জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগান্তকারী উদ্যোগ এবং কিছু অনুরোধ-অনুযোগ

গোলাম রসুল খান (মুহতাসিম)
Published : 16 Oct 2015, 09:45 AM
Updated : 16 Oct 2015, 09:45 AM

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় অতি পরিচিত অপ্রিয় একটি শব্দ হল ভর্তিযুদ্ধ। ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরাই জানে এটি কি পরিমাণ ভয়াবহ এবং ক্ষেত্রবিশেষে ভয়ংকর একটি পদ্ধতি। এদেশে ১ম শ্রেণি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ভর্তির ক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষা নামক একটি ব্যবস্থার দ্বারা যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়। যদিও ৬০ মিনিটের একটি নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষার মাধ্যমে একটি শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই সম্ভব কি না সেই প্রশ্ন থেকে যায়। ভর্তি পরীক্ষা ব্যাপারটি আমাদের দেশে এত বেশি প্রচলিত হয়ে গেছে যে এটি এখন ভর্তিযুদ্ধে পরিণত হয়েছে। সেই ভর্তিযুদ্ধে মেধাতালিকায় ঠিকে থাকার জন্য শিক্ষার্থীদের বড় অংকের টাকার বিনিময়ে কোচিং করতে হয়। সেই কোচিং এর টাকার যোগান দিতে অনেক শিক্ষার্থীর পরিবারকে কি পরিমাণ কষ্ট করতে হয় তা ইতিমধ্যে বিভিন্ন মিডিয়ায় উঠে এসেছে। এছাড়াও অতি সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোচিং করতে ঢাকায় এসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২জন ছাত্রী যা অত্যন্ত ভয়ংকর একটি ব্যাপার।

উচ্চ মাধ্যমিক/সমমান শেষে শিক্ষার্থীরা যখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে চায় তখন তারা প্রচন্ডরকমভাবে ধাক্কা খায়। কারণ স্নাতক-সমমান পর্যায়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কলেজসহ সমমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আসন সংকট থাকায় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদেরকে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে উত্তীর্ণ হতে হয়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বেশ কয়েকটি ধাপ সম্পন্ন করতে হয়। প্রথমে পছন্দকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অনলাইনে আবেদন, তারপর মোবাইলের মাধ্যমে ফি জমা দিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিয়ে তারপর ভর্তি পরীক্ষার প্রবেশপত্র সংগ্রহ, তারপর পরীক্ষা দেয়া এবং কৃতকার্য হলে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। এই প্রতিটি ধাপে শিক্ষার্থীদের এবং তাদের পরিবারকে অর্থব্যয়,সময় ব্যয়, শারিরিক-মানসিক ভোগান্তি সহ নানা ঝামেলার শিকার হতে হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার বিরুদ্ধে শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবাল স্যারসহ অনেক গুণীজন বিভিন্ন সময়ে লেখালেখি করেছেন বলে সেদিকে আর যাচ্ছি না।

আশার কথা হল ভর্তি পরীক্ষা ব্যাপারটার পরিবর্তন শুরু হয়েছে। কিছুদিন আগে মাননীয় প্র্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১ম শ্রেণিতে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির ক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার কঠোর সমালোচনা করে এটি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন এবং ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্কুলে ১ম শ্রেণিতে ভর্তির ক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে।

এবার আসা যাক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান সেশনজটের হাত থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্ত করার চিন্তা থেকে প্রতিষ্টিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ ছাত্র-ছাত্রী,শিক্ষক,কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা আর অধিঃভুক্ত প্রতিষ্টানের সংখ্যা বিবেচনায় বিশ্বের বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি। উচ্চ শিক্ষা অর্জনে দেশের সবচেয়ে বেশি পড়ুয়াদের প্রাণের এই বিশ্ববিদ্যালয়টি অতীতে বার বার নেতিবাচক কারণে খবরের শীর্ষে এসেছে। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়টির চমৎকার কিছু উদ্যোগ/পদ্ধতি কখনোই আমাদের মিডিয়ার নজরে পড়েনি। দেশের উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান কখনোই কারো চোখে পড়েনি। তাই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় খবরের শিরোনাম হয় সেশনজট, অনিয়ম প্রভৃতির কারণ।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবছর একটি চমৎকার উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। তারা ঠিক করেছে এ বছর থেকে স্নাতক পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করবে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে। ফলে আর শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষা নামক উদ্ভট ঝামেলার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। আমার মনে হয় দেশের উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে এটি একটি মাইলফলক এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এই চ্যালেন্জটি যথেষ্ট সাহসের সঙ্গে নিয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে স্যালুট জানাই এমন যুগান্তকারী উদ্যোগের জন্য।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক ফলাফলের ভিত্তিতে ভর্তি নেয়ার সিদ্ধান্তটি চমৎকার হলেও আগের পদ্ধতির কিছু কিছু ভুত এখনও বিরাজমান। প্রথমত শিক্ষার্থীদের আবেদন করতে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ফি জমা দিতে হয়। যদিও টাকার পরিমাণটা খু্ব বেশি না কিন্তু যেহেতু পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে না সেহেতু ফি নেয়ার উল্লেখযোগ্য কারণ আছে বলে আমি জানতে পারি নি এবং আমি সংশ্লিষ্টদের সাথে যোগাযোগ করলে তারাও এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেন নি।

দ্বিতীয়ত আবেদনকারী শিক্ষার্থীদের আবেদনকৃত কলেজে গিয়ে আবেদনের স্বপক্ষে প্রমাণপত্র হিসাবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার নম্বরপত্র ও রেজিষ্ট্রেশন কার্ড সত্যায়িত কপি জমা দিতে হয়। অথচ ডিজিটাল বাংলাদেশে এর কোনো যৌক্তিকতা নেই। উপরন্তু শিক্ষার্থীদের জন্য এটি একটি বাড়তি ঝামেলা। বিশেষত ছাত্রীদের ক্ষেত্রে এটি একটি সমস্যাও বটে। যেহেতু অনলাইনে রোল নম্বর দেয়ার পর তাদের কাছে পুরো তথ্য চলে আসে এবং এতে কোন ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নাই সেহেতু এই সত্যায়িত কপি জমা দেয়ার বিষয়টিকে একটি হাস্যকর বিষয় এবং পরীক্ষার্থীদের জন্য একটি যন্ত্রনামূলক শাস্তি বলে আমি মনে করি।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু ফলাফলের ভিত্তিতে ভর্তি করার মত অসাধারণ বিষয় হাতে নিয়েছে তাতে উল্লেখিত বিষয়গুলো বাদ দিয়ে অর্থাৎ ফি ছাড়া ভর্তি আবেদন এবং কলেজে কোনো ডকুমেন্ট জমা না নিয়ে ডাইনামিকালি ফলাফল প্রকাশের পর ভর্তি ফি এবং প্রয়োজনীয় সনদ-কাগজপত্র জমা নেয়ার পদ্ধতি চালু করে একটি মডেল হিসাবে নিজেদের অধিষ্টিত করবে এটি প্রত্যাশা করি। তাই সংশ্লিষ্টদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ মূলক অনুরোধ করছি অবিলম্বে বিষয়টির সুরাহা করে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির হাত থেকে রক্ষা করা হোক।

ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে আরো এগিয়ে যাক বাংলাদেশ। জয়তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।