সুনামগঞ্জের পরিবহন ভাড়া: যেখানে তেল আর ঘিয়ের দাম সমান!

সারোয়ার ইবনে গিয়াস
Published : 8 March 2018, 03:08 AM
Updated : 8 March 2018, 03:08 AM

আমার জন্ম মফস্বল জেলা শহরের অজ উপজেলা তাহিরপুরের এক জনবিচ্ছিন্ন গ্রামে। ছোট থেকে বেড়ে উঠা সেখানেই। বড়জোর বাইসাইকেল চালিয়ে গতি পরীক্ষা নিতাম। দুই চাকার মোটর বাইক চালিয়েছি বেশ বুঝ হবার পর। পাকা রাস্তা বলতে বাজারের পাশে বাড়ি হওয়ায় বাজারের পাকা রাস্তা দেখা।

আস্তে আস্তে দিন বদলালো। জেলা শহরের সাথে যোগাযোগের বেশ কিছু স্থান পাকা হলো। জেলা শহরের ২৫-৩০ কিলোমিটার আগে যেখানে বাইসাইকেল চালিয়ে যেতাম, সেখানে আমরা শুরু করলাম ভাড়ায় চালিত মোটর বাইক দিয়ে, হালের রাজধানী শহরের উবার যা করে। আমরা কিন্তু তা বেশ আগে থেকেই শুরু করেছিলাম। পার্থক্য, বেশিরভাগ গাড়ির না ছিলো কাগজ, আর না ছিলো ড্রাইভিং লাইসেন্স (এখন বেশিরভাগ আছে)। তা হালের ক'জনের লাইসেন্স আছে তা ট্রাফিক পুলিশের গাড়ি আটকানো দেখে জেনেছি শহরে বসবাসরত অবস্থায়।

বছরের পর বছর আমাদের গতি দিয়ে এসেছিলো এই দুই চাক্কার বাহনের তীব্র গতিশীল ড্রাইভাররাই কিন্তু। এখন জেলা সদর থেকে বেশ কয়টি উপজেলায় সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হয়েছে। তিন চাক্কা বা চার চাক্কা (পাবলিক বাহন খুব কম, যা আছে তা ট্রাক বেশি) বাহন যুক্ত হয়েছে এবং দুই চাকার বাহন ভাড়ায় অলিখিত নিষিদ্ধ হয়েছে। অথচ, হাওরের দিকে কিংবা যেসব নদীতে এখনো ব্রীজ হয়নি তাদের শেষ ভরসা এখনো তারাই, যারা যারা যুগ ধরে আমাদের সেবা দিয়ে আসছিলেন। দিন গিয়েছে অনেক। তেলের দাম বেড়েছে, রাস্তা কমেছে, কিন্তু দুই চাকার ভাড়া আগের মতোই আছে কিংবা ক্ষেত্রে বিশেষ কম রয়েছে।

কিন্তু, যারা সিএনজি চালান তারা বেশি সংঘবদ্ধ, তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়ান। সকালে, দুপুরে, সন্ধায় আর রাতে ভিন্ন ভিন্ন ভাড়া। আর গড় রেট দুই বা তিন চাকা সব সমান। সময় বাঁচাতে আমরা যারা কয়েকটা নদী নৌকায় পাড়ি দেই তাদের ভরসা এই দুই চাকার বাহন। গ্রামের কিছু পরিবার তাদের ছেলে-মেয়েদের শহরে পাঠাতে তাদের উপর ভরসা করতেই হয়। আমরা বাধ্য।

একটু লোকাল সিএনজি ভাড়ার চিত্র দেই। সুনামগঞ্জ থেকে জামালগঞ্জ, এই ২৯ কিলোমিটারের সিএনজি ভাড়া ৮০ টাকা। সুনামগঞ্জ থেকে দিরাই দূরত্ব হলো ৩৮ কিলোমিটার, সিএনজি  ভাড়া ৭০ টাকা। সুনামগঞ্জ থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরত্বে তাহিরপুরের ভাড়া হলো সিএনজি যোগে মাথাপিছু ১০০ টাকা! এর কারণ একটাই। এখানে তেল আর ঘি এর দাম সমান এবং এসব দেখার জন্য কেউ নেই।

সুনামগঞ্জ থেকে দিরাই, সাচনা (জামালগঞ্জ) দোয়ারাবাজার সহ বিভিন্ন রাস্তায় চলাচল একদিন করলে বুঝবেন, রাস্তা দেবার নামে কি এক পাপের শাস্তি এই জেলার মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। দেবে যাওয়া ব্রীজ আর লাখো গর্তের রাস্তা হলো আমাদের সুখ! হাড়গোড় এক হয়ে যায় একবারের চলাচলেই। কোন নির্দেশনা নেই, কোন ধরনের শাস্তি নেই যারা এখানে এসব বাজে রাস্তা বানিয়েছেন তাদের। শুনেছেন হয়তো, হাজার হাজার কোটি টাকার হাওড় ডুবে গেলেও কেউ কোন শাস্তি পায়না। যেন হীরক রাজার দেশ আমার সুনামগঞ্জ! যে দেশে তেল আর ঘিয়ের দাম সমান, সে দেশে ন্যায়বিচার আছে কি-না তা আশাকরি জ্ঞানীদের বুঝিয়ে বলতে হবেনা।

আচ্ছা, তাহিরপুরের মানুষ এতো ভাড়া দিবে কেন? সিএনজি ড্রাইভারদের ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকার পরেও কেবল মোটর সাইকেল চালকদেরই আটকানো হবে কেন?

একটা সময় এ অঞ্চলে অনেক ডাকাতি হতো। সেসময়ের অনেক ডাকাত আজ দুই চাকা চালিয়ে হালাল খায়। তাদের ডাকাতি কাজ আস্তে আস্তে বন্ধ না করে উল্টো এভাবে চমক লাগানো শাস্তি দিলে কি এলাকার মানুষ ভালো থাকবে? কোন একটা নির্দিষ্ট শ্রেণিকে খুশি করার জন্য এ কোন ধরনের মগের রাজত্ব আমার প্রিয় জেলা! আগেই বলেছি, ভাড়ার কোন মা-বাপ নেই। কোন ধরনের তদারকিও নাই। আমরা যাদের নিজের গাড়ি নেই, তারা অধম প্রজার মতো আসা-যাওয়া করি।

তাই সবিনয়ে নিবেদন- কোন হুজুর যদি আমার লেখা পড়েন, বেয়াদবি না নিয়ে পারলে কিছু উপকার করিয়েন। পরকালে বিশ্বাস থাকলে তার বদলাও পাবেন।