‘স্টুপিড চক্কর’র বিস্ময় আর অপরাধী মানুষটির টোটালিটি সংক্রান্ত

সারওয়ার চৌধুরী
Published : 1 August 2011, 02:25 AM
Updated : 1 August 2011, 02:25 AM

জগত বিশ্লেষণের সাথে সম্পর্কিত মানুষের আচরণ বিশ্লেষণ দ্বারা সামগ্রিক 'মানুষ' ধারণাটিকে ধরে ফেলা যায় নি এখনো দার্শনিকগণ কর্তৃক। এতটুকু শনাক্তকরণ সম্ভব হয়েছে যে, মানুষ মাইক্রোকসমস বা মিনি মহাবিশ্ব। এবং শনাক্ত করা গেছে মানুষ Spiritual and Corporeal Being এর দ্বৈততা।

সহজবোধ্য একটা ব্যাপার এই যে,একটি অংকের ভেতরে থাকা যোগ বিয়োগ পূরণ ভাগ সুসম্পন্ন হয়েছে বলা যায় তখন, যখন নিয়ম মোতাবেক ফল বা সিদ্ধান্ত বের হয়; তা না হলে অসম্পূর্ণ, অসমাপ্ত। অসমাপ্ত বিশ্লেষণের বরাত দিয়ে মাস্টারি করা, যাতে দেখানো হয়, অংকটির মেকানিজমের টোটালিটি ধরে ফেলা হয়েছে, তাহলে সেই মাস্টারি ত্রুটিপূর্ণ বলবার অধিকার থাকে।

তবু মানুষকে জীবন ধরে রাখবার নিমিত্তে (কোরপোরিয়েল জার্নিতে বসত করবার)ঘাটে ঘাটে, পদে পদে, পর্যায়ে পর্যায়ে বিবিধ প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কোনো সিদ্ধান্ত সঠিক হচ্ছে না টের পেয়েও নিয়ে ফেলে নিজকে 'রক্ষা' করবার জন্যে। দেখা গেছে 'রক্ষা' ব্যাপারটা জগতে গভীরতর ধারণাকে ধারণ করে না। আজিকার একটি 'রক্ষা' আগামীকালের/আগামীমাসের/আগামীবছরের/আগামীযুগের/আগামীশতাব্দীর বিপর্যয়ের ভূমিকা হতে পারে। ফলে, মানুষের 'রক্ষা' ও 'বিপদ' সংক্রান্ত ধারণা বিন্যাস অধিকাংশ ত্রুটিযুক্ত।

একজন খালেদ/মিলন/স্টিফেন/কান্ত তার স্ত্রীকে বললো- 'বিষয়টা আমাদের দুজনের, ওটা নিয়ে তুমি তোমার মায়ের সাথে পরামর্শ করতে যাওয়া ঠিক হয় নি।' এই যে 'আমাদের দুজনের', এর ভেতরে 'আমি' আর 'তুমি' সম্মিলিতভাবে দেখা যাচ্ছে জোর দিচ্ছে একটি 'আমি' এর উপর, যা 'আমাদের দুজনের'র দাবীর কথা বলছে। এই খালেদ/মিলন/স্টিফেন/কান্ত যখন অন্য গ্রামের কোনো গোষ্ঠীর বিপক্ষে কথা বলে, তখন, তার 'আমাদের' বলার ভেতর অনেকগুলো 'আমি' 'তুমি', নিজের মা বাবা ভাই বোন স্ত্রী পুত্র কন্যা ইত্যাদি অনেকের সম্মিলিত একক 'আমাদের'র। ভাষার হিসাবে 'আমাদের' শব্দটি বহুবচন। কিন্তু এর মধ্যে একটি গোষ্ঠীর 'আমি' হয়ে আত্মপ্রকাশ। একইভাবে খালেদ/মিলন/স্টিফেন/কান্ত রাজনীতি-অর্থনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট নানা প্রকার 'আমি'র সাথে যুক্ত হয়ে 'আমরা' শব্দ ব্যবহার করে প্রতিদিন হাজারবার। দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তির 'আমি' আর বহুবিধ সমস্টির 'আমি' ভিন্ন ভিন্ন তাত্পর্য বহন করছে স্থান কাল পাত্র সাপেক্ষে। (এতোদিনে বুঝলাম, ফ্রেদরিক হেগেল কেন জানিয়েছিলেন 'আমরা' এর ভেতরে 'আমি'। বুঝলাম, ব্যাকরণ ত্রুটি দেখালেও 'আমাদের ব্যক্তিগত' বলা জায়েজ আছে।)

কিন্তু, খালেদ/মিলন/স্টিফেন/কান্ত (কোনো একজন উদাহরণ হিসাবে) মানুষটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর, নির্দিষ্ট গ্রামের, নির্দিষ্ট শহরের, নির্দিষ্ট পাড়ার, নির্দিষ্ট থানার, নির্দিষ্ট জেলার, নির্দিষ্ট দেশের পরিচয়গুলোর ভেতর 'আমি' ও 'আমরা' একটা নির্দিষ্ট সময়ে ধারণ করেও সে বিশ্বের 'মানবজাতি' ধারণার সদস্য। দেখা যায়, খালেদ/মিলন/স্টিফেন/কান্ত এর 'আমি'টি মূর্খতার কারণে রেইসিস্ট হয়, সাম্প্রদায়িক হয়, আঞ্চলিকতাদুষ্ট হয়, স্বার্থান্ধ হয়, যুদ্ধবাজ হয়, তবু সে মানবজাতির বহুবিধ 'আমরা' এর সাথে যুক্ত থাকছে এবং 'মানবজাতি' ইউনিটের সাথেও থাকছে, প্রাণীকূলের সাথে থাকছে। (একটু দূরতম প্রাসঙ্গিক এই যে, ভাষাভিত্তিক আরব ন্যাশনালিজমকে ধারণ করেও ভিন্ন ভিন্ন আরব দেশগুলোর নাগরিকেরা দেশ ভিত্তিক জাতীয়তার চেতনা লালন করে। আবার অর্থ কামাইয়ের দৌড়ে ওই চেতনাকে প্রয়োজনে চাপা দিতেও কুন্ঠাবোধ করে না।)

মানুষের কাছে শিকলের/রশির/রজ্জুর ধারণা আছে। এর থেকে নির্মাণ বিনির্মাণ পর্যায়ক্রমে। শিকলবন্দী মানুষ শিকল ভাঙ্গার গানে আনন্দ পায়! বন্ধনেই সারাত্সার, বন্ধনেই সকল ক্রীড়া। শিকল নির্দিষ্ট সীমার ভেতরে, নির্দিষ্ট মাত্রায় 'স্টুপিড চক্কর' দিলেই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা যায়। চক্করটা স্টুপিড কেন? আপাতদৃষ্টিতে স্টুপিড কিন্তু বুদ্ধিজাত চক্কর। বোকামী আচ্ছাদিত বুদ্ধি! কিংবা বোকামী আর চালাকির সম্পর্ক! নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে, নির্দিষ্ট মাত্রায় ঘুরতে ঘুরতে কাজ সারা, মকসুদ হাসিল। বাইসাইকেলের প্যাডেল ঘূর্ণনের মধ্যেই প্রলম্বিত পথে সাইকেলের চলতে থাকা। ওটা লজিক্যাল প্যারাডক্সের চমত্কার দৃষ্টান্ত। তাছাড়া অজস্র ঘূর্ণনের দ্বারা ঠান্ডা গরম, ঘূর্ণনের ফজিলতে মাধ্যাকর্ষণের ভেতরে ওঠা নামা। ঘুরতে ঘুরতে দিন রাত, ঘুরতে ঘুরতে দিন মাস বছর শতাব্দী সহস্রাব্দ। ব্যক্তি 'আমি' শিকলের কারিশমা, ঘূর্ণন, বন্ধন, গতির পরিপ্রেক্ষিতগুলোর সাথে স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় জড়িয়ে যায়।

"The only thing we learn from history is that we learn nothing from history." কথাটা হেগেলের। দেখা গেছে, সমস্যা ঝুলে থাকবার অন্যতম কারণ, খালেদ/মিলন/স্টিফেন/কান্তগণ যদি আইনস্টাইন/শেক্সপিয়র/গাজ্জালীর বংশজাত হয়, তবু নিয়মমাফিক মানুষের সন্তান শিশু আকারে, অজ্ঞতা সহকারে পৃথিবীতে আসে এবং শিশুরা পৃথিবীর পথে হাঁটা শিখে আছাড় খেয়ে খেয়ে, বয়সের পর্যায় অতিক্রম করে সাবালক হয়, বুঝাবুঝির ধাপগুলো পার হয়, নিজগুণে জগত সমস্যা বুঝে নেয়ার প্রবণতাও লালন করে।

-সারওয়ার চৌধুরী
৩১/০৭/ ২০০১১
ইউএই