ভাসানী কেন আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে এলেন?

শেরিফ আল সায়ার
Published : 6 July 2020, 11:09 AM
Updated : 6 July 2020, 11:09 AM

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। পরদিন পূর্ব পাকিস্তানের চিফ মিনিস্টার নূরুল আমিন তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন, "ওটা ছ'মাসের দল"। নূরুল আমিন মারা গেছেন ১৯৭৪ সালে। নিশ্চয়ই দেখে গেছেন ছয় মাসের দলটির রাজনৈতিক নেতৃত্বে ৭ কোটি বাঙালি একটি স্বাধীন দেশের মানচিত্র এঁকে দিয়েছে। সেই দলটি ২০২০ সালে ৭১ বছর বয়সে পা দিলো।

আওয়ামী লীগের জন্মই হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল হিসেবে। সদ্য পাকিস্তান পরিচয় পাওয়া একটা জাতি দুই বছরের মাথায় অনুভব করেছে মুসলিম লীগের রক্ষণশীল রাজনীতি দিয়ে এই অঞ্চলে অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তারই ধারাবাহিকতায় উত্থান ঘটে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।

আমার এই লেখার বিষয় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। অনেক খেয়াল করে দেখেছি, বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাসানীকে নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না। ফলে আমরা অনেকেই ভাসানী সম্পর্কে খুব একটা জ্ঞান রাখি না। তার সম্পর্কে বিচ্ছিন্ন কিছু তথ্য সকলের জানা রয়েছে। তবে বৃহৎ অর্থে ভাসানী চর্চাই হয় না আমাদের ইতিহাসে।

বাঙালি জাতির স্বাধীকার আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। প্রতিটি পর্যায়ে কোনো না কোনো নেতার ভূমিকা রয়েছে। প্রথম পর্যায় থেকে চূড়ান্ত পর্যায় যদি ইতিহাসে তাকাই তবে দেখা যাবে, ভাসানী ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আগে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বলেছিলেন,  "কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি যেভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে, তাতে এমন দিন আসবে, যখন পূর্ব বাংলাবাসী পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম জানাবে।"

আর চূড়ান্ত পর্যায়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বলছেন,  "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।"

আমার এই লেখা কোনো গবেষণা নয়। ভাসানীর প্রতি আগ্রহ থেকেই কিছু পড়াশোনা করেছি। তার আগে বলে নেই ভাসানীকে নিয়ে হাতে গোনা কয়েকটি গ্রন্থ থাকলেও সেগুলো নির্মোহভাবে লেখা হয়েছে বলেই মনে হয়েছে। ভাসানীর উপর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। তার রচিত ভাসানীর জীবনীগ্রন্থ তো রয়েছেই এছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রয়েছে।

আমার লেখার সবচাইতে বড় উদ্দেশ্য হলো, গ্রন্থগুলো পড়ে ভাসানীর যে কোনো একটি বিষয় আলোচনার কেন্দ্রতে নিয়ে আসা। যাতে করে ভাসানীর প্রতি পাঠে কেউ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। একইসঙ্গে একটানে ভাসানীর জীবনের একটি পর্যায় সম্পর্কে পাঠককে জানানো। এজন্য তার আওয়ামী লীগ গঠন ও সেখান থেকে বের হয়ে আসার বিষয়টিকেই আমি বেছে নিয়েছি।

আওয়ামী লীগ গঠন

৪৭'র পর এই অঞ্চল যে আবার শোষণের কবলে পড়েছে এটা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার মধ্যে ভাষার ওপর আসলো প্রথম আঘাত। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। এদিকে ১৯৪৯ সালের মে মাসে পূর্ববঙ্গে খাদ্যের অভাব তীব্র হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে পানির অভাব, ম্যালেরিয়ার প্রকোপ, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির কারণে জনমত মুসলিম লীগের উপর থেকে সরে যেতে থাকে। এমনকি ১৮, ১৯, ২০ জুন তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগের দ্বিতীয় কাউন্সিলে সরকারের উদাসিনতা ও প্রথম সারির নেতাদের পূর্ব বঙ্গের সমস্যাগুলো উপেক্ষা করার বিষয়গুলো আলোচনায় আসে। পূর্ববঙ্গের প্রগতিশীল রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতে থাকেন মুসলিম লীগের নেতারা। তাদের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবেও উল্লেখ করা হয়।

এসবই প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বিদ্রোহী পক্ষ আরো ক্ষুব্ধ হয়ে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে আরেকটি সম্মেলন আয়োজন করে। প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকও সম্মেলনে কিছুক্ষণের জন্য ছিলেন। সংক্ষিপ্ত ভাষণও দেন। প্রশ্ন আসতে পারে, শেরে বাংলা পুরো সময়জুড়ে ছিলেন না কেন?

সাধারণ জ্ঞান থেকে বলা যায়, ওই সময় শেরে বাংলা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অ্যাডভোকেট জেনারেল। এই কারণেই তিনি বেশিক্ষণ অবস্থান করেননি। ওই সম্মেলনেই গঠিত হয় পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগ'। সেদিনটিই ছিল ২৩ জুন, ১৯৪৯।

শেখ মুজিব কোথায়?

অনেকেই ভাবতে পারেন, যখন বাংলাদেশের সবচাইতে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলটি গঠন হচ্ছে তখন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান কোথায়?

১৯৪৯ সালের ৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীদের ধর্মঘট পালন হয়। ছাত্র নেতৃবৃন্দ তার সমর্থনে সভা করে। ১১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর প্রতিবাদে ছাত্ররা প্রচণ্ড বিক্ষোভ শুরু করেন। ২৯ মার্চ বহু ছাত্রকে শাস্তি দেওয়া হয়। এর মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন। তিনি সহ আরো অনেকের ১৫ টাকা জরিমানাও হয়েছিল।

বিভিন্ন হল থেকে আবদুর রহমান চৌধুরী, মোল্লা জালালউদ্দিন ও আবদুস সামাদ সহ ১৪ জনকে বহিষ্কার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয় দবিরুল ইসলাম ও অলি আহাদসহ ৬ জনকে।

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠে। প্রতিবাদ হিসেবে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে ডাকা হয় ধর্মঘটও। ১৯৪৯ সালের ২০ এপ্রিল ডাকা হয় হরতাল। অবস্থান ধর্মঘটের সময় শেখ মুজিব গ্রেফতার হন এবং কোনো জরিমানা ও মুচলেকা দিতে রাজি না হওয়ায় তাকে ১৯৪৯ সালের ২৭ জুলাই পর্যন্ত জেলে থাকতে হয়।

জেলে থাকলেও আওয়ামী লীগের ৪০ সদস্যবিশিষ্ট ভাসানী ঘোষিত অর্গানাইজিং কমিটিতে তিনি যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।

সদ্য গঠিত আওয়ামী মুসলীম লীগের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয় ২৪ জুন। সভা শুরুর আগে মুসলীম লীগের সমর্থক সন্ত্রাসীরা মঞ্চ ভেঙে দেয়। থমথমে অবস্থার ভেতরও দলের তরুণ কর্মীদের ঐক্যবদ্ধতায় প্রায় পাঁচ হাজার লোকের উপস্থিতিতে জনসভা হয় এবং ভাসানী ভাষণও দেন।

তারপরই পূর্ব পাকিস্তানের চিফ মিনিস্টার নূরুল আমিন তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন,  "ওটা ছ'মাসের দল।"

জুলাই মাসে জেল থেকে বের হয়েই শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনিক ভিত্তি তৈরিতে ব্যাপকভাবে কাজ শুরু করে দেন। তার নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জ, পুরান ঢাকা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ি এবং ফরিদপুরে সংগঠন গড়ে তোলা হয়। সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আওয়ামী মুসলিম লীগের ১১টি জেলা, ১৮টি মহকুমা শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়।

আওয়ামী লীগ থেকে কেন বের হলেন ভাসানী?

১৯৫৭ সালের ২৪ জুন ভাসানীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের স্থায়ী বিচ্ছেদ ঘটে। এখন কেন ঘটে এটা বোঝার জন্য একটু পেছনে যেতে হবে।

পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে পূর্ববঙ্গের রাজনীতির বড় চরিত্র ছিলেন তিন জন। এরা হলেন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। রাজনৈতিক যে কোনো সিদ্ধান্ত এ অঞ্চলের জনগণ তাদের মতামতের ওপরই নির্ভর করতেন। কিন্তু তিনজনেরই মতপার্থক্য ছিল। এদের মধ্যে ভাসানী খুব সোজাসাপ্টা খোলামেলা কথা বলার কারণে বাকিরা বিশেষ করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী খুব অস্বস্তিতে পড়তেন। তবে এটা বলতেই হবে যে,  রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও মতপার্থক্য থাকলেও তিনজনে একে-অপরকে শ্রদ্ধা, সম্মানের দৃষ্টিতে দেখেছেন।

আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন হওয়ার পর থেকেই সকলে চেয়েছিলেন একে ফজলুল হক দলে যোগ দেবেন। কিন্তু তিনি রাজনীতি করার চাইতে পূর্ব বাংলা সরকারের অ্যাডভোকেট-জেনারেল পদে চাকরি করাকেই বেছে নিয়েছিলেন। তারপরও তিনি রাজনীতিতে ফিরলেন তবে নিজের গড়া কৃষক-শ্রমিক প্রজা পার্টি নিয়ে। আওয়ামী মুসলীম লীগের হয়ে নয়।

এর আগেই সমমনা ও সম আদর্শের রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠনের কথা আলোচনায় আসে। ১৯৫৩ সালের মে মাসে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলের বিশেষ অধিবেশনে যুক্তফ্রন্ট গঠনের পক্ষে মত দেয়া হয়। পরে অগাস্ট মাসে নূরুল আমিন ঘোষণা দেন, ১৯৫৪ সালে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফলে যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রক্রিয়ায় আরো গতি আসে।

১৯ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়। ১৯৫৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পাটি, কমিউনিস্ট পার্টি, খেলাফত রব্বানী পার্টি, গণতন্ত্র পার্টি, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম যুক্তফ্রন্ট গঠনে সিদ্ধান্তে উপনিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগ সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও কৃষক-শ্রমিক প্রজা পার্টির প্রধান একে ফজলুল হক যুক্তফ্রন্ট গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বিবৃতি দেন। এই ফ্রন্টের নির্বাচনি প্রচারণায় তিন নেতাই অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। যার ফল তারা নির্বাচনেই পেয়ে যান।

৫৪'র নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ২২৩ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। এই বিশাল বিজয়ে মুসলীম লীগের দুর্গ ধসে পড়ে। পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের রাজনীতি যে আর কার্যকর নয় সেটাও প্রমাণ হয়ে যায়।

বলা হয়, নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল ২১ দফা। যা ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। যুক্তফ্রন্টকে সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৯৫৪ সালের ২ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণা হওয়ার পর যুক্তফ্রন্ট পার্লামেন্টরি বোর্ড সভায় একে ফজলুল হককে দলের নেতা নির্বাচিত করে।

সবাইকে হতাশ করে মাত্র ৪ সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠন করেন তিনি। মুহূর্তে কালো মেঘে ছেয়ে যায় আওয়ামী মুসলিম লীগের তরুণ কর্মীদের মধ্যে। অন্যতম শরিক আওয়ামী মুসলিম লীগ মনে করতে থাকে তাদের অবহেলা করা হয়েছে। এই মতভেদ প্রকাশ্যে চলে আসতে শুরু করে। আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা আবুল মনসুর আহমেদ এ বিষয়ে মন্তব্য করে বলেন,  "মতান্তর পলিসি লইয়া হয় নাই, হইয়াছিল মন্ত্রিত্ব লইয়া…।"

এই ক্ষুব্ধতার ফলে সোহরাওয়ার্দীও বিরক্ত হয়ে চুপ থাকেন। আর ভাসানী নবীন-প্রবীণ নেতাদের পদ ও ক্ষমতার লিপ্সা দেখে ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়ে চলে গেলেন।

যদিও ১৯৫৪ সালের মে মাসে ফজলুল হক তার মন্ত্রিসভা বর্ধিত করেন। যুক্ত হন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি কৃষি ও বনমন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হন।

'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি' গ্রন্থে বলা হয়, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক মে মাসের প্রথম সপ্তাহে কলকাতা সফরকালে তার উচ্চারিত কিছু কথাবার্তা বিকৃতভাবে পাকিস্তানি মহলে প্রচার হওয়ার ফলে তিনি বেশ বিব্রত হন। ওই অবস্থায় বিপদের মুখে তিনি ১৫ মে মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত করেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, কী এমন আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন ফজলুল হক?

সৈয়দ আবুল মকসুদের 'মওলানা আবদুল হামিন খান ভাসানী' গ্রন্থে এ নিয়ে একটি মন্তব্য পাওয়া যায়।

ফজলুল হক ৩০ এপ্রিল ঢাকা-করাচির পথে কলকাতায় যাত্রা বিরতিকালে আবেগের বসে একটি মন্তব্য করেন। যার অর্থ- রাজনৈতিক কারণে দেশ ভাগ হলেও দুই বাংলার বাঙালি অভিন্ন।

এই একটি বাক্যকে হাতিয়ার বানিয়ে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় পাকিস্তানি মহল। তারা পত্র-পত্রিকায় ব্যাপকভাবে এই মতের বিরুদ্ধে নেমে পড়ে। ওই সময় সোহরাওয়ার্দী ছিলেন জুরিখ চিকিৎসার জন্য। আর ২৫ মে শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে ভাসানী রওনা দেন বার্লিনে। এখানেও হয় চক্রান্ত।

পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় ভাসানীকে জার্মানির ভিসা দিতে বিলম্ব করে। ফলে তিনি লন্ডন হয়ে বার্লিনে শান্তি সম্মেলনে সময় মতো যেতে পারেননি।

ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর অনুপস্থিতিতে পূর্ব বাংলার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়। ৩০ মে গভর্নর জেনারেল হক মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে। পূর্ব বাংলায় কেন্দ্রীয় সরকারের গভর্নরের শাসন প্রবর্তন করা হয়। একই সঙ্গে ফজলুল হককে গৃহবন্দি করা হয়। শেখ মুজিব সহ ৩০ জন পরিষদ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। শুরু হয় রাজনৈতিক নিপীড়ন।

এদিকে পূর্ববাংলার নব নিযুক্ত গভর্নর ইস্কান্দার মির্জার প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে বসেন,  "দেশে ফেরা মাত্র ভাসানীকে গুলি করে হত্যা করা হবে।"

লন্ডনে বসে ভাসানী এসব খবর পেতে থাকেন। তার শুভাকাঙ্ক্ষিরা সহসা দেশে ফেরতে মানা করেন। ১৯৫৪ সালের শেষের দিকেই জুরিখ থেকে সোহরাওয়ার্দী যান লন্ডনে। সেখানে ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর সোহরাওয়ার্দী ফিরে আসেন দেশে।

তখন পাকিস্তানে গোলাম মোহাম্মদ আর মোহাম্মদ আলীর ক্ষমতার লড়াই চলছে। সোহরাওয়ার্দী দেশে ফিরেই মোহাম্মদ আলীর মস্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রী হয়ে গেলেন।

এখান থেকেই শুরু হয় সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর মূল দ্বন্দ্ব। সোহরাওয়ার্দীর এই মন্ত্রিত্ব ও আপস শেখ মুজিবও পছন্দ করেননি। দুর্ভাগ্য হলো, তরুণ প্রতিভাবান রাজনীতিবিদ হিসেবে শেখ মুজিব ছিলেন তখন জেলে আর শক্তিশালী নেতা ভাসানী বিদেশে। দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না। তবুও সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবকে জেল থেকে বের করার ব্যবস্থা করেন। বের হয়েই শেখ মুজিব যান করাচিতে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করতে। সেখানেই তিনি তার অপছন্দের বিষয়টি জানান।

এ বিষয়টি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' গ্রন্থেও উল্লেখ রয়েছে।

"…আমাদের নেতারা কি পরামর্শ শহীদ সাহেবকে দিয়েছিলেন জানি না, তবে শহীদ সাহেব ভুল করলেন, লাহোর ও ঢাকায় না যেয়ে, দেশের অবস্থা না বুঝে মন্ত্রিত্বে যোগদান করে।…আমি কিছুতেই তাঁর আইনমন্ত্রী হওয়া সমর্থন করতে পারলাম না। এমনকি মনে মনে ক্ষেপে গিয়েছিলাম…।"

ভাসানীর নির্বাসন ও সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে

ভাসানী ব্রিটেন থেকে আসেন কলকাতায়। প্রায় পৌনে চার মাস তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসন বেছে নেন। যেহেতু পাকিস্তান সরকার তাকে গুলি করার হুমকি দিয়ে রেখেছে। কলকাতায় ভাসানীর অবস্থান নিয়ে পূর্ণ একটি গ্রন্থও রচিত হয়েছে।

সেখানে দেখা যায়, সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ভাসানীর দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে আসে। ভাসানী বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে ব্যাপকভাবে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আসছিলেন।

এক হলো, পাকিস্তানে ভাসানী সংখ্যা অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব দাবি করছিলেন। দ্বিতীয়ত, তিনি চাইছিলেন পররাষ্ট্র নীতি হবে বন্ধুত্বপূর্ণ তবে যুক্তরাষ্ট্র ঘেঁষা হবে না। অর্থাৎ কোনো সামরিক জোটে পাকিস্তান যেন যুক্ত না হয়। এসব বিষয় নিয়ে কলকাতা বিমান বন্দরে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ভাসানির তর্ক-বিতর্ক হয় সাংবাদিকদের সামনে। যা পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র করার সুযোগ তৈরি করে দেয়।

ভাসানী দেশে ফেরা ও সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রী হওয়া

দেশে ফেরার উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে ভাসানী ফিরে আসেন ২৫ এপ্রিল, ১৯৫৫। ঢাকায় ফিরেই তিনি সোহরাওয়ার্দীকে চাপ দিতে থাকেন যেন সকল বামপন্থি ও কমিউনিস্টকর্মী ও নেতাদের মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়। এমনকি সকল রাজনৈতিক কর্মীর হুলিয়া বাতিলেরও দাবি করেন তিনি।

১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ-রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। ১৯৫৬ সালে চৌধুরী মোহাম্মদ আলির পদত্যাগের পর সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। সোহরাওয়ার্দী ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর ১২ থেকে ১৯৫৭ সালের অক্টোবর ১১ তারিখ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই মওলানা ভাসানী সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বিরোধিতা করে নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করার জন্য সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করেন।

১৯৫৭ সালের ১৪ জুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পল্টন ময়দানে বক্তৃতায় সোহরাওয়ার্দী শাসনতন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানের ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন আদায় হয় বলে দাবি করেন। তাৎক্ষণিকভাবে তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন।

ভাসানী আক্ষরিক অর্থে সোহরাওয়ার্দীকে প্রায়ই অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিতেন। কখনও কখনও অপমানও করে বসতেন। যেমন, প্রধানমন্ত্রী হয়েই সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় আসেন এবং ওই দিনই পল্টন ময়দানে তিনি ভাষণ দেন। ওই সময় পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছিল। তাই ওই জনসভায় ভাসানী ব্যক্তি আক্রমণ করে বসেন।

তিনি বলেন, "যদি প্রধানমন্ত্রী খাদ্য সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হন তবে তাকে জনতার সামনেই বেত্রাঘাত করা হবে।"

পরে আবার বলেন,  "দুই সপ্তাহের মধ্যে যদি নয়টি জেলায় নয় হাজার মণ খাদ্য না পাঠাতে পারো তবে তোমার ওই প্রধানমন্ত্রীর গদিতে আমি পদাঘাত করি।"

কাগমারী সম্মেলন ও ভাসানীর আসসালামু আলাইকুম

সাম্রাজ্যবিরোধী আন্দোলনে জনমানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতেই ১৯৫৭ সালের ৯-১০ ফেব্রুয়ারিতে টাঙ্গাইল জেলার কাগমারীতে দুই দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এটাকেই বলা হয় কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন। একই সময়ে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনও হয় ৭-৮ ফেব্রুয়ারি।

কাগমারী সম্মেলনকে ভাসানী আন্তর্জাতিক রূপ দিতে চেয়েছিলেন। ভারত থেকে অনেকেই এই সম্মেলনে অংশ নেন। এমনকি ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই সম্মেলনে অংশ নেন। তাকে ভাসানী গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে বলেছিলেন, পূর্ব বাংলা একদিন স্বাধীন হবেই। ১২ বছরের মধ্যে পূর্ব বাংলা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবে।

রাজনীতিকে রাজধানীকেন্দ্রিক না করে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াও উদ্দেশ্য ছিল এই সম্মেলনের।

ভাসানী ৪৭'র আগে মুসলীম লীগকে সমর্থন করেছিলেন লাহোর প্রস্তাবে বিশ্বাস করে। কিন্তু ক্রমেই সেই বিশ্বাসে চীড় ধরে। আর তাই তিনি সেখান থেকে বের হয়ে আসেন। বের হয়ে তিনি লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থার দাবি করতে থাকেন। তিনি এই কাগমারী সম্মেলনে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবি করেন।

৭ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়। ভাসানী হলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি। আর আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা হোসেন সোহরাওয়ার্দী তখন প্রধানমন্ত্রী। তিনিও উপস্থিত। সেখানে ভাসানী তার বক্তব্য তুলে ধরেন। যার এক পর্যায়ে বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি যেভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে, তাতে এমন দিন আসবে, যখন পূর্ববাংলাবাসী পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম জানাবে।

তার এই বক্তব্যে সোহরাওয়ার্দী খুব বিব্রত হন। উত্তরে তিনি বলেন, "…Separatism কোনো সমাধান নয়। আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। পাকিস্তানের সংহতি সবকিছুর ঊর্ধ্বে।"

ভাসানীর উত্থাপিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রসঙ্গে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলেন,  "…আমার মনে হয় শতকরা ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন আমরা পাইয়াছি। কিন্তু এমন কতকগুলি ব্যাপার যেমন বৈদেশিক সাহায্য, কেন্দ্রীয় অর্থ বণ্টন বিষয়ে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রহিয়াছে…।"

ভাসানীর সাম্রাজ্য বিরোধী মনোভাব ছিল প্রকট। একইসঙ্গে তিনি বারবার দাবি তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে ভারতই হলো উত্তম বন্ধু। প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সঙ্গেই বন্ধুত্ব রাখার পক্ষে তিনি জোর দিয়েছিলেন। পাকিস্তান তার বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের প্রতি যেভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করতো তা ভাসানী মেনে নিতেন না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হলো, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ায়। আর আমেরিকা ছিল বিরুদ্ধে।

কাগমারী সম্মেলনের পর থেকে আওয়ামী লীগে দুই গ্রুপের সৃষ্টি হয়। একটি সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ আরেকটি ভাসানী গ্রুপ। ভাসানীর সঙ্গে বেশিরভাগই রয়েছে বামপন্থী ও কমিউনিস্টপন্থী কর্মীরা। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র ঘেঁষা। একই সঙ্গে তিনি কমিউনিস্টদের পছন্দ করতেন না।

১৮ মার্চ ১৯৫৭। আওয়ামী লীগের সংগঠনিক সম্পাদক অলি আহাদ সন্তোষ যান। সেখানে ভাসানী তাকে পদত্যাগের বিষয়ে জানান। এবং একটি চিঠি দিয়ে বলেন যেন সংবাদের সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরীর কাছে পৌঁছে দেন। চিঠিটি তিনি লিখেছিলেন সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান বরাবর।

জহুর হোসেন চৌধুরী চিঠিটি পাওয়া মাত্র শেখ মুজিবকে জানান। তারা শুরুতে মনে করেন, ভাসানী আবেগপ্রবণ হয়ে চিঠিটি লিখেছেন। তাই সিদ্ধান্ত নেন ভাসানীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে তাকে বোঝাবেন। তার এক সপ্তাহ পর ২৬ মার্চ ভাসানী একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেন। যার শিরোনাম ছিল 'আওয়ামী লীগের কর্মী ও দেশবাসীর প্রতি আবেদন'।

তখন আবার বোঝা যায় তিনি পদত্যাগ করেননি। এ সময় আওয়ামী লীগের ভেতরের অনেককেই শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়। বিশেষ করে ভাসানীর পদত্যাগের বিষয়টি নিয়ে দল প্রচণ্ড অস্থিতিশীল অবস্থায় ছিল। দল ভেঙে যাওয়ার এই সময়ে দলের মধ্যে উপদলীয় কোন্দল গভীর হলেও আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান ভাসানীকে পদত্যাগ না করার জন্য বারবার অনুরোধ করেন। কিন্তু ভাসানী তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।

এরই মধ্যে ১৩-১৪ জুন আওয়ামী লীগের নির্বাহী পরিষদের অধিবেশন বসে ঢাকার শাবিস্তান প্রেক্ষাগৃহে। ভাসানী এই সভায় যোগ দিতে চাননি। কিন্তু অনেকের অনুরোধে আসেন। কিন্তু সেখানে পরিস্থিতি ছিল খুব অস্বস্তিকর। প্রতিনিধিরা ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছিলেন ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দী সমর্থকে। অনেকে ভাসানীকে নিয়ে 'ভারতের দালাল মুর্দাবাদ' বলে অশালীন শ্লোগানও দিতে থাকে।

সেখান থেকে ভাসানী দ্রুত চলে আসেন। সেই অধিবেশনে সোহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্র নীতি সকলের সমর্থন পেয়ে যায়। যদিও ১৬ জুন ভাসানী ১৩-১৪ তারিখে কাউন্সিল অধিবেশনে অনুমোদন পাওয়া পররাষ্ট্র নীতির তীব্র সমালোচনা করে বিবৃতি দেন। এসব কিছুর মধ্যে আসলে আওয়ামী লীগে ভাসানীর থাকার মতো আর কোনো পরিস্থিতিই রইলো না। অবশেষে ২৪ জুলাই ভাসানী তার আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কে সমাপ্তি ঘটান।

আওয়ামী লীগও হারায় তাদের প্রথম সভাপতি, এক সাহসী, দেশপ্রেমী ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদকে।

সোহরাওয়ার্দী চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ঘেঁষা ছিলেন। তিনি মনে করতেন জিরো প্লাস জিরো= জিরো হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত ওয়ান না বসানো হয় ততক্ষণ এর কোনো মূল্য নেই। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে সেই ওয়ান মনে করেছিলেন। আপস করতে পারেননি বলেই দ্বন্দ্ব থেকে আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে আসেন ভাসানী।

আওয়ামী লীগের গঠন, কর্মী সমন্বয়, প্রগতিশীল করার জন্য মুসলীম শব্দ বাদ দেওয়া- সব কিছুর নেপথ্যে ছিলেন মওলানা ভাসানী। কিন্তু নীতি আদর্শে তিনি আপস না করায় বের হয়ে নতুন দল করেন।

অনেকেই মনে করেন ভাসানীর আওয়ামী লীগ থেকে বের হওয়া উচিত হয়নি। সেখানে থেকেই তিনি পররাষ্ট্র নীতির বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করে যেতে পারতেন। তরুণ নেতৃত্ব চায়নি ভাসানী চলে যাক। ভাসানী জেদি রাজনৈতিক চরিত্র ছিলেন। যার প্রমাণ স্বরুপ দেখা যায়, মত দ্বৈততার জন্য ৭০-এর নির্বাচনেও তিনি অংশ নেননি। যদিও শেখ মুজিবকে তিনি সমর্থন জানিয়েছিলেন। বলা হয়, ন্যাপের সকল ভোট পড়ে নৌকায়।

অদ্ভুত একটি বিষয় উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করতে চাই। মওলানা ভাসানী আনুমানিক ১৮৮৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। প্রায় ৬০ বছর তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। বেঁচেছেন প্রায় ৯১ বছর। এত লম্বা রাজনৈতিক ক্যারিয়ার হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ভাসানী পাঠ খুব কমই হয়। এমনকি তার তৈরি করা রাজনৈতিক দলটিও নেই কোনো আলোচনায়। এরও ইতিহাস আছে।

ভাসানী যতদিন বেঁচে ছিলেন তিনি পাশে কোনো সুযোগ্য সহযোদ্ধা পাননি যারা দলটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এমনকি তার মৃত্যুর পর জিয়াউর রহমানের বিএনপিতে একটা বড় অংশ গিয়ে ভীড়ে যায়। ভাসানীর সমতার ভিত্তিতে সমাজ গঠনের যে স্বপ্ন তা মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়।

তথ্যসূত্র:

১. মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সৈয়দ আবুল মকসুদ, আগামী প্রকাশনী
২. কাগমারী সম্মেলন, সৈয়দ আবুল মকসুদ, প্রথমা
৩. ভাসানীর ভারত প্রবাস: পাকিস্তানি শাসকচক্রের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, সৈয়দ আবুল মকসুদ, পাঠক সমাবেশ
৪. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি (প্রথম খণ্ড), বাংলা একাডেমি
৫. অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, ইউপিএল