অচলায়তনবন্দী বাংলা চলচ্চিত্রের উন্নয়ন যাত্রা

প্রাচ্য পলাশ
Published : 2 April 2017, 04:02 AM
Updated : 2 April 2017, 04:02 AM

বিশ্ব পরিমণ্ডলে বাঙালি ও বাংলাদেশের জাতিগত ও রাষ্ট্রীয় 'আইডেনটিটি' বা পরিচয়ে যুগ-যুগান্তরের শক্তিশালী সংবেদনশীল বাহন হতে পারে বাংলা চলচ্চিত্র। গবেষণামূলক গ্রন্থ, বর্ণনাপ্রধান ওয়েবসাইট, লোকসঙ্গীত ও নাটকের দল/গোষ্ঠী, বাংলা সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য ও চিত্রকলা প্রভৃতি বাঙালির পরিচয়ের বাহন হিসাবে ভীষণ গণ্ডিবদ্ধ। চলচ্চিত্রের ভাষা বিশ্বব্যাপী যতোটা মূর্ত ও সার্বজনীন তা আর অন্য কোন শিল্প বা গণমাধ্যমের নেই। আর তাই সমকালীনতো বটেই, অনাগত ভবিষ্যতেরও সর্বাপেক্ষা সংবেদনশীল শিল্পমাধ্যম চলচ্চিত্র আমাদের জাতিগত পরিচয়বাহক মাধ্যম হিসাবে অগ্রাধিকারযোগ্য।

চলচ্চিত্র অন্য কোন কলার ঋণদাসী নয়। চলচ্চিত্র হলো চিত্রদ্যুতির স্বকীয় শিল্প, যেখানে সাহিত্য সঙ্গীত নৃত্য নাটকীয়তা চিত্রকলা স্থান পায় অঙ্গীভূত অলঙ্কার হিসাবে। আর তাই, ইতোমধ্যেই বিশ্বের কোন কোন দেশ সার্বজনীন এ শিল্পমাধ্যমকে আরো বেশি কার্যকর করতে মোবাইল চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রতিযোগিতা ও ইন্টারনেট ভিত্তিক ওয়েবমুভি চালু করেছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও বিশ্বায়নের পটভূমিতে বাংলা চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি যৎসামান্য থাকলেও প্রকৃতপক্ষে বায়োস্কোপের কবল থেকে বাংলা চলচ্চিত্র আমাদের জীবন ঘনিষ্ট হয়ে ওঠতে পারেনি। ব্যবসায় ও তথাকথিক বিনোদনের দোহায় দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রে আমাদের নিজস্ব জীবন-সমাজ, দেশ ও মাটিকে অস্বীকার করা হয়েছে। নিজস্ব দেশ ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, আনুগত্য ও মূল্যবোধহীন চলচ্চিত্রগুলো দেশের সিনেমা হল বা প্রেক্ষাগৃহগুলো বাঁচিয়ে রাখতে এক দশকের অধিক সময় ধরে ব্যর্থ হয়ে আসছে।

বাংলা চলচ্চিত্রে স্রষ্টার সৃষ্টি বা নির্মাতার কোন সৃজনশীল নির্মাণ দেখা যায় না। চলচ্চিত্রের সৃজনশীলতা নিয়ে প্রশ্ন এলেই প্রযোজক-নির্মাতারা দর্শক চাহিদার দোহায় দেন; রাজনীতিবিদরা যেমন কথায় কথায় 'জনগণ মানে না', 'জনগণ চায় না', 'জনগণ বরদাস্ত করবে না' ইত্যাদি ইত্যাদি বলেন। এভাবে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় লিপ্ত থাকার আবর্তে আমাদের চলচ্চিত্র আর চলচ্চিত্র হয়ে ওঠতে পারেনি। মূলধারার চলচ্চিত্র হিসাবে পরিচিত আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রে গল্প বা কাহিনী বলা হয়, যা ক্যামেরায় ধারণকৃত একধরণের নাটক মাত্র। মঞ্চনাটক ও বায়োস্কোপের চিন্তা-ভাবনা, ধ্যান-ধারণা কাটিয়ে ওঠার প্রশ্নে এক ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল ও সুবিধাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বিরাজ করছে চলচ্চিত্রের শিক্ষাদীক্ষাহীন, মেধাহীন, পুঁজিহীন ঠিকাদাররূপী প্রযোজক-পরিবেশক, নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীদের মাঝে।

বাংলা চলচ্চিত্র নিজস্ব মহিমামণ্ডিত করতে যে পরিবর্তন দরকার তার কোন সরকারি-বেসরকারি চলচ্চিত্রবান্ধব উদ্যোগও বর্তমানে নেই। অবশ্য মাঝে-মধ্যে সরকারের মন্ত্রী-আমলাদের এ বিষয়ে দরদী বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে দেখা যায়। লোকসানের ঝুকি নেয়া প্রযোজক-গুণী নির্মাতা-বরেণ্য শিল্পীদের দর্শক সারিতে নিরবশ্রোতা রূপে বসিয়ে রেখে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীকে পাশে নিয়ে মঞ্চে বসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া চলচ্চিত্রবান্ধব বক্তৃতার মাঝে ভণ্ডামী ছাড়া অন্য কিছু দেখি না। এভাবে শিল্পের স্র্রষ্ঠা নির্মাতাদের সম্মান দেখানোর পরিবর্তে অপমান করা ও সরকারি কর্মচারীদের প্রশ্রয় দিয়ে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের খবরদারী ও অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার পরিবেশ সৃষ্টি করা একধরনের নিয়মে পরিণত হয়েছে। সংকট নিরসনের পরিবর্তে সংকট আরো ঘণিভূত করার ইঙ্গিতবাহী বিদ্যমান অবস্থার পরিবর্তন দরকার এখুনি। বাংলা চলচ্চিত্র উন্নয়ন পরিপন্থী অচলায়তন ভাঙতে সবকিছুর আগে সমস্যা ও সংকটগুলোকে চিহ্নিত করা অত্যন্ত জরুরি। বাংলা চলচ্চিত্র সংস্কৃতি উন্নয়ন ও লালন-পালনের সব পর্যায়ে সরকারি উদাসীনতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও রুচিবোধের অভাব, নির্মাতা-কলাকুশলীদের সৃজনশীল মেধা, শিক্ষা, দায়বদ্ধতা, সততা, আর্থ-সামাজিক জ্ঞান ও রুচির অভাব, প্রযোজক-পরিচালক-প্রদর্শকদের অতিরিক্ত লাভ-লোভী দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজ সচেতনতামূলক সুস্থ ও নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্রের প্রতি সাধারণ দর্শকদের অনীহা, সর্বোপরি জাতীয় ঐক্যমত্যের অভাব ইত্যাদি অন্যতম। বহুবিদ সমস্যায় জর্জরিত এ অচলায়তন অতিক্রম করে বাংলা চলচ্চিত্রের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় সূচনা করতে তিন ধরণের উদ্যোগ নেয়া অত্যন্ত জরুরি। এক. চলচ্চিত্রবান্ধব সরকারি কর্মসূচি, দুই. নির্মাণ সংশ্লিষ্টদের বাস্তবধর্মী প্রশিক্ষণ প্রদান ও তিন. নির্মাণ-প্রদর্শন পদ্ধতির সংস্কার ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে বিনিয়োগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

এক. চলচ্চিত্রবান্ধব সরকারি কর্মসূচি: বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস ৫০ বছরের প্রাচীন হলেও মঞ্চ নাটক ও বায়োস্কোপের ধ্যান-ধারণা অতিক্রম করতে ব্যর্থ হওয়ার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো চলচ্চিত্রবান্ধব সরকারের আনুকূল্যের অভাব। বিভিন্ন আমলের সরকারের চলচ্চিত্র বিষয়ক কর্মকা-গুলো পর্যালোচনা করলে এ চিত্রই প্রতীয়মান হয়। সরকারগুলো কখনো দর্শকের মতো, আবার কখনো কর্তার মতো আচরণ করেছে। চলচ্চিত্র উন্নয়নে সরকারগুলোর এমন ভূমিকাকে কখনোই চলচ্চিত্রবান্ধব বলা যায় না। 'আপনারা যা ভাল মনে করেন তা করেন', 'সরকারের কী করণীয় আছে তা বিশদভাবে জানান', 'চলচ্চিত্রের উন্নয়নে আপনাদের ভূমিকায় মূখ্য' ইত্যাদি চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশ্যে বিবৃত করা বাংলা চলচ্চিত্র উন্নয়নে সরকারে উদাসীনতার পরিচায়ক। সরকারের এ উদাসীনতাকে পূঁজি করে সরকারি কর্মচারীরা দেশের চলচ্চিত্রাঙ্গণে নোংরামীতে ছেয়ে দেয়ায় অভিযোগ শোনা যায়। এসবের বিরুদ্ধে কখনো কোন দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহন তো দূরের কথা, বরং এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। অভিযোগগুলো বিবেচনায় না নেয়ার পরিণতি চলচ্চিত্রের জন্য কখনো শুভ হয়নি। এর পরিবর্তনে কর্মচারীদের সরকারি দায়িত্ব পালন করার পদ্ধতিগত সংস্কার দরকার। তারা যেন কখনোই চলচ্চিত্রাঙ্গণের নিয়ন্ত্রক-কর্তা ভাবার সুযোগ না পায়। চলচ্চিত্রের উন্নয়নে দু'লাইন পরামর্শমূলক সুপারিশ করার যোগ্যতা না থাকাদের খেদমত কেনো প্রযোজক-নির্মাতা-শিল্পীরা করবেন?

চলচ্চিত্র বিষয়ক যে কোন অনুষ্ঠানে সরকারি কর্মচারীদের মঞ্চে বসানোর অগ্রহনযোগ্য রেওয়াজ বন্ধ করতে হবে। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের হয়রানী-অবহেলা-অসম্মান প্রদর্শন বন্ধ করতে হবে ও সামাজিক মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মঞ্চ নাটক ও বায়োস্কোপের পরিচয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সরকারি অনুদানে চলচ্চিত্র নির্মাণের নিয়ম-নীতির সংস্কার করতে হবে। নতুন প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি প্রদর্শনী চালুু রাখারযোগ্য প্রেক্ষাগৃহ বন্ধে সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। সামঞ্জস্যপূর্ণ সুযোগ-সুবিধার নতুন প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ ৭০ভাগ সম্পন্ন করা সাপেক্ষে পুরনো একটি প্রেক্ষাগৃহ ভাঙার অনুমতির সুযোগ রাখা যেতে পারে। ঠিকারদাররূপ শিল্পী-কলাকুশলী-প্রযোজক-নির্মাতা ও শিল্পীর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-ব্যাসার্ধ নিয়ে কল্পনার জগতে বিচরণকারী সরকারি কর্মচারীর মুখোপেক্ষিতা বর্জন করতে হবে। দেশব্যাপী নিয়মিতভাবে দর্শক জরিপ (এখন তিন মাস পরপর, কাঙ্খিত উন্নয়ন অর্জনের পর বছরে একবার) পরিচালনা করতে হবে ও বক্স অফিস চালু করতে হবে। দর্শক জরিপ ও বক্স অফিসের ফলাফলের আলোকে বাংলা চলচ্চিত্র উন্নয়নের করণীয়গুলো জোরদার করতে হবে। চলচ্চিত্র বিষয়ক গবেষণা, লেখালেখি, সাংবাদিকতা ও চর্চাকে উৎসাহ প্রদান জোরদার করতে হবে। বাংলা চলচ্চিত্র বাংলাদেশের সম্পদ ও বাঙালির জাতীয় জাগরণ ও সমৃদ্ধির প্রতীক বিষয়ক ডকুমেন্টারী নির্মাণ ও তা তথ্য অফিসের মাধ্যমে দেশব্যাপী প্রচারণার মাধ্যমে চলচ্চিত্র বিষয়ক জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

দুই.

নির্মাণ সংশ্লিষ্টদের বাস্তবধর্মী প্রশিক্ষণ প্রদান: সম্প্রতি কোলকাতা থেকে শ্যূটিং করে আসা ঢাকাই ছবির এক নায়কের বক্তব্যে জানা গেলো যে, তিনি নাকি সেখানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন এবং তাঁর প্রচেষ্টায় (অভিনয় দক্ষতায়) বাংলাদেশের ভাবমূর্তি না কি উজ্জ্বল (!) হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করতে পারছেন না। এজন্যই তিনি যৌথ-প্রযোজনার ছবিতে অভিনয় করা শুরু করেছেন। যে টালিগঞ্জ পনের বছর আগেও ঢালিউডের ছবি অনুকরণ করতো সেখানে ঢাকাই ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রির সেই নায়ক (ইণ্ডাষ্ট্রিতে বর্তমানে কোন যোগ্য নায়ক নেই) বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে গিয়েছিলেন। এর কারণ দু'টো হতে পারে। এক. বাংলা চলচ্চিত্রের উন্নয়ন অসম্ভব, দুই. বাংলা চলচ্চিত্রের উন্নয়ন তিনি চান না। সেই নায়ক কোন কারণের মধ্যে পড়েন তা চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সকলেরই জানা। ঠিকাদারীরূপী সেই নায়ক বাংলা চলচ্চিত্রের উন্নয়নে ভূমিকা রাখাতো দূরের কথা কাস্টিং-শ্যূটিংয়ে প্রযোজক-নির্মাতাদের অসহযোগিতা করা, ডিজিটাল চলচ্চিত্র যাত্রাকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে ভূমিকা না রেখে বাধা প্রদান করা ইত্যাদির সাথে জড়িত থেকেছেন। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্র ও সরকার কিভাবে চলবে তাও নির্ধারণ করে দেবেন- চলচ্চিত্রাঙ্গণে এমন নির্বোধের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। এমন পরিস্থিতি বিরাজ করার অন্যতম কারণ হলো- সর্বস্তরে চলচ্চিত্র বিষয়ক সচেতনতার অভাব প্রকট। চলচ্চিত্র শিল্প হলো সর্বাধিক সংবেদনশীল গণমাধ্যম। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে যোগাযোগকারী হচ্ছেন- প্রযোজক ও নির্মাতা, আর গ্রহনকারী হচ্ছেন সর্বস্তরের দর্শক। অন্যান্য সবকিছু যেমন: প্রেক্ষাগৃহ-শিল্পী-কলাকুশলী-আলো-ফিল্ম-শব্দ-প্রজেক্টর ইত্যাদি হলো মাধ্যমমাত্র। সরকারি বেসরকারি অপ্রতুল নিয়ম-নীতি, সুন্দরের চর্চার অভাব, সর্বোপরি ঠিকাদারী মানসিকতা লালন অব্যাহত থাকায় মাধ্যমগুলো অনেকবেশি প্রভাবশালী রূপ লাভ করে প্রযোজক-নির্মাতাদের হয়রানী পর্যন্ত করে। সরকার থেকে শুরু করে সাধারণ দর্শক পর্যন্ত সর্বস্তরে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার। যেকোন শিল্পী বা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানকে ঊর্দ্ধে তুলে ধরার ইমোশনাল অপচেষ্টা বন্ধ করতে হবে। মনে রাখা দরকার, এমন আবেগী অপচেষ্টা সবসময় বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষতি করেছে। আর চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের জন্য দরকার ব্যাপক ও ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের।

সরকারি উদ্যোগে নিয়মিত ও ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে। এ প্রশিক্ষণে চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রগ্রাহক, চিত্রনাট্যকার, অন্যান্য পরিচালক (সঙ্গীত, নৃত্য, ফাইট), এডিটর ও এ্যানিমেটরদের অর্ন্তভূক্ত করতে হবে। প্রত্যেক সেক্টর থেকে আগ্রহী ও সম্ভাবনামীয় অন্তত পাঁচ জনকে (পরবর্তিতে এ সংখ্যা প্রয়োজন অনুসারে বৃদ্ধি করা যেতে পারে) প্রশিক্ষিত করতে হবে। প্রশিক্ষণ পদ্ধতি হবে তিন স্তরের। প্রথম স্তরে বাংলাদেশের কৃষ্টি-কালচার, লোকসমাজ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, রাজনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে ব্যাপক তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ কিভাবে কথা বলে, কিভাবে হাঁসে-কাঁদে, কিভাবে উল্লাস প্রকাশ করে, কী পরিধান করে, কী খায়, কিভাবে প্রেম করে, কিভাবে তার হিংস্র্রতা প্রকাশ করে ইত্যাদি সম্পর্কে ব্যবহারিক দীক্ষা প্রদান করা। এ দীক্ষার মাত্রা এমনতর হবে যেনো প্রশিক্ষণগ্রহনকারী হলিউড-বলিউড বা অন্য কোন দেশের চলচ্চিত্রের দৃশ্য ভুলে নিজেদের কৃষ্টি-কালচার সংস্কৃতিসমৃদ্ধ দৃশ্য নিয়ে মশগুল হয়ে যান। দ্বিতীয় স্তরের প্রশিক্ষণে প্রত্যেকের স্ব স্ব ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি ও উন্নয়ন করার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক স্টাণ্ডার্ড অনুসারে চলচ্চিত্রের নির্মাণমান নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয় স্তরে প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু, মাত্রা ও গতিবিধি প্রভৃতি নিরূপিত হবে দর্শক জরিপ ও বক্স অফিসের ফলাফলের আলোকে। তবে স্মরণ রাখতে হবে- দর্শক জরিপ ও বক্স অফিসের ফলাফল দিয়ে কখনো বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয়বাহী উপাদানের পরিবর্তন বা বিকৃতি করা যাবে না। সরকারি উদ্যোগে ধারাবাহিকভাবে এমন প্রশিক্ষণ চলমান রাখতে আন্তর্জাতিক মানের ফিল্ম ইন্সটিটিউট নির্মাণও গুরুত্বের দাবি রাখে।

তিন.

নির্মাণ-প্রদর্শন পদ্ধতির সংস্কার ও আধুনিকায়ন: নতুন প্রযোজকদের উৎসাহ ও উদ্বুদ্ধ করতে বিস্তর উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে। চলচ্চিত্রকে কালো টাকা সাদা করার ক্ষেত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার পরিবর্তে শিল্পমনাদের ব্যবসায়িক বিনিয়োগের উর্বর খাত হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। চলচ্চিত্র প্রযোজনা বিষয়ে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণগ্রহনকারীকে অন্যান্য শর্তাবলী পূরণ সাপেক্ষে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির সদস্য হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করার নিয়ম চালু ও কার্যকর করতে হবে। নির্মাতা-শিল্পী-কলাকুশলীদের সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্মানী নির্ধারণ পদ্ধতির প্রবর্তণ করতে হবে। দুর্বৃত্তদের দমন করে পরিবেশন পদ্ধতির আধুনিকায়ন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড (সেন্সর বোর্ড) এর আধুনিকায়ন করতে হবে। হলিউড-বলিউড এর অনুকরণশীল চলচ্চিত্রকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। শুধু কাটপিস বন্ধ নয়, বাংলা চলচ্চিত্রের নিজস্ব পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে সর্বাধিক সক্রিয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে এ বোর্ডকে। পাইরেসী বন্ধে আইনগত সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে সবধরনের ব্যবস্থা গ্রহনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

বাংলা চলচ্চিত্রের উন্নয়নে তিন ধরণের এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে প্রত্যেককে যার যার অবস্থান থেকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। এ বিষয়ে কোন আইনগত সীমাবদ্ধতা থাকলে তার সংস্কার অথবা প্রয়োজন সাপেক্ষে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। চলচ্চিত্রের উন্নয়ন প্রশ্নে সরকার নিবেদিত তা বক্তৃতা-প্রেস ব্রিফিংয়ে নয়, বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহন ও তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বাস্তবায়ন করে দেখাতে হবে।

বাঙালি মানবজীবনের প্রতিচ্ছবিগুলো ইমেজ-এর জীবন্ত বুননে নির্মিত জীবন ঘনিষ্ট বাংলা চলচ্চিত্র বিরাজমান স্থবিরতা ও অসৃজনশীলতা পরাভূত করে আমাদের সৃজনশীল সমাজ, সংস্কৃতি ও বাঙালি জীবন রূপালী পর্দা দখল করবেই। বাংলা চলচ্চিত্রের উন্নয়নযাত্রা আবর্তে বাসাবাঁধা অচলায়তন ভাঙে প্রজ্ঞাবান নির্মাতা, নির্মাণ কলাকুশলীদের অবাদ চারণক্ষেত্র হিসাবে চলচ্চিত্রাঙ্গণকে ঢেলে সাজানো ও গড়ে তোলা জাতীয় স্বার্থে অত্যন্ত জরুরি।

সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ ও সাম্র্রাজ্যবাদী চিন্তাধারার প্রভাবে ক্ষয়িষ্ণু বাংলা চলচ্চিত্র রক্ষায় বিবেকবান রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, নির্মাতা, প্রযোজক, শিল্পী-কলাকুশলী, চলচ্চিত্র দর্শক সর্বোপরি দেশবাসীকে প্রতিবাদী ও প্রতিরোধের দীপ্যমান প্রজ্ঞার আলোকবর্তিকা হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। কেননা, চিরায়ত বাঙালি সমাজ তথা বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে প্রতিভাত করতে সার্বজনীন শিল্পমাধ্যম চলচ্চিত্রের বিকল্প নেই। লালন-নজরুল-জীবনানন্দ-মধুসুদন-সুকান্ত-সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত-বেগম রোকেয়া-সুফিয়া কামাল-জয়নুল আবেদীন-জাহানারা ইমাম-শামসুর রাহমান-এস.এম সুলতান-কুতুবুল আলম-শাহ আব্দুল করিম-নূর হোসেন-ববিতা-নিশাত চৌধুরী-সাকিব আল হাসান আর পদ্ম-যমুনা-মেঘনা-সুরমা-গৌমতি-মহানন্দা বিধৌত ভাষা শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তপাতে রঞ্জিত এ দেশ বাংলাদেশ। লুটেরা, ঋণখেলাপীর কোন ছদ্মবেশী ধনকুবেরের নিকৃষ্ট তিলক বাঙালি জাতি চায় না।

প্রাচ্য পলাশ : চলচ্চিত্র নির্মাতা

ই-মেইল: prakritatv@gmail.com

ইউটিউব: PRAKRITA TV