লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন দিক ও জনমানসে প্রণোদনা

গোলাম কিবরিয়া পিনুগোলাম কিবরিয়া পিনু
Published : 23 Sept 2011, 03:33 PM
Updated : 8 Oct 2016, 11:57 AM

বাংলাদেশের লোকঐতিহ্য বৃহত্তর জীবন থেকে উৎসারিত; এ জীবন এখনও বয়ে যাচ্ছে। এ দেশের লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন ধারা বিভিন্নভাবে এখনও সচল। বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির ভাণ্ডার দেখে বিদেশি বহু গবেষক অবাক হয়ে যান, অথচ এ সমৃদ্ধ লোকসংস্কৃতি দেখে আমরা শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত সমাজ অবাক হই না! কারণ, আমাদের মধ্যবিত্ত শহুরে জীবনে এর তেমন কোনো প্রভাব নেই; এই সংস্কৃতির বদলে অন্য সংস্কৃতির প্রভাব ও আকর্ষণ বেশি।

উন্নত দেশ বলে যাদের আমরা মনে করি, সেসব দেশে লোকসংস্কৃতির ধারা শিক্ষিত ও নাগরিক জীবনে প্রভাব ফেলে; সেই ধারা আকর্ষণ আর চর্চায় অবহেলিত নয়। সচেতন ও নিজস্ব গৌরববোধে তা নিজেদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে ওঠেনি। অথচ আমাদের দেশে নতুন গড়ে ওঠা শহুরে মানুষের কাছে নিজস্ব লোকসংস্কৃতির ধারা গুরুত্ব ও আকর্ষণে উপস্থিত নয়।

এর কারণ কী?

আমরা নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য তৎপর নই। নির্ভরতা বিদেশের ওপর– অর্থনৈতিকভাবে, সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক থেকেও। এই পরনির্ভরশীল মানসিকতার কারণে আমরা নিজেদের দিকে তাকাই না, নিজের সম্পদ ও সম্ভাবনার দিকেও তাকাই না। একইভাবে লোকসংস্কৃতির গভীরে প্রবেশ করি না, লোকসংস্কৃতিকে জীবনের আহ্বানে সম্পর্কিত করি না, লোকসংস্কৃতিকে সচেতনভাবে নির্বাচন করি না।

লোকসংস্কৃতি উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত-শিক্ষিতজনের কাছে 'গ্রাম্য' বলেই বিবেচিত। অনেকে নাক সিটকিয়ে থাকেন। কিন্তু লোকসংস্কৃতির অনেক উপাদানই উচ্চবিত্তের ড্রইংরুমে শোভা পায়। হয়তো সৌন্দর্য সচেতনতায় তা ভালোই, ক্ষতিকর বলে মনে করার কারণ নেই।

নকশিকাঁথা চকচকে ঘরে শোভা পায়, ড্রইংরুমে শোভা পায়, লোকশিল্পের হস্তনির্মিত বিভিন্ন সামগ্রী ড্রইংরুমে প্রদর্শিত হয় এর বৈচিত্র্যময় আবেদনের কারণে। এ ছাড়া লোকসংস্কৃতির সামগ্রী বিদেশে রপ্তানি করে অনেকে টাকা-পয়সা রোজগারে সফলও হচ্ছেন। এভাবে একদিকে লোকসংস্কৃতির ব্যবহার ও চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু দেশের মানুষের কাছে তা গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্যে টেনে আনছে না।

এ জন্য সচল ও সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। তেমন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠতে পারে আপন সংস্কৃতির প্রতি টান থেকে, মান থেকে; গড়ে উঠতে পারে জীবনকে নিজস্ব ঐতিহ্যে রূপময় করে বিকশিত করার ইচ্ছে থেকে। এ জন্য জাগরণ প্রয়োজন বিভিন্ন স্তরে।

বছরে এক বারও উল্লেখযোগ্যভাবে লোকসংস্কৃতির উৎসব জাতীয়ভাবে হয় না; হয় না জেলা পর্যায়েও। লোকসংস্কৃতির প্রাণ লোকগীতির উৎসব কি জাতীয়ভাবে ব্যাপক জনগণের উপস্থিতিতে পহেলা বৈশাখ বা অন্য কোনো সময় বা বিশেষ জাতীয় দিবসে ঢাকাসহ অন্যান্য এলাকায় পরিকল্পিতভাবে অনুষ্ঠিত করা যায় না? এ ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।

শিল্পকলা একাডেমী বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। তারা শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করে লোকসংস্কৃতি সংরক্ষণে ও বিকাশে পরিপূরক অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে। অন্যান্য সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানও এগিয়ে আসতে পারে। লোকগীতিকে গুরুত্ব দিয়ে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী জাতীয়ভাবে তাদের সীমিত শক্তির মধ্যে দিয়েও ঢাকায় লোকগীতির উৎসব পালন করে থাকে, যা একটি সচেতন উদ্যোগ।

আরও উৎসবমুখরতায় লোকগীতির উৎসব করার উদ্যোগ গ্রহণ করে লোকগীতির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো যেতে পারে। লোকগীতির বিভিন্ন চারিত্র এ দেশের বিভিন্ন সুরে বিভিন্ন বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধভাবে অবস্থান করছে। অঞ্চল ভেদে আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে তা উজ্জ্বল। এই উজ্জ্বলতা সব মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার– এ জন্য সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম দরকার।

তথাকথিত অনেক আধুনিক গানের একঘেয়ে সুর ও সাধারণ কথায় বর্তমানে গানের যে অবস্থা, তাতে মন স্পর্শ করে না অনেকের। তথাকথিত আধুনিক গানের নামে অনেক গান স্থূল ও বৈচিত্র্যহীন। এর বেশির ভাগ গান চলতি সিনেমার প্রয়োজনে রচিত হয়ে থাকে। সে কারণে গতানুগতিক সিনেমার মতো গানগুলোও গতানুগতিক।

এর বিপরীতে লোকগীতি হয়ে উঠতে পারে শ্রোতাদের কাছে বৈচিত্র্যপূর্ণ ও আকর্ষণীয়। লোকশিল্পীদের কদর বাড়াতে হবে, লোকশিল্পীদের মর্যাদা বাড়াতে হবে রেডিও, টিভি ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে। পাশাপাশি তরুণ ও ভালো শিল্পীরা যেন লোকগীতি ধারণ করে এগিয়ে আসতে পারে– সেদিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন।

অনেক লোককাহিনি এখনও গ্রাম-বাংলায় টিকে আছে। অনেক কাহিনি নিঃশেষিত। এখনও অনেক লোককাহিনি টিকে আছে– গল্পে গল্পে যুগ যুগ ধরে স্মৃতিনির্ভর বর্ণনায়, বংশপরম্পরায়। সেসব লোককাহিনি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হতে পারে। শিশু-কিশোরদের উপযোগী করে সেগুলো প্রকাশিত করা যেতে পারে।

অনেক প্রচলিত লোকছড়া আছে, সেসব 'আনন্দের সম্পদ' সংগ্রহ করে শিশুদের হাতে তুলে দেওয়া যেতে পারে। এ বিষয়ে বাংলা একাডেমি ও শিশু একাডেমীসহ উৎসাহী প্রকাশকরা উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। এর ফলে শিশুদের আনন্দভুবন আরও বড় হয়ে উঠতে পারে। শিশু সাহিত্যের দিকটিও আরও সমৃদ্ধ হতে পারে।

লোককাহিনি, ছড়া, প্রবচন ইত্যাদি সমৃদ্ধ 'খনি'। এই খনি আবিষ্কার হয়ে আছে। এটাকে শুধু ব্যবহার করার জন্য পদ্ধতি ও কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন।

লোকসংস্কৃতির আর এক সমৃদ্ধ ভুবন– হস্তশিল্প। এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবন ছুঁয়ে বহু যুগ ধরে হস্তশিল্পের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি হয়ে আসছে। এসব তৈরিতে ব্যক্তি মানুষের মেধা, নৈপুণ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কিত হয়ে ওঠে। নকশিকাঁথা সুচারুভাবে সৌন্দর্য চেতনায়, কৌশলী হাতের শ্রমে তৈরি হয়ে ওঠে।

কাঁথা এ দেশের মানুষের প্রয়োজনীয় সামগ্রী হিসেবে যুগ যুগ ধরে উৎপন্ন হয়ে আসছে। নারীরা গাছের ছায়ায়, উঠানে, ঘরের কোণে নিভৃত সময়ে কাঁথা তৈরি করে থাকে। অবসর জীবনের সঙ্গী হয়ে কাঁথা শিল্পময় মুহূর্ত রচনা করে।

কুমার শ্রেণি এ দেশের এক অনিবার্য শ্রেণি হিসেবে অবস্থান নিয়েছে, যদিও বিভিন্ন ঘাত-প্রতিাঘাতে এ শ্রেণির অবস্থান বিলীন হওয়ার উপক্রম। তবু এখনও এদের শ্রমে গ্রামীণ মানুষের প্রয়োজনে মাটির বহু ধরনের সামগ্রী তৈরি হচ্ছে। শহুরে মানুষের প্রয়োজনেও ফুলের টব ও অন্যান্য জিনিস এরা তৈরি করে থাকে। মাটির খেলনা এখনও গ্রামীণ জীবনে প্রচলিত রয়েছে।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন হস্তশিল্প এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে। কোথাও বেতশিল্প, কোথাও বাঁশশিল্প, কোথাও কাঠশিল্প, কোথাও চামড়াশিল্প, কোথাও শাড়ির বুননশিল্প ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ হয়ে আছে। হস্তশিল্পের পরিসর এ দেশে ছোট নয়। কিন্তু হস্তশিল্পের সঙ্গে যেসব পেশাজীবী জড়িয়ে আছেন, যারা শ্রমঘন সময় ব্যয় করে এসব সামগ্রী নির্মাণে নিবেদিত থাকেন, তারা বিভিন্নভাবে শোষিত।

তারা পণ্যের সঠিক মূল্য পায় না। তাদের তৈরি পণ্য কয়েক হাত বদল হয়ে বিক্রি হয়, পণ্যের যে নিম্নহারে মূল্য তারা পায়– তা তাদের সংশ্লিষ্ট পেশায় টিকে থাকার জন্য কষ্টকর এবং চ্যালঞ্জিং। এ বিষয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট সহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ড দরকার, পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি। তা না হলে হস্তশিল্পের সম্ভাবনা যেটুকু আছে, তা-ও হারিয়ে যাবে।

বাংলা নববর্ষে ও বিভিন্ন জাতীয় দিবসে মেলার আয়োজন করে হস্তশিল্পের প্রদর্শনীমূলক বিক্রির ব্যবস্থা আরও জোরদার করা প্রয়োজন। রাজধানীতে বেশি সময় ধরে এ ধরনের মেলার আয়োজন করা যেতে পারে। শুধু রাজধানীতে নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ বিশেষ দিনে মেলার ব্যবস্থা করা যায়। এ ছাড়া এসব পণ্যের জন্য বিক্রয়কেন্দ্র বেশি সংখ‌্যায় খোলা প্রয়োজন। বিসিক এ ক্ষেত্রে সীমিতভাবে হলেও ভূমিকা রাখছে।

লোকসংস্কৃতির আরেক ঐশ্বর্য– গ্রামীণ খেলাধূলা। যুগ যুগ ধরে লোকজীবনের প্রবহমান আনন্দের ধারা বিভিন্ন লোকজ খেলাধূলায় প্রাণ পেয়ে আসছে। এসব খেলাধূলার জগৎ বেশ বৈচিত্র্যময়। কত ধরনের খেলা গ্রামীণ জীবনকে টান টান করে রেখেছে সে পরিসংখ্যান নিলে বেশ আশ্চর্য হতে হয়। ছড়ার ছন্দে বিভিন্ন কথকতায় শিশু-কিশোরদের খেলা আনন্দকে মূর্ত করে তোলে, তা বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ব্যঞ্জনায় ধরা পড়ে। শিশু-কিশোররা ঘরে বসে অল্প কজন সাথী নিয়ে বহু খেলায় অংশ নিয়ে নির্মল আনন্দ পেয়ে থাকে। দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, বুড়িছি, হাডুডু, এক্কাদোক্কা, কাবাডি, লাঠিখেলা, নৌকাবাইচ, পতুলনাচ ইত্যাদি খেলা এখনও গ্রামীণ জীবন আনন্দময় করে রাখে।

লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন ধারা আজ শুকিয়ে যাচ্ছে কেন? গ্রাম জীবন যেমন অবহেলিত, গ্রামীণ মানুষ যেমন অবহেলিত, তেমনি লোকসংস্কৃতিও অবহেলিত। অবহেলায় লোকসংস্কৃতির সহজ-সরল ধারা আজ শহরের সংস্কৃতির সঙ্গে সংঘর্ষে উপনীত হচ্ছে। শহরের জগাখিচুড়ি সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে লোকসংস্কৃতির দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। এ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন শক্তি। এ ছাড়া গণমাধ্যম যেমন রেডিও, টিভি, চলচ্চিত্র ইত‌্যাদি কোনো কোনো ক্ষেত্রে লোকসংস্কৃতিকে শুধু দূরে ঠেলে দিচ্ছে না, অনেক ক্ষেত্রে 'শত্রুর' ভূমিকা রাখছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গণমাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে লোকসংস্কৃতি অবহেলিত, সেই সঙ্গে অবহেলিত বেশির ভাগ মানুষের জীবন, গ্রামীণ জীবন, ঐতিহ্যের জীবন এবং যুগ যুগ ধরে লালিত সংস্কৃতি।

রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম– সংস্কৃতির ধারাকে বেশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে; সে কারণে এসবের ওপর সংস্কৃতির বিকাশও নির্ভরশীল। কিন্তু এসব কি বাংলার লোকসংস্কৃতিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়? টিভি এখন সর্বগ্রাসী মাধ্যম, যার প্রভাব জনজীবনে বেশ পড়ছে। টিভিতে লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন দিক যদি তুলে ধরা হয়, তাহলে লোকসংস্কৃতির পক্ষে জনমানসে একধরনের প্রণোদনা তৈরি হবে, যা এই সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও বিকাশে বিশেষ সহায়তা করবে।

লোকসংস্কৃতিকে বিজ্ঞাপনের মতো বিজ্ঞাপিত করার কথা বলছি না। গণমানুষের সংস্কৃতিকে গণতান্ত্রিক দৃষ্টিতেই গণমাধ্যমে মর্যাদা দেওয়া উচিত।

নিজেদের আত্মনির্ভর দর্শনে নিজেদের জীবনকে আরও সৌকর্যপূর্ণ করার লক্ষ্যে লোকসংস্কৃতির ধারাকে বাঙালি সংস্কৃতির মূলধারায় বেগবান ও উজ্জ্বল করে রাখতে হবে।