মুক্তি সংগ্রামে তথ্য আন্দোলনের অপরিহার্যতা

প্রাচ্য পলাশ
Published : 11 March 2017, 08:30 AM
Updated : 11 March 2017, 08:30 AM

অস্থি-মজ্জা-রক্তে প্রবল মুক্তি যাতনার অপর নাম 'বাঙালি'। শ্বাশত ও চিরায়ত সংগ্রামের আরেক নাম 'বাঙালি'। কিংবা অপশক্তির কাছে মাতা নত না করা জাতির নাম 'বাঙালি'। হ্যাঁ, বাঙালি বৃটিশের অত্যাচার-নিপীড়ন-লুন্ঠনের কাছে মাথা নত করেনি। পাকিস্তানী তীব্র শোষণ-নির্যাতনের মুখেও ন্যূয়ে পড়েনি। তাইতো বাঙালি রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষা বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে বিশ্ববিবেককে তাক লাগিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বিশ্বমানচিত্রে এঁকে দিয়েছে নতুন একটি দেশ 'বাংলাদেশ'।

আর কিছুদিন পরেই আমরা ৪৭তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করবো। গোটা জাতি ব্যস্ত হয়ে পড়বে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে। শিশু থেকে পৌঢ় পর্যন্ত অনেকেই লাল-সবুজের আকর্ষনীয় পোষাক কেনা শুরু করেছেন। চলছে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে মাসব্যাপী নানান কর্মসূচি। নৃত্য, সঙ্গীত, আবৃত্তি, রচনা লিখন, গল্প লেখা, চিত্রাঙ্কণ, সুন্দর হাতের লেখা প্রভৃতি প্রতিযোগিতা। সভা-সমাবেশ, সেমিনার, গবেষণা, প্রকাশনা, পথ নাটক, মঞ্চ নাটক, আলোকচিত্র প্রদর্শনী, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও মুক্তিযুদ্ধের স্মারকবেদীতে শ্রদ্ধা নিবেদন, কুচকাওয়াজ, প্রীতি ফুটবল ও ক্রিকেট প্রতিযোগিতাসহ নানান ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, কনসার্ট, মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা এমনতর আরো কতো কর্মসূচি। কিন্তু মার্চ শেষ হলেই এতোদিন যে তরুণ হৃদয় মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমে উদ্বেলিত ছিল তা নিমিষেই হারিয়ে যায়। এটা বাঙালি তরুণদের বৈশিষ্ট্য নয়। আমাদের দৈনন্দিন সমাজে একটা অসুস্থ্য তাড়না প্রবাহমান, সেটা তারই বহিঃপ্রকাশ।

বাঙালি মুক্তির জন্য বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন করেছে, পাকিস্তানী শোষকদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে নিজেদের একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। আবার দেশ স্বাধীনের ১৯ বছরে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনও করতে হয়েছে। তবু বাঙালির মুক্তির আকাঙ্খা এখনো যেনো অস্পর্শী-বিমূর্ত। তাহলে এতো এতো আন্দোলন, রক্তপাত, তারপর বিজয় অর্জন কার জন্য। এ বিজয়ের মাজেজা কী? রক্তপাত ও জীবন দিয়ে বাঙালি কি তবে ভুল করেছে? তা না হলে কেন এমন মনে হয়- আন্দোলন করে বৃটিশ উৎখাত, মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নতুন দেশের জন্ম দেয়া, স্বৈরাচার উৎখাত করে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করা ইত্যাদি এর সবই যেন কোন ক্রীড়াবিদের অর্জিত ক্রেষ্ট। যদি না হয়, তবে হয়তো রবীন্দ্রনাথের নবেল পুরস্কার, ক্ষুদ্রঋণ প্রবক্তা ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. ইউনুসের শান্তি পুরস্কার, নয়তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা'র কোন বিদেশী ডিগ্রী লাভ। পুরস্কার অর্জনকারী তার বাড়ির ড্রয়িং রুমে অতি যত্নে তার ক্রেস্ট বা পুরস্কার সাজিয়ে রাখে, মাঝে মাঝে এগুলোর যত্ন নেই। পুরস্কার অর্জনের বর্ষপূর্তি উদযাপন করে। বিভিন্ন গণমাধ্যম এ নিয়ে সংবাদ পরিবেশনও করে থাকে। কী ভীষণ সাদৃশ্য রক্তে কেনা বাঙালির বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে বিজয়গাঁথার। অথচ এমন হবার কথা ছিলো না।

বাঙালি বারবার আন্দোলন করে, রক্ত দিয়ে যে বিজয় অর্জন করেছে সে বিজয়ের পথ ধরেই আন্দোলনের সাফল্য বারবার উড়ে গেছে। আন্দোলন করে বাঙালি শাসক পরিবর্তন করতে সফল হলেও শোষণ-নিপীড়ন বন্ধ করতে প্রতিবার শুধু ব্যর্থই হয়নি; বরং এ শোষণ-নিপীড়নে যুক্ত হয়েছে অভিনব কৌশল ও মাত্রা। ফলশ্রুতিতে শুধু গণতান্ত্রিক আন্দোলনই ব্যর্থ হয়নি, বরং বারবার ব্যর্থ ও বিপন্ন হয়েছে সদ্য অঙ্কুরিত গণতন্ত্র চর্চা। যেন গণতন্ত্র বিশ্বের জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা নয়, পরিণত হয়েছে বই-পুস্তকের বাণীতে।

বাঙালির এমন পরিণতির পেছনে মোটা দাগে দু'টি কারণ চিহ্নিত করা যায়। এক. গণতন্ত্রের শত্রুদের হাতে নেতৃত্ব অর্পন ও দুই. সংখ্যাগরিষ্ঠ তৃণমূল জনগণের কাছে পর্যাপ্ত তথ্যের ঘাটতি। এ দু'টি কারণের মধ্যে যে কোন একটিকে অতিক্রম করা গেলেই বাঙালি খুঁজে পাবে তার মুক্তির যাত্রাপথ। প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন আন্দোলন চলাকালে তাদের সততা নিয়ে কখনো বাঙালির প্রশ্ন  ছিলো না। কিন্তু আন্দোলনে বিজয় অর্জনের পরও জনগণ বারবার প্রতারিত হয়েছে, বেদনাদায়ক হলেও এটাই সত্য। অর্থাৎ আন্দোলনের সময় জনগণের বন্ধুরাই পরবর্তিতে গণশত্রু সূলভ শাসন জারি করে। তাই প্রথম কারণকে অতিক্রম করার সহজ কোন পথ আমাদের কাছে নেই। দ্বিতীয় পথটি হলো- সর্বস্তরের জনগণকে তথ্যসমৃদ্ধ করার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক শাসন কায়েমের পথে অগ্রসর হওয়া। কেননা- সমাজ, সংস্কৃতি, সভ্যতা ও গণতান্ত্রিক অগ্রগতি ও ধারাবাহিকতা রক্ষার মূল হাতিয়ার হলো তথ্য। তথ্যসমৃদ্ধ মানুষ কখনো সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন না। কারণ তথ্য মানুষকে সাহসী, উদ্যোমী ও আত্মবিশ্বাসী করার প্রধানতম উপাদান।

জনগণের কাছে তথ্য বিকিরণের বহু উপায় আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় প্রচলিত। এগুলোর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, বই-পুস্তক, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, চলচ্চিত্র, টিভি, বেতার, ডিভিডি ও ইন্টারনেট অন্যতম। হয়তো অনেকেই বলতে চাইবেন- এসব ক্ষেত্রে তো বাংলাদেশের অগ্রগতি ব্যাপক হয়েছে। বিশেষ করে- দেশের প্রতিটি গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়, প্রায় সব ইউনিয়নে উচ্চ বিদ্যালয়, প্রতি উপজেলায় একাধিক ডিগ্রী কলেজ, প্রতি জেলায় অনার্স-মাস্টার্স কলেজ, বহুজেলায় বিশ্ববিদ্যালয়সহ কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মেডিকেল কলেজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বই-পুস্তক অনেক সহজলভ্য। মানসম্মত বেশকিছু জাতীয় দৈনিক প্রকাশনার পাশাপাশি প্রতিটি জেলা থেকে একাধিক দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে, সাপ্তাহিক ও মাসিক ম্যাগাজিনও ব্যাপক প্রকাশিত হচ্ছে, বেসরকারি টিভি স্টেশনের বিস্তারতো বাংলাদেশে একরকম বিস্ময়কর, ডিভিডি ও এফএম রেডিও প্রসারিত হয়েছে, ইন্টারনেট প্রচলনেও বাংলাদেশ বিশ্বের বহুদেশের থেকে অগ্রসর, চলচ্চিত্র উন্নয়নের চেষ্টাও চলছে।  তাহলে জনগণের দোরগোড়ায় সরকার তথ্য পৌঁছে দিচ্ছেন- এমনতো বলা যেতেই পারে।

জনগণকে তথ্য দিতে বর্তমান সরকারের আরো কিছু উল্লেখযোগ্য দিক রয়েছে। তথ্য অফিসের উদ্যোগে বহু আগে থেকেই গ্রাম-গঞ্জের মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছে দিতে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনী করা হয়। এর পাশাপাশি সরকার গত ২০০৯ সালে তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন করেছে। এই আইনের বলে সর্বস্তরের জনগণ রাষ্ট্র ও সরকারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ও গোপনীয় তথ্য ছাড়া সব তথ্য সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে জানতে পারবেন। দেশের ৬৪ জেলার তথ্য বাতায়ন চালু করা হয়েছে। এছাড়া দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ই-তথ্য সেবা কেন্দ্র চালু করেছে। অর্থাৎ সরকার সর্বসাধারণকে তথ্য প্রদানে ভীষণ আন্তরিক। কিন্তু কোন কোন তথ্য পেলে জনগণ সমৃদ্ধ হবে তা জনগণের জানা থাকলে শত প্রতিকূলতা ডিঙিয়েও সেসব অমূল্য তথ্য তারা সংগ্রহ করে নিতো না কি? অর্থাৎ সরকার তথ্য প্রদানে যে অবকাঠামোগত বিস্তর উন্নয়ন ঘটিয়েছে সে প্রক্রিয়ায় রয়েছে বড় ধরনের শুভঙ্করের ফাঁকি।

তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি উদ্যোগে তথ্যসেবা পৌঁছে দিতে আমরা স্মরণ করতে পারি পরিবার-পরিকল্পনা ও কৃষি অফিসগুলোর কার্যক্রম ও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠীকে তথ্যসমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে অনুরূপ নেটওয়ার্কভিত্তিক কার্যক্রম সরকারি ভাবে বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। দেশবাসীকে তথ্যসমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তবে নেটওয়ার্কভিত্তিক এ কার্যক্রম দেশব্যাপী বাস্তবায়ন সরকারের কোন মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর করবে- সেটাও এক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি, তথ্য প্রদানে সরকারের দুই ধরণের শিক্ষামূলক কর্মসূচি চালু রয়েছে। কর্মসূচি দু'টো হলো- আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা। তবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে নেটওয়ার্কভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহনের কোন সুযোগ নেই। কিন্তুঅনানুষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে গ্রন্থাগারগুলোর মাধ্যমে সরকারের নেটওয়ার্কভিত্তিক কর্মসূচি শতভাগ সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম।

দেশে বর্তমানে চার ধরনের গ্রন্থাগার রয়েছে। এগুলো হলো- ক. জাতীয় গ্রন্থাগার, খ. গণগ্রন্থাগার, গ. শিক্ষায়তন গ্রন্থাগার ও ঘ. বিশেষ গ্রন্থাগার। জাতীয় গ্রন্থাগার প্রত্যেক দেশে একটিই থাকে। আমাদের জাতীয় গ্রন্থাগারটি আগারগাঁওয়ে অবস্থিত। গণগ্রন্থাগারের দেশব্যাপী শাখা থাকে ও এগুলো থেকে সর্বসাধারণ জ্ঞান আহরোণ করতে পারেন। গণগ্রন্থাগারের অধিদপ্তর শাহবাগে অবস্থিত। শিক্ষায়তান গ্রন্থাগার স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবস্থিত, এগুলোর ব্যবহার সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। আর বিশেষ গ্রন্থাগারগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানভিত্তিক হয়ে থাকে। যেমন: ব্যাংক, হাসপাতাল, মসজিদ, যাদুঘর, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ইত্যাদি। অর্থাৎ বিদ্যমান চার ধরণের গ্রন্থাগারের মধ্যে শুধুমাত্র গণগ্রন্থাগারের মাধ্যমেই দেশবাসীকে তথ্যসমৃদ্ধ করতে নেটওয়ার্কভিত্তিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

রাজধানী শাহবাগে অবস্থিত কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারে জ্ঞানচর্চার জন্য যাঁরা নিয়মিত বা মাঝে মধ্যে যান তাঁরা সকলেই জানেন- পাঠকক্ষে আসন পেতে গ্রন্থাগার খোলার অন্তত এক ঘন্টা আগে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হয়। যাঁরা পরে যাবেন তাঁদের সারাদিন বসার জন্য কোন আসন পাবার নিশ্চয়তা প্রায় নাই বললেই চলে। জ্ঞানচর্চায় এমন জনআগ্রহ ও স্বতঃস্ফুর্তার চিত্র একই সাথে গর্ব ও স্বস্থির। তবে দেশের শাখা গণগ্রন্থাগারগুলোর চিত্র এমনতর নয়। আর এই পরিস্থিতি নেটওয়ার্কভিত্তিক তথ্য আন্দোলন কর্মসূচির চাহিদাকে আরো জোরদার করে। নেটওয়ার্কভিত্তিক তথ্যসেবা কর্মসূচি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে যাবার আগে জেনে নেয়া দরকার সরকারি গণগ্রন্থাগারের শাখাভিত্তিক কার্যক্রম চিত্র।

দেশের ৬৪ জেলায় গণগ্রন্থাগারের একটি করে শাখা চালু রয়েছে। আশি ও নব্বই দশকে চালু হওয়া এ জেলা শাখাগুলোর ২১টিতে অতিসম্প্রতি পিএসসি'র মাধ্যমে গ্রন্থাগারিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ ও বকশিগঞ্জ উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে উপজেলা পর্যায়ে শাখা চালু করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকার আরমানীটোলা, মোহাম্মদপুর, রাজশাহীর সোনাদীঘির মোড় ও ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণগ্রন্থাগারের একটি করে শাখা চালু রয়েছে। দেশের সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারে বর্তমানে ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত ইংরেজি ভাষায় সর্বশেষ মুদ্রিত বিশ্বকোষ এনসাক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ০১-২৯ খণ্ড, ২০০৩ সালে প্রকাশিত বাংলাকোষ বাংলাপিডিয়া ইংরেজি ১০ খণ্ড ও বাংলা ১০ খণ্ড, হাক্কানী পাবলিসার্স প্রকাশিত ১৫ খণ্ডের বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, নয়াদিল্লীর আনমল পাবলিকেশন কর্তৃক ২০০৩ সালে ইংরেজিতে প্রকাশিত এনসাক্লোপিডিয়া অব সুফীজম, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন প্রকাশিত ইসলামী বিশ্বকোষ, ১৪০১ বঙ্গাব্দ শান্তিনিকেতন থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলী বিশ্বভারতী, বেঙ্গল ফাউণ্ডেশন প্রকাশিত চিত্রমূলক বিশ্বকোষসহ বাংলা-ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার প্রায় ৩০ হাজার পুস্তক রয়েছে। প্রতিদিন নিয়মিতভাবে পাঠকক্ষে ৮টি জাতীয় দৈনিক, একটি আঞ্চলিক দৈনিক, একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিক ও ৬টি সাময়িকী রাখা হয়। বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রাপ্ত আরো ১০টি পত্র-পত্রিকা, সাময়িকীও পাঠকক্ষে পাঠকদের জন্য রাখা হয়। এই গণগ্রন্থাগারে ১৯৯৩ সালের আগষ্ট থেকে একটি জাতীয় দৈনিক ও একটি জাতীয় মানের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন সর্বসাধারণের জন্য নিয়মিতভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সম্প্রতি এ গ্রন্থাগারটিতে সার্বক্ষনিক ওয়াইফাই সুবিধা ও অফিসচলাকালীন সর্বসাধারণের ইন্টারনেট ব্রাউজ করার জন্য একটি পিসি চালু করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন জাতীয় দিবসে প্রতিযোগিতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি আয়োজন করা হয়ে থাকে। দেশের অপরাপর জেলা গণগ্রন্থাগারগুলোর চিত্র প্রায় অনুরূপ। জেলা পর্যায়ের গণগ্রন্থাগার সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে এ বিষয়ে প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ ও তা জেলা তথ্য অফিসের নিয়মিত প্রদর্শনীতে অন্তর্ভূক্ত করা এখন সময়ের দাবি।

দেশবাসীকে তথ্যসমৃদ্ধ করতে 'একটি গ্রাম একটি গণগ্রন্থাগার' কর্মসূচি সরকারি উদ্যোগে গ্রহন করতে হবে। তৃণমূল পর্যায়ের এ গ্রন্থাগারগুলো বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকা নিয়ে পাঠকের অপেক্ষায় বসে থাকবে এমন নয়। গ্রন্থাগারগুলো একদিকে তথ্যকেন্দ্র হিসাবে কাজ করবে, অন্যদিকে তথ্যকর্মীর মাধ্যমে মানুষের দোরগোড়ায় জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি, মানবীয় বিকাশ ও সমৃদ্ধি, জনগুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি পৌঁছে দিবে। গণগ্রন্থাগ্রারগুলো সর্বসাধারণের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ নিশ্চিত করবে। যেমন: জেলা পর্যায়ের গণগ্রন্থাগারগুলোতে জেলার সকল অফিসের সেবাপ্রাপ্তি সংক্রান্ত তথ্যসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সার্বক্ষণিক প্রদানে সচেষ্ট থাকবে। অনুরূপভাবে উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ের গণগ্রন্থাগারগুলোর তথ্যসেবা কার্যক্রম চালু থাকবে। জেলা পর্যায়ের গণগ্রন্থাগারগুলো এমন তথ্যব্যাংক ছয় মাসের মধ্যেই প্রস্তুত করতে সক্ষম। অর্থাৎ জনবান্ধন তথ্যের প্রচারণায় মূলমাধ্যম হিসাবে গণগ্রন্থাগারকে গড়ে তুলতে হবে। এগুলোর পাশাপাশি স্থানীয় ইতিহাস চর্চা, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, শিক্ষা ইত্যাদি গবেষণা, নিয়মিত পাঠচক্র আয়োজন, স্থিরচিত্র ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী প্রভৃতি সারাবছর বাস্তবায়ন করতে হবে।

নেটওয়ার্কভিত্তিক তথ্যসেবামূলক 'একটি গ্রাম একটি গণগ্রন্থাগার' কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার মধ্য দিয়ে সর্বসাধারণকে দুর্নীতি, প্রতারণা ও হয়রানীমুক্তভাবে সেবাপ্রদান নিশ্চিত করে ব্যক্তি ও সমষ্টিগত পর্যায়ের প্রায় সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, অন্ধকার দূরে করে সমাজকে আলোকিত করতে, কুসংস্কার ও কুপমু-কতা দমন করে বিজ্ঞানভিত্তিক চেতনার সমাজ বিকাশ, তৃণপর্যায়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা ও বিকাশ, সর্বোপরি বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রোধ করে মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শভিত্তিক সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা গড়ে তুলতে এমন কর্মসূচি নিবিড়ভাবে সহায়ক। প্রস্তাবিত এ কর্মসূচি সম্পূর্ণরূপে সরকার প্রণীত 'জাতীয় গ্রন্থাগার নীতি' সম্মত ও দেশে প্রচলিত অন্য কোন আইনের সাথে সাংঘর্ষিকও নয়। সর্বোপরি এমন কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকারের সাংবিধানিক বাধ্যবাদকতাও রয়েছে।

সহস্রাধিক বছরের লালিত বাঙালির মুক্তি আকাঙ্খা পূরণে অপরিহার্য যুগোপযোগী তথ্য আন্দোলন। তথ্য আন্দোলনের পথ ধরেই বাঙালি অচিরেই অর্জন করতে সক্ষম হবে অমর একুশে, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তি সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের লক্ষ্য ও সাফল্যমণ্ডিত সমাপ্তি। বারবার বিজয়ী বাঙালি জাতি পিছপা হবে না প্রাণের এ মুক্তির আন্দোলনে। অহিংস এ আন্দোলনে শামিল হতে রাষ্ট্রের সকলেই প্রবলভাবে দায়বদ্ধ। (০৩/০৩/২০১৭)

প্রাচ্য পলাশ : চলচ্চিত্র নির্মাতা

ই-মেইল: prakritatv@gmail.com

ইউটিউব: PRAKRITA TV