আমাদের জীবন বনাম আমাদের জীবিকা

সারোয়ার ইবনে গিয়াস
Published : 12 Jan 2018, 02:42 AM
Updated : 12 Jan 2018, 02:42 AM

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই শীতের তীব্রতায় ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কক্ষের পাকা মেঝেতে পা রাখতে পারছিলাম না। তখন পাপোশ ঠেলে ঠেলে এদিক-ওদিক যাচ্ছিলাম। অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে, বের হতে হবে- তাই তাড়া ছিলো। কিন্তু সে স্বল্প সময়েই 'জীবন এর মানে কি'- প্রশ্ন মনে এসে উঁকি দিয়ে গেলো। স্বল্প সময়ের একটা জীবন, তার জন্য কতোই না সংগ্রাম, প্রচেষ্টা, মরিয়া হয়ে ধান্ধা করা। অথচ জীবন একটাই, যেখানে জীবিকার হাজারো পথ খুঁজে ফেরা হয়। হালের ওয়ারেন্ট বাফেটের উক্তি, 'মানুষ খুব গিলেছে, স্বাবলম্বী ভাবে বেঁচে থাকতে আয়ের মাত্র একটা মাধ্যমই যথেষ্ট নয়। আরোও চাই, আরোও একটা বা কয়েকটা। মানুষ দৌড়াচ্ছে, খুঁজছে, এক ধান্ধা খুঁজতে গিয়ে আরোও ধান্ধার জন্ম নিচ্ছে।'

পুরোনো জীবিকার মাধ্যম বিদায় নিচ্ছে। কারণ, গ্রাহক তার স্বাদ বদলাচ্ছে। আর সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে ধান্ধা করণেওয়ালারও তাদের ঐতিহ্য বদলাচ্ছেন। অথচ, কর্মে ঐতিহ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। বৃটেনে প্রথা মানা হয় আইন না হবার ভয়ে। তারা বলে, প্রথা মানলে আইন করার ঝামেলা থাকেনা। আইন না মানলে আইন-অমান্য হয়, কিন্তু প্রথার সাথে সামাজিক বোধ জড়িত। আর তাই তারা প্রথাকে গুরুত্ব দেয়, যেমন করে পেশাতেও প্রথা বা ঐতিহ্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কালের পরিক্রমায় জীবন-হিসাব মেলাতে গিয়ে জীবিকার উপায় অন্বেষণে মানুষ দৌড়াচ্ছে।

আগে হোটেল পানি ফ্রি-তে পাওয়া যেতো, এখন ফিল্টার করেই টাকা রেখে দেয়। আগে রাস্তায় তৃষ্ণা পেলে রাস্তার পাশের বাড়িতে মানুষ হাক দিতো, আর এখন চিন্তাও করা যায়না। কারণ, সহজলভ্যতা মানুষের সম্পর্ককে দূরতম করে দিয়েছে।

জ্যন্ত একটা মানুষ যেকোন সময় খুন হয়ে হারাতে পারে তার জীবন স্রেফ অন্য জনের জীবিকার প্রশ্নে। আমি অনেক পোলট্রি ফার্মের মালিককে দেশী মুরগী বেশি দামে কিনে নিয়ে খেতে দেখেছি, কিন্তু আমরা তার দোকান থেকেই কিনি জীবনে বাঁচাতে খাওয়া লাগে বলে, আর যিনি বিক্রি করেন সেটা তার জীবিকার প্রশ্ন। এই জীবিকাই অনেক সময় অনেকের জন্য গ্লানি বয়ে আনে আর অনেকের জন্য সম্মান।

মজার ব্যাপার দেখুন- জীবন বাঁচাতে জীবিকার প্রশ্নে কিছু শ্রমজীবি মানুষ বিদ্যুৎ চালিত রিক্সা নিয়ে রাস্তায় বের হয়েছিলো। কিন্তু, দুর্ঘটনার ক্রম বৃদ্ধিতে তা নিষিদ্ধ করে দেয়া হয় এক সময়। অথচ, পা দিয়ে প্যাডেল মারা যে কতো কষ্ট তা তারাই জানে যারা প্যাডেল মারে। শুধু অন্যের জীবনের নিরাপত্তার জন্য একজনের জীবিকা নির্ধারণ করে দেয়া হলো। এ নিষিদ্ধতা সমাজের সামনে, কিন্তু আড়ালে সব লেনদেন হয়। আর এখানেই মানব সভ্যতার বড় পরাজয়। সমাজের দুইটা রূপ। একটা মুখোশের আড়ালে আর অন্যটা প্রকাশ্যে। অথচ, ভালো হোক আর মন্দ- একটা হলে দোষ কি ছিলো!

জীবিকার প্রশ্নে জীবন দূষিত আর না করি চলুন। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা, প্রকৃতিতে খুব ভালো সার্কেল ম্যান্টেন হয়। ওই যে, দুধ-পানি-ভেজাল-ইত্যাদি ইত্যাদি সার্কেল গল্পটা জানা আছেতো? আসুন, জীবিকার প্রশ্নে জীবন আর দুর্বিষহ না করি।