লন্ডনে ইউএন স্থায়ী প্রতিনিধির লাইভ সাক্ষাতকার-বিশ্বে বাংলাদেশ রোল মডেল

Published : 23 July 2014, 05:49 AM
Updated : 23 July 2014, 05:49 AM

ডঃ মোমেন- পুরো নাম এ কে এ আব্দুল মোমেন। বর্তমান কর্মস্থল জাতি সংঘ, সেখানে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি তিনি। ডঃ মোমেন একজন পেশাদার উচু মানের কূটনীতিক ছাড়াও আরো কিছু পরিচয় রয়েছে। একসময় তিনি বোস্টনের অর্থনীতির অধ্যাপক, ছিলেন সৌদি আরবের প্রয়াত বাদশা ফাহদের ইকোনোমিক এডভাইজর। যুক্তরাষ্ট্রের ফারিংহাম ইউনিভার্সিটির বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন ও ইকোনোমিকস ডিপার্টম্যান্টের চেয়ারম্যান হিসেবেও কাজ দুর্লভ গৌরবের অধিকারি ডঃ মোমেন। একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সিয়াল কেন্ডিডেট মাইকেল ডুকাকিসের সাউথ এশিয়া বিষয়ক এডভাইজরের দায়িত্বেও ছিলেন। ২০১১-২০১২ সাল পর্যন্ত জাতি সংঘ জেনারেল এসেম্বলির সেকেন্ড কমিটির চেয়ার ছিলেন। বর্তমানে তিনি ইউ এন জেনারেল এসেম্বলির ভাইস চেয়ারের দায়িত্বে রয়েছেন।২০১০ সালে তিনি ইউ এন কাউন্টার টেরোরিজমের ফেসিলিটেটর হিসেবেও কাজ করেছেন।

প্রসঙ্গতঃ যে কথা না বললেই নয়,প্রবাসীদের দ্বারা ওয়েজ আর্নার্স স্কীম যা ১৯৭৩ সালে ডঃ মোমেন ব্রিটেনে কমার্স মিনিষ্ট্রিতে থাকাকালিন সময়ে প্রবাসীদের সাথে মতবিনিময় কালে প্রাক্কলন তৈরি করে ঢাকায় পাঠালে বঙ্গবন্ধুর সরকার সেই প্রস্তাবটি ১৯৭৪ সালে আইনে পরিণত করেন।

গত ৫ জুলাই ২০১৪ ডঃ মোমেন নিউইয়র্ক যাওয়ার পথে লন্ডনে এক সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতিতে লন্ডনের একমাত্র জনপ্রিয় বাংলা রেডিও বেতার বাংলার সাথে এক স্পেশাল লাইভ প্রোগ্রামে অংশ গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি  বাংলাদেশের চলমান গণতন্ত্রিক কাঠামো, স্বচ্ছতা, উন্নয়ন, জাতি সংঘ সহ বিশ্ব গণমাধ্যম এবং বিশ্ব নেতৃত্ব কেমন করে বাংলাদেশকে দেখছে, কেমন করে বাংলাদেশ এতোকিছুর পরেও এগিয়ে যাচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের রায় বিশেষ করে নিজামীর রায় অপেক্ষমান তালিকায় এ নিয়ে বহির্বিশ্বের কোন চাপ আছে কিনা- তিনি মতামত ব্যক্ত করেছেন, রাষ্ট্রপতির জাতি সংঘ মহাসচিবের সাথে প্রকৃত কথোপকথন ইত্যাদি সহ সাম্প্রতিক বিশ্ব ও উপমহাদেশীয় রাজনীতি, কূটনীতি নিয়েও মতামত শেয়ার করেছেন স্রোতা, দর্শকদের সাথে। ডঃ মোমেনের সেই সাক্ষাতকার ভিত্তিক আলোচনা অনুষ্ঠানটি প্রেজেন্টারের দায়িত্বে ছিলেন বেতার বাংলার নিউজ ইন চার্জ সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ। সেই লাইভ আলোচনার অংশ বিশেষ থেকে পাঠকদের জন্য এখানে তুলে ধরা হলো-

সেলিমঃ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্যে। আমরা শুরুতেই কথা বলতে পারি যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে। আপনি জানেন যুদ্ধাপরাধ রায় নিয়ে দেশে বিদেশে অনেক কথা হচ্ছে, বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াত এবং তাদের একজন বিদেশী আইনজীবী বিশ্বকে এ বিচারের স্বচ্ছতা এবং সরকারের উপর নানাবিধ চাপ প্রয়োগের চেস্টা প্রতিনিয়ত সংবাদ মাধ্যমে আসছে। গণজাগরণ মঞ্চ সহ অনেকের সন্দেহ যখন নিজামীর রায় বার বার অপেক্ষমাণ তালিকায় চলে আসছে- এ ব্যাপারে আপনি কি আমাদেরকে একটু খোলাসা করে বলবেন বা আপনি কি মনে করেন কোন চাপ সত্যি আছে ?

ডঃ মোমেনঃ ধন্যবাদ এবং প্রবাসীদেরকে রমজানুল মোবারকবাদ- এই পবিত্র মাসে আমাকে সুযোগ দেয়ার জন্যে। বাংলাদেশ সরকার যে আন্তর্জাতিক ট্র্যাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচারের কার্য শুরু করেছে, আপনি যদি ভালোভাবে খেয়াল করেন তবে দেখতে পাবেন আমাদের বিচারিক প্রক্রিয়া ও আইন বিশ্বের যেকোন দেশের আইনের চাইতে অনেক স্বচ্ছ এবং ভালো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন হেগ কিংবা রুয়ান্ডা ট্র্যাইব্যুনাল যাই বলুন না কেন, তাদের চাইতে আমাদের আইন অনেক স্বচ্ছ এবং উন্নত।আমরা শুরু করেছি, সেটা আরো উন্নতি করা হবে, এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া।জাতি সংঘে বিশেষ করে এ নিয়ে কখনো কোন আলোচনা নেই, তারা এটা নিয়ে ভাবেওনা। তিনি বলেন বর্তমানে

বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়ন, আদর্শ, গণতন্ত্র ও সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলনের এক সহায়ক শক্তিই শুধু নয়, বরং এক রোল মডেল হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।

তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধী বিচার কিংবা কতিপয় বিরোধী নেতার মিথ্যা প্রোপাগান্ডার প্রেক্ষিতে জাতি সংঘের কোন চাপ সরকারের উপর নেই। কারণ এসব নিয়ে তারা কখনো ভাবেওনা। তারা শুধু দেখতে চায় গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে জবাবদিহিতা বজায় রেখে জনগণের জীবন মান উন্নয়নের জন্য সরকার যে কাজ করছে, এতো কিছুর পরেও তারা তা দেখে বাংলাদেশের অভাবিত এচিভম্যান্টে জাতি সংঘ এবং বিশ্ব বেশ অভিভূত। নিজামীর রায় বার বার অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকার কারণ সেটা সম্পূর্ণ আদালতের ব্যাপার-এতে সরকারের কোন হস্তক্ষেপ নেই। আপনি এক প্রশ্নের আলোচনায় ওবামা প্রশাসনের যে কথা বলেছেন, সেটা নিয়ে বলতে চাই এতে ওবামা প্রশাসনের কোন চাপও সরকারের উপর নেই। এটা সুস্পষ্ট।তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সরকারের নেয়া বিভিন্ন কার্যক্রম ও নীতির ফলে এ ব্যাপারে আরো উন্নতি সাধিত হবে তাতে কোন সন্দেহ নাই।

সেলিমঃ ৫ তারিখ যে নির্বাচন হয়ে গেলো, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন এবং বিতর্ক দেশে বিদেশে রয়েছে। আমাদের স্রোতা দর্শকদেরও অনেক প্রশ্ন আপনি শুনেছেন। এ নিয়ে আপনার মূল্যায়ন প্লিজ-

ডঃ মোমেনঃ দেখুন সরকার বলছে, সংবিধানের ধারাবাহিকতা আর গণতান্ত্রিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখার জন্য সরকারকে নির্বাচন করতেই হবে এবং সরকার তাই করেছে। সেখানে একটি বিরোধী দল ইচ্ছে করেই নির্বাচনে আসেনি। তারা অনেক সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও জঙ্গিদের নিয়ে দেশে ভয়াবহ অবস্থা সৃস্টি করে নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছিলো, তা পারেনি। সরকার দৃঢ়তার সাথে সেই নির্বাচন করে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে। আর নির্বাচনের পরে সরকার আইন শৃঙ্খলা রিস্টোর করেছে- যা একটি বিরোধীদল অর্থাৎ বিএনপি নষ্ট করেছিলো, সেটা আপনারা মিডিয়ায় দেখেছেন।তারা বাসে পেট্রল বোমা মেরে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করে চলেছিলো, গাছ কেটে, রাস্তা কেটে সড়ক অবরোধ করে নৈরাজ্য সৃস্টি করেছিলো। এই অবস্থায় সরকার দেশে একটা সংকট যাতে সৃস্টি না হয়, শুন্যতা যাতে দেখা না দেয়, তা থেকে জাতিকে রক্ষা করে নির্বাচন করেছে। এবং সরকার এখন ভালো ভালো কাজ করেছে, যা আপনারা সংবাদ মাধ্যমে দেখছেন।আমেরিকাতে অনেক সিটে যুগের পর যুগ যেমন জন কেরির সিটে কেউ কখনো দাড়ায়না, বুশ প্রশাসনের সময় আপনারা দেখেছেন সেখানে কিভাবে নির্বাচনে অসততার আশ্রয় নেয়া হয়েছিলো- বাংলাদেশ সরকারতো সেরকম কিছুই করেনি। বিরোধী দলকে এতো ভাবে আহবান জানানোর পরেও তারা নির্বাচন বয়কট করলো।তাদের উদ্দেশ্য খারাপ ছিলো, তারা চাচ্ছিলো অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতায় আসুক। আমরা সেটা হতে দেইনি। আর হ্যা আলোচনার দরজা সরকার বন্ধ করে দেয়নি। স্রোতা দর্শক যে প্রশ্ন করেছেন সেটাই বলছি আলোচনার মাধ্যমে গণতন্ত্র উন্নতি লাভ করে। সরকার আলোচনার মাধ্যমে কাজ করতে চায়।

সেলিমঃ বর্তমানে দেশে এবং  বিদেশে প্রেসিডেন্টের জাতি সংঘ মহাসচিবের সাথে যে রাজনৈতিক বক্তব্য পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। আপনি নিজে সেখানে স সময় ছিলেন, আপনি যদি এব্যাপারে একটু শেয়ার করেন আমাদের স্রোতাদের—

ডঃ মোমেনঃ বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায় জাতি সংঘ মহাসচিবের সাথে সাক্ষাতের সময় প্রেসিডেন্টের উদ্ধৃতি দিয়ে যে বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে, তা সঠিক নয়।প্রেসিডেন্ট এ ব্যাপারে কোন বক্তব্য দেননি। বরং তিনি মিলেনিয়াম গোল এচিভম্যান্ট, গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও তহবিল, শান্তি মিশনে বাংলাদেশের আরো সৈন্য নেয়া, নারী শিক্ষা ও কৃষিতে সাফল্য ইত্যাদি নিয়ে মতবিনিময় করেন। তবে প্রেসিডেন্ট একটা কথাই বলেছেন, ৫ তারিখের নির্বাচনের পরে দেশে সন্ত্রাস, হরতাল, অবরোধ আর হয়নি। এর বাইরে প্রেসিডেন্ট কোন মন্তব্য করেননি। কিছু পত্র পত্রিকা অতিরঞ্জিত করে মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করেছেন প্রেসিদেন্টের নামে, এধরনের কাজ থেকে আমাদের সকলেরই বেরিয়ে আসা উচিৎ ।

সেলিমঃ একজন অর্থনীতির অধ্যাপক ও খ্যাতিমান কূটনীতিক এ দুয়ের সমন্বয়ে বাংলাদেশ কেমন করে এগিয়ে যাচ্ছে বলে আপনি মনে করছেন ?

ডঃ মোমেনঃ বাংলাদেশ এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভুতপূর্ব উন্নতি সাধন করতেছে। ঝড় ঝঞ্জা খড়া ঘুর্ণিঝড় আর রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক স্থিতিশীল এবং উর্ধগতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সাথে  সাথে এবং জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের উপরে ছাড়িয়ে গেছে। অর্থনীতি যেভাবে চলছে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে ৭ শতাংশ অর্জন অসম্ভব কোন টার্গেট নয়।শত প্রতিকূলতা ও বিশ্ব আর্থিক মন্দা সত্যেও আমাদের আর্থিক অবস্থা একই সাথে বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ বিগত সময়ের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। কর্মসংস্থানের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। কৃষিতে আমরা আশাতীত সাফল্য পেয়েছি, বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ।নারী শিক্ষা ও নারী উন্নয়নে আমরা আরো একধাপ এগিয়ে গেছি।বিশ্ব শান্তি রক্ষা ও বাহিনীতে আমাদের অবদান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।আগামীতে আরো বৃদ্ধি পাবে সন্দেহ নাই। যোগাযোগ ব্যবস্থায় বর্তমান সরকারের সাফল্য প্রশ্নাতীত।

উল্লেখ্যলাইভ সরাসরি প্রচারিত অনুষ্ঠানে এ সময় অগণিত স্রোতাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরও সাবলীলভাবে তিনি দিচ্ছিলেন।আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন কেমন করে নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের দূতাবাসের জন্য এখন স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করেছেন, যাতে সরকারের আগের মতো আর প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হচ্ছেনা।জাতি সংঘ সহ বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামে এখন আগের যেকোন সময়ের তুলনায় অধিকহারে বাংলাদেশী এক্সপার্টরা কর্মরত আছেন।

সব শেষে রাষ্ট্রদূত পবিত্র রমজান মাসে প্রবাসী বাংলাদেশীরা নিজেদের মূল্যবান ব্যস্ত সময়েও তার সাথে টেলিফোনে বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা ভাবনা যেভাবে শেয়ার করেছেন, সেজন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান, সকল প্রবাসীদের সুস্থ্য, উন্নত ও সুখী জীবন কামনা করেন, পবিত্র রমজানুল মোবারকের শুভেচ্ছা বিনিময়ের সাথে অগ্রীম ঈদ মোবারকও জানান।

6th July 2014, London.