ধর্ষণঃ সমস্যা এবং উত্তরণের পথ

গোলাম রসুল খান (মুহতাসিম)
Published : 9 June 2016, 05:50 PM
Updated : 9 June 2016, 05:50 PM

সম্প্রতি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী তনুকে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে নানা বয়স-পেশার মানুষ এতে শামিল হচ্ছেন। সবার একটাই দাবী এর বিচার চাই।

উপরোক্ত সমস্যাটি এদেশে নতুন নয়। ধর্ষণ একটি জঘন্য অপরাধ হলেও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ২০১৫ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে দেয়া রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৫ সালে ১৯২ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ৪৪৩৬জন নারী নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। শুধুমাত্র এই রিপোর্টের দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারি দেশে কি ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। এই রিপোর্টের বাইরে আরো অসংখ্য ধর্ষণ-নির্যাতনের ঘটনা আছে যেগুলো সামাজিক সম্মানহানির ভয়ে কিংবা প্রাণনাশের হুমকিতে পত্র-পত্রিকা-প্রচারে আসে না। ১৯৭১সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আমাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল এবং আমাদের আড়াই লক্ষেরও বেশি মা-বোনকে তারা ধর্ষণ করেছিল। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর স্বাধীন দেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনার মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত গত বছর বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখে আমাদের স্বাধীকার আন্দোলনের সূতিকাগার টিএসসি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) এলাকায় প্রকাশ্যে নারী নির্যাতন এবং সম্প্রতি কুমিলস্না ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ভেতর কলেজ ছাত্রী তনু'কে ধর্ষণ করে হত্যা আমাদেরকে নতুন করে ভাবাচ্ছে। একটি স্বাধীন ও অসাম্প্রদায়িক দেশে নারীর উপর এত নিপীড়ন আমাদের জন্য যথেষ্ঠ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রথমত ধর্ষণ হল, ''কোন ব্যক্তির (পুরুষ/মহিলা অথবা শিশু) বিনা সম্মতিতে কিংবা জোরপূর্বকভাবে কোন রকম শারিরীক নির্যাতন অথবা যৌন মিলনকে ধর্ষণ বলে।'' আমাদের দেশে নারী ও শিশুরাই বেশি ধর্ষণের শিকার হয়ে থাকেন। এবার আমরা দেখব ধর্ষণের কারণ কি। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখি এই ভারতবর্ষে ধর্ষণের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। রাজা, জমিদার,শক্তিশালী সামমত্ম প্রভু থেকে প্রভাবশালীদের হাতে নারীদের ধর্ষণ ছিল বহুল প্রচলিত। তবে সাম্প্রতিকালে আমাদের বাংলাদেশে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ধর্ষণের কারণ হিসেবে যেগুলো দায়ী ধরা হয়, সেগুলো হলঃ ১। বিকৃত যৌন লিপ্সা। ২। অশ্লীল ফটোচিত্র,ভিডিও,চটি বই। ৩। মাদক ও সঙ্গীদের প্রভাব। ৪। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব। ৫। ক্রোধ/পূর্ব শত্রুতা। ৬। মানসিক অসুস্থতা ও কৌতুহল। আমাদের দেশে ধর্ষণ মূলত উপরোক্ত কারণসমূহে ঘটে থাকে। বিকৃত যৌন লিপ্সা চারিতার্থ করতে নারীকে ধর্ষণ করা হয়। আবার অশস্নীল ফটোচিত্র, ভিডিও, যৌন সুড়সুড়িমূলক বই-প্রকাশনা এবং বিভিন্ন অশ্লীল গল্প সংবলিত ওয়েবসাইটের প্রভাবে কিশোর-তরুণরা ধর্ষণের মত অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে, কিংবা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ধর্ষণের মাধ্যমে প্রতিশোধ নেয়ার ঘটনাও ঘটে থাকে । তবে বর্তমানে ধর্ষণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে বিদেশী আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব এবং আমাদের দেশের বিচারহীনতা। বিভিন্ন বিদেশী চ্যানেলে প্রচারিত অশ্লীল ও যৌন উদ্দীপনামূলক অনুষ্ঠান তরুণ প্রজন্মকে যৌনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

এবার আসা যাক ধর্ষণের শাস্তি কি কিংবা বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে। আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে(অথবা শহরে) ধর্ষণ সংগঠিত হওয়ার সাথে সাথে গ্রাম্য মাতববররা সালিশে সমাধানের নামে নাটক করে এবং যেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষক প্রভাবশালী বা প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য হয় তাই ধর্ষককে বাঁচানোর  চেষ্ঠা করা হয় এবং এ ক্ষেত্রে ১৫-২০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে ধর্ষিতা এবং তার পরিবারের মুখ বন্ধ রাখার চেষ্ঠা করা হয়। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ধর্ষিতাকে উল্টো দোষী সাব্যস্ত করে অপমান কিংবা একঘরী করার মত ঘটনাও ঘটে থাকে। আবার কোন বাছ বিচার না করে ঘটনা প্রকাশ না করে চুপ থাকার কিংবা প্রাণনাশের ভয় দেখিয়ে ভিকটিমের মুখ বন্ধ রাখার অনেক নজির আছে। এবার আসা যাক মামলা-থানা-পুলিশ নিয়ে। ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর যখন ধর্ষিতা বা তার পক্ষে কেউ মামলা করতে যায় তখন প্রায় ক্ষেত্রে থানার সংশিস্নষ্ট কর্মকর্তা মামলা নিতে রাজি হন না এবং সালিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তির পরামর্শ দেন। লজ্জ্বাজনক হলেও সত্য যে, এদেশে ধর্ষণের মামলা করতে গিয়ে পুুলিশের হাতে আবার ধর্ষিত হওয়ার নজিরও আছে। অবশ্য এই চিত্রের বাইরে ব্যতিক্রম আছে। অনেক থানায় মামলার সাথে সাথে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করার অনেক উদাহরণ আছে। মামলার পর আসে বিচার ব্যবস্থার কথা। তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে এসেও আমাদের দেশের আদালতের বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হয় ব্রিটিশ এবং পাকিসত্মান আমলে প্রণীত আইন অনুযায়ী। ফলে এতে বিচার প্রক্রিয়ায় যেমন জটিলতার সৃষ্ঠি হয় তেমনি তার অনেক ত্রম্নটি থাকে। কথায় আছে, ''আকাশের যত তারা , আইনের তত ধারা''। বাংলাদেশে নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণের বিচার করা হত ১৯৯৫ সনে প্রণীত আইন অনুযায়ী। আইনটি হল,'' ধর্ষণের শাস্তি সংক্রান্ত ৬(২) ধারা অনুসারে, যদি কোন ব্যক্তি ধর্ষণ করে কোন শিশু অথবা নারীর মৃত্যু ঘটান, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হবেন। ৬ (৩) ও ৬ (৪) অনযায়ী , যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন শিশুকে বা নারীকে ধর্ষণ করেন অথবা ধর্ষণ করে হত্যা করেন অথবা ধর্ষণের পর ওই নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে তবে ওইসব ব্যক্তি মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হবেন। '' এই আইনটি ২০০০ সনে সংশোধন করে আগে যেখানে মৃত্যুদন্ড ছিল সেখানে মৃত্যুদন্ডের পাশাপাশি মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জ্বীবন কারাদন্ডের বিধান করা হয় ( ২০০০ এর ৯ (২) ধারা)। এই সংশোধন যথেষ্ঠ বিতর্কের সৃষ্ঠি করে এবং এর মাধ্যমে পরোক্ষভাবে ধর্ষণকে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে বলে মনে করা হয়। প্রধান বিচারপতি এস.কে সিনহা একটি মামলার রায় দিতে গিয়ে এই আইনটি যথেষ্ঠ ত্রুটিপূর্ণ বলে মত দিয়েছেন। আইনের যখন এই অবস্থা তখন প্রভাবশালী ধর্ষকরা আইনের ফাক গলিয়ে সহজেই বেরিয়ে আসে আর ধর্ষণের শিকার মেয়েটি অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে। মাঝে মধ্যে এরকমও হয় যে, ধর্ষক জামিনে মুক্তি পেয়ে পুনরায় ভিকটিমকে কিংবা ভিকটিমের পরিবারের অন্য কোন নারী সদস্যকে ধর্ষণ করে।

এবার আসা যাক ধর্ষণের প্রতিকার নিয়ে। আমাদের দেশের কিছু কিছু মানুষের মনে একটা অসুস্থ ধারণা আছে যে, তারা মনে করেন  নারীর পোশাক বা স্বল্পবসন ই ধর্ষণের জন্য দায়ী এবং এতে ধর্ষকের কোন দোষ নেই। উলেস্নখ্য যে, ধর্মীয় বিচারে নারী পুরুষ উভয়ের জন্য পর্দার বিধান অবশ্য পালনীয় করা হলেও কিছু মানুষ নারীর উপর শুধু এটাকে চাপিয়ে দেয়। কিন্তু ৬ মাস বয়সী কন্যা শিশু থেকে শুরম্ন করে ৬৫ বছরের বৃদ্ধা কিংবা ৭ বছর বয়সী মাদ্রাসা ছাত্র যখন ধর্ষণের শিকার হন তখন এইসব যুক্তির অসাড়তা প্রমাণ হয় এবং ওইসব ব্যক্তিরাও যে পরোক্ষভাবে ধর্ষকের ভুমিকা পালন করেন সেটা প্রমাণিত হয়। আসলে ধর্ষণের সমস্যাটি মনসত্মাত্ত্বিক। মানসিক বিকারগ্রসত্মতা থেকে এটি সৃষ্ঠি হয়। ধর্মীয় মূল্যবোধ, পারিবারিক সুশিক্ষা, নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্ঠিভঙ্গি,মাদক ও অসৎ সঙ্গ ত্যাগ,অশস্নীল ফটোচিত্র-গল্প-ভিডিও-ওয়েবসাইট বর্জন এবং সামাজিক সচেতনতাই পারে ধর্ষণকে প্রতিরোধ করতে। পাশাপাশি আকাশ সংস্কৃতি বিশেষত বিভিন্ন বিদেশী চ্যানেলে প্রদর্শিত কুরুচিপূর্ণ-যৌন সুড়সুড়িমূলক অনুষ্ঠান আমাদের দেশে সম্প্রচার বন্ধ করে দেশীয় সংস্কৃতির সাথ সামঞ্জস্য অনুষ্ঠান প্রচার করতে হবে এবং ধর্ষণের সর্বোচ্চ এবং একমাত্র শাসিত্ম হিসেবে মৃত্যুদন্ডের বিধান করতে হবে। নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণ যাতে না ঘটে সেজন্য টেলিভিশন-রেডিও, পত্র-পত্রিকা এবং সামাজিক মাধ্যমে সরকারী-বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালাতে হবে। স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের হাতে মোবাইল-ট্যাব তুলে দেয়ার ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে এবং সেগুলোর অপব্যবহার সম্পর্কে সচেতন করতে হবে, পাশাপাশি নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে। আরেকটা ব্যাপার না বললেই নয়, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে যৌন মিলনে, কিংবা বিয়ের আগে কোন রকম যৌন সম্পর্কে জড়ানোর ব্যাপারে সবাইকে বিশেষ করে আমাদের তরম্নণ প্রজন্মকে সাবধান হতে হবে। কারণ এগুলো কখনোই ভালো ফল বয়ে আনে না।

পরিশেষে একটা কথাই বলব, নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণ রোধে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে পুরষতান্ত্রিক এই সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে তার সম্মান আদায় করে নিতে হবে। আমরা মুখে যতই প্রগতিশীলতার কথা বলি না কেন, নারীদের সম্পর্কে আজোও আমাদের দৃষ্ঠিভঙ্গি সেই মধ্যযুগীয় আমলের মত। যতদিন নারীরা তাদের অধিকার সচেতন না হচ্ছেন, ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতনের বিরম্নদ্ধে রম্নখে না দাঁড়াচ্ছেন ততদিন ধর্ষণ বাড়তেই থাকবে। যে সমাজে ধর্ষকে বীর হিসেবে বিবেচনা করা হয় সেই সমাজে নারীকে বেগম রোকেয়া, ইলা মিত্র আর প্রীতিলতার চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আত্মহত্যার মত কাপুরোষিত উপায়ে সমাধান না খুঁজে প্রতিবাদী হতে হবে। একটু প্রতিবাদ করে দেখুন , আপনি/আপনারা একা নন,এই প্রজন্ম পাশে এসে দাঁড়াবে। ধর্ষকের শাসিত্মর পাশাপাশি তার পরিবারকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক, ধর্ষিতার নয় ধর্ষকের ছবি ছড়িয়ে দেয়া হোক সর্বত্র। ৩০ লক্ষ শহিদের উৎসর্গিত ভূমি ধর্ষক মুক্ত হোক। সুন্দর সমতার বাংলাদেশ গড়ে উঠুক।