বিশ্ব পরিমণ্ডলে বাঙালির রয়েছে আপোষহীন, সংগ্রামী ও লড়াকু জাতি হিসাবে পরিচিতি। এমন গৌরবদীপ্ত পরিচিতি একদিনে অর্জিত হয়নি। এ অর্জনের পেছনে রয়েছে লড়াই-সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস। রয়েছে সকল লড়াই-সংগ্রামের দর্শনগত ভিত্তিও।
ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের দর্শনগত ভিত্তিও এক ও অভিন্ন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির সোচ্চার দাবি থেকেই পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বাঙালির এ দীর্ঘ লড়াকু আন্দোলন। অভিন্ন দাবিতে গোটা ভারতবর্ষের আন্দোলন ছিল বৃটিশ উপনিবেশিক বেনিয়াদের বিরুদ্ধেও। অর্থাৎ জনগনের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শোষকদের বিরুদ্ধে জনগণ আন্দোলন করেছে, ঘাম ঝরিয়েছে, রক্ত ঝরিয়েছে; নির্বিশেষে জীবনও দিয়েছে। আন্দোলনে জনগণ জীবনের বিনিময়ে বিজয়ও পেয়েছে।
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি তথা মানব জীবনের সামগ্রিক মুক্তির আন্দোলনে জনগণের যে জয়লাভের গৌরবগাঁথা তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের নিরিখে নতুন প্রজন্ম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ, প্রাণিত নয়। জনগণের যে সুদীর্ঘ মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস তা বিকৃতির মাধ্যমে বির্তক সৃষ্টি করে, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত নতুন দেশ বাংলাদেশের সংবিধানে মুক্তি সংগ্রামের দর্শনগত ভিত্তিকে পাশকাটিয়ে এবং সর্বোপরি সংবিধানের বারবার নেতিবাচক সংশোধনীর মাধ্যমে তা নিশ্চিহ্ন করার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে দূরে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
তরুণ প্রজন্মও বায়ান্ন'র ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা নিয়ে গর্বিত। কিন্তু ওই সকল আন্দোলনের দর্শনগত ভিত্তি জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন কোন ধারণা সিংহভাগ তরুণের নেই। ফলে নানা রকম খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির বিরুদ্ধে নগ্ন হস্তক্ষেপ করা হয়েছে বারবার। জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার কোন সরকারি পরিকল্পনা গত ৩৯ বছরে ছিল না, বর্তমানেও নেই। বারবার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তাবেদার হিসাবে আবির্ভূত হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার জনগণের স্বার্থ রক্ষার ধারে কাছেও থাকেনি কখনো। ফলে রাজনীতিতে গণতন্ত্র উবে গিয়ে পরিবারতন্ত্র, সন্ত্রাসবাদ পোক্ত হয়েছে; কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, জলবায়ু প্রভৃতিতে দেখা দিচ্ছে মহাবিপর্যয়, ধর্মীয় অনুশাসনের দোহায় দিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে এদেশিয় সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ।
তরুণ প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অবিলম্বে দেখতে চায়। এমন বিচার শুধুমাত্র একাত্তরে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যারা এদেশের জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল কেবল তাদেরই সাজা নিশ্চিত করবে। কিন্তু একাত্তরে বিজয় অর্জনের পর গত ৩৯ বছরে যারা কৌশল পরিবর্তন করে একই ভূ-খণ্ডের জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সক্রিয় থেকেছেন এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে অনুরূপ সক্রিয়তাকে অনুমোদন দিয়েছেন, তাদের বিচার জনগণ কেন চাইবেন না, সে বিষয়ে বিস্তর গবেষণা হতে পারে। খৃষ্টাব্দ ১৯৭১-এ ঘটানো যে ধরনের তৎপরতাকে যুদ্ধাপরাধ হিসাবে আমরা জানি বা বুঝি, ১৯৭২ বা ২০১০ খৃষ্টাব্দ ওই একই ধরনের তৎপরতাকে যুদ্ধাপরাধ বলা না গেলেও দেশপ্রেম বা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বলার কোন সুযোগ নেই।
ডিসেম্বর ২০১০