দ মিলিতভাবে অনবরত বিরামহীন বিক্ষোভ আর অবস্থান নিয়ে চলেছেন ভিসির বাড়ীর সামনে।অথচ ভিসি মহোদয়,বোধগম্য কারণে,তার খুঁটির জোরে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী আর শিক্ষকবৃন্দের বিরুদ্দ্বে অবস্থান নিয়ে প্রশাসনযন্ত্রকে শুধু নিজেই অচল করে তুলছেন না,বরং শিক্ষার পরিবেশকেও ব্যাহত করে চলেছেন।একজন সত্যিকারের শিক্ষকের কাছ থেকে যা কখনোই কাম্য নয়।কারণ একজন সত্যিকারের জ্ঞানের কারিগর কখনোই নিজ সৃষ্টিকে অচল ও ধবংস করে দিতে পারেন না।এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে,তিনি তার পূর্বসূরি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির অনুসরণ করে চলেছেন,কিন্ত সেই ভিসির ও সরকারী মদদের শক্তির অনমনীয়তা ও সকলের বিপরীতে দৃঢ়তা কিছুতেই যে ধোপে টিকেনি, তাতো আমরা কিছুদিন আহেও দেখতে পেয়েছি। জ্ঞানের কারিগর আর এতো বড় বড় লোকগুলো কেন যে এতো অনমনীয় ও বেপরোয়া আর সরকারের তোষামোদকারী হয়,ভাবতে অবাক হয়ে যাই।আসলে মেরুদন্ডহীন, শেকড় বিচ্ছিন্ন শিক্ষার ফলে এতো বড় বড় ডিগ্রী নিয়েও সহজেই সরকারের ক্রীড়নক আর অপরের কাছে নিজের বিবেক,স্বাধীনতা বিক্রী করে দিয়ে লোলা-লেংড়া আর বিবেকহীন অন্ধ দলীয় আনুগত্যের সউল এজেন্ট হয়ে বসার কারণে নিজেরা যেমন হয় অপদস্ত,মূল্যহীন,অপরদিকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষাঙ্গন প্রশাসনকে করে তুলে এক আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে,ফলে জ্ঞান চর্চা হয় বিতাড়িত,গবেষণা কার্যক্রম হয় নিরুৎসাহিত, চলে সমান্তরালে দলীয় রাজনীতির অন্ধ অনুশীলন,গ্রুপিং,আর নোংরা রাজনীতি,মেধা হয় অবহেলিত,যা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান হাল-হকিকত তা জানান দিয়ে চলেছে।

এছাড়া রয়েছে,দলীয় লেজুড়বৃত্তি চর্চারত মেধাহীন অন্ধ দলীয় ছাত্র রাজনীতির নামে টেন্ডার বাজী,দলাদলী, খুন-খারাবির মতো আদিম বর্বরতা, যা বিশ্বের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে প্রায় বিরল,ব্যাতিক্রম শুধু আমাদের বাংলাদেশ।

দিনের পর দিন,মাসের পর মাস,বছরের পর বছর এই একইভাবে শিক্ষাঙ্গনগুলো চলছে,পাল্লা দিয়ে সমানতালে একশ্রেণীর শিক্ষক এবং ছাত্র নামধারী দলীয় ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সেই একই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষাকার্যক্রম করে তুলেছে অস্থিতিশীল,অথচ এই সব অনাচার,এই সব বিবেকহীন কাজ বন্ধ করার যেন এখানে কেউ নেই।আজকের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন হয়ে গেছে দলীয় কার্যক্রমের প্লাটফর্ম। এভাবে তো শিক্ষাকার্যক্রম চলতে পারেনা।

শুধুমাত্র সরকারের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবেনা।বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের রয়েছে নিজস্ব আইন-শৃংখলা,রীতি-নীতি,চেষ্টা করা উচিৎ যথাযথ সততা আর শিক্ষকসূলভ,পূর্ণপেশাদারী মনোভাব নিয়ে অযাচিত সমস্যা সমূহের সঠিক সুন্দর সমাধান করার।তা এক সাথে নয়,ধীরে-ধীরে এই অরাজক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে,এভাবে দিনের পর দিনতো চলতে পারেনা।১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশকে যুগোপযোগী করে আজকের বাস্তবতা ও চাহিদার উপযোগী করার ব্যাবস্থা সিন্ডিকেটের গ্রহণ করা উচিত,তাহলে অনেক অনাকাংখিত ঘটনাসমূহ এড়িয়ে শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত না করেও নিজেদের দাবী-দাওয়া নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে মীমাংসার দৃষ্টান্ততো আমাদের এই অস্থিতিশীল জাতিকে দেখাবেন এই শিক্ষকবৃন্দ।তা না করে রাজনৈতিক দলগুলোর মতো বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের শিক্ষকবৃন্দও আজ দলীয় হানাহানি আর মারামারিতে ব্যাস্ত।এই যখন অবস্থা তাহলে তো সুন্দরের সাথে অসুন্দরের পার্থক্য থাকেনা।বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ কি তা একটু ভেবে দেখবেন।ঢালাওভাবে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দোষ দেইনা,কতিপয় দলীয় সাইনবোর্ড সর্বস্ব শিক্ষক আজ এই অবস্থার জন্য দায়ী।দলীয় অন্ধ আনুগত্যশীল শিক্ষকই আজকের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের ভিসি মনোনীত হয়ে থাকেন,আর তা করতে গিয়ে আমাদের এই অন্ধ দলীয় রাজনীতির ভয়াবহ চর্চা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমূহকে করে তুলেছে এক গোদের উপর বিষফোঁড়া হিসেবে।এই কি ছিলো আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র?

সরকারের প্রতি বিনীত নিবেদন, দয়া করে জাতির সঠিক মেধার চর্চা আর বিকাশের স্বার্থে যথাযথ নীতিমালার মাধ্যমে যোগ্যতা,মেধা আর প্রকৃত গবেষণা আর প্রকাশনার বিচার বিশ্লেষণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগের দিকে মনোনিবেশ করুণ,নতুবা গোটা বিষয় বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের ঐ রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের ধারাটি শিক্ষার বিকাশের স্বার্থে বিলুপ্তির পদক্ষেপ নিতে দলীয় শিক্ষকদের উৎসাহিত করুন।সম্প্রতি গ্লাসগোর কলেডীনিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ডঃ ইউনূসকে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে,কই ইউনূস কি তাদের পার্টির কেউ নাকি,নাকি তিনি কখনো কোন দলের অনুগত্য করেছেন?কেউ এমন শুনেছেন বলেতো মনে হয়না।গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় দেখেছে তাদের দরকার প্রকৃত মেধা আর যোগ্য লোকের,যার রয়েছে অনেক গবেষণা,প্রকাশনী আর বাস্তব সম্মত অর্থনৈতিক,ব্যাবহারিক এবং দক্ষ সাংগঠণিক প্রমাণিত জ্ঞানের শক্তি,তাইতো ইউনূসকে তাদের ভিসি নিয়োগ দিতে তারা কার্পণ্য করেনি।গ্লাসগো কলেডোনিয়ানে কি কোন শিক্ষক কিংবা ওখানে কি কোন সরকারী প্রশাসন যন্ত্র নাই নাকি?যদি তাই থাকে,তাহলে তারাতো একজন বিদেশীকে,তাও কালো গরীব দেশের একজনকে ভিসি হিসেবে মেনে নিতে বা বিরোধীতা করতে আমাদের মতো এতো দল,উপদল আর হানাহানি কিংবা শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করেননি?আমাদের এখানেই শুধু এর ব্যাতিক্রম।কৈ সে আমার দলের কিনা,কতো যে দল,উপদল,লাল-নীল-সাদা-আরো কতো রংযের যে দলে বিভক্ত আমাদের শিক্ষকবৃন্দ।জাতির এই বিবেক আর শ্রেষ্ট সন্তানরা আজ বহুধা বিভক্ত,যা আমাদের জাতি ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে ভয়াবহ এক শুন্যতার সৃষ্টি করে চলেছে,আর নষ্ট আর অসুন্দরতা তাই আজ ক্ষমতার দন্ড-মুন্ড আর হর্তা-কর্তা হয়ে জাতির ঘাড়ে চড়ে বসে ছড়ি ঘুরিয়ে চলেছে,ফলে আমরা চলেছি ক্রমাগতভাবে অধঃপতনের দিকে।এই অবস্থার যত তাড়াতাড়ি উন্নত হয়,ততোই তাড়াতাড়ি দেশ ও জাতির মঙ্গল বয়ে আনবে।

সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ
tweet@salim1689
15th July 2012.UK

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে: দৈনিক সিলেট ডটকম