মোল্লার মৃত্যুদণ্ড-জটিলতা ও বিজ্ঞ প্রসিকিউশনের কৌশলগত দুর্বলতা

তুরিন আফরোজ
Published : 2 March 2011, 05:56 PM
Updated : 10 Feb 2013, 03:52 PM

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী কাদের মোল্লার মুত্যুদণ্ড হল না। আজ পুরো জাতি মর্মাহত, স্তম্ভিত এবং ক্রুদ্ধ। সর্বসাধারণের দাবি কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড। আমিও এ দাবির সঙ্গে সহমত পোষণ করি। তবে জনগণের দাবির সঙ্গে বিজ্ঞ প্রসিকিউশনকেও আইনি লড়াইয়ে জিততে হবে।

কাদের মোল্লার মামলাটিতে বিজ্ঞ প্রসিকিউশনের কৌশলগত দুর্বলতা, অদক্ষতা ও ব্যর্থতা ছিল। বিজ্ঞ প্রসিকিউশনের কৌশলগত অদক্ষতার মূল কারণটি হল, কাদের মোল্লার অপরাধের দায়বদ্ধতা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি হিসেবে আনা হয়েছে (Individual Criminal Responsibility)। এটি আনা হয়েছে ১৯৭৩ সালের আইনের ৪(১) ধারা অনুযায়ী (সংক্ষিপ্ত রায়ের ৯০, ১০৫ এবং ১০৬ অনুচ্ছেদসমূহ দ্রষ্টব্য)।

আমার মতে, কাদের মোল্লার অপরাধের দায়বদ্ধতা নিরুপণের ক্ষেত্রে যে বিষয় বিজ্ঞ প্রসিকিউশনের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে তা হল- নেতা হিসেবে কাদের মোল্লার অপরাধের দায়বদ্ধতা (Superior Responsibility)। কাদের মোল্লা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদুল্লাহ হল ইউনিটের 'ইসলামী ছাত্র সংঘের' তৎকালীন সভাপতি (সংক্ষিপ্ত রায়ের অনুচ্ছেদ ১২ দ্রষ্টব্য)। সুতরাং সে ছিল 'ইসলামী ছাত্র সংঘের' একটি ইউনিটের নেতা, যার অধীনে বা নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে 'ইসলামী ছাত্র সংঘের' নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়িত হত। ইউনিটের অধীনস্তরা তার নির্দেশ মানতে বাধ্য ছিল, কেননা একটি অর্গানাইজড বা সংগঠিত সংঘের সদস্য বা অধীনস্তরা তাদের নেতার নির্দেশ, উপদেশ ও অবস্থান সমর্থন করবে এটাই তো স্বাভাবিক।

'ইসলামী ছাত্র সংঘ' যদি ১৯৭১ সালে আল বদর বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় (সংক্ষিপ্ত রায়ের অনুচ্ছেদ ৮ দ্রষ্টব্য), তাহলে এ সিদ্ধান্ত-নীতি বাস্তবায়নের দায়িত্বে কাদের মোল্লা অবশ্যই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এটি আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না যে, সে তার ইউনিটের সভাপতি হিসেবে আল বদরদের পরিকল্পনা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে অধীনস্তদের সংগঠিত করেছে। অতএব, ১৯৭৩ সালের আইনের ৪(২) ধারা অনুযায়ী কাদের মোল্লার অপরাধের দায়বদ্ধতা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি হিসেবেই নয়, বরং একটি সংগঠিত বা অর্গানাইজড ইউনিটের নেতা হিসেবেও (Superior Responsibility) আনা উচিত ছিল। সংঘটিত অপরাধসমূহের দায়বদ্ধতা যদি একজন ব্যক্তি হিসেবে তার কম হয়েও থাকে, ইউনিটপ্রধান হিসেবে তার অপরাধের দায়বদ্ধতা ছিল অনেক বেশি। তবে বিজ্ঞ প্রসিকিউশন কাদের মোল্লার অপরাধের দায়বদ্ধতা শুধুমাত্র ১৯৭৩ সালের আইনের ৪(১) ধারা অনুযায়ী এনেছে। বিজ্ঞ প্রসিকিউশন ৪(২) ধারা অনুযায়ী কাদের মোল্লার উপর অপরাধের দায়বদ্ধতা অর্পণে ব্যর্থ হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, অপরাধের দায়বদ্ধতা ১৯৭৩ সালের আইনে ৪(১) এবং ৪(২) ধারা অনুযায়ী যুগপৎ আনা সম্ভব; এক্ষেত্রে আইনি কোনো নিষেধাজ্ঞা নাই।

আইন পরিবর্তন করে যদি বিজ্ঞ প্রসিকিউশন এবং আসামিপক্ষের আপিল করার অধিকারের ক্ষেত্রে সমতা আনা হয়, সেটা নিঃসন্দেহে মামলারত দু'পক্ষকে আইনের সমান সুযোগ লাভে সক্ষম করবে। ফলে, সাজা বাড়ানোর দাবিতে বিজ্ঞ প্রসিকিউশনও আপিল দায়ের করার সুযোগ পাবে। সরকার বর্তমানে এ ধরনের একটি আইন প্রণয়নের চিন্তা-ভাবনা করছেন, যাতে ট্রাইবুনালের কোনো রায়ে দণ্ডের বা সাজার পরিমাণ কম মনে হলে প্রসিকিউশন সাজা বৃদ্ধি করার জন্য আপিল করতে পারে। তবে কাদের মোল্লার মামলার ক্ষেত্রে যদি প্রসিকিউশনের কোনো কৌশলগত দুর্বলতা বা অদক্ষতা থেকেই যায়, সেক্ষেত্রে নতুন আইনের অধীনে তার মামলার বিজ্ঞ প্রসিকিউশন আপিল করার সুযোগ লাভ করলেও, তার মৃত্যুদণ্ডের সাজা নিশ্চিত করার বিষয়টি সুদূরপরাহত থেকেই যাবে।

এ মূহুর্তে প্রসিকিউশনের উচিত শুধুমাত্র আপিলের রায় অথবা আইন সংশোধনের অপেক্ষায় না থেকে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে নতুন চার্জ এনে আরও এক বা একাধিক মামলা দায়ের করা। সে ১৯৭১ সালে 'কসাই মোল্লা' নামে পরিচিত ছিল। তার কৃত অপরাধের সংখ্যা অগণিত। বর্তমান মামলাটিতে বিজ্ঞ প্রসিকিউশন তার বিরুদ্ধে শুধুমাত্র ৬টি চার্জ এনেছে। এত কম চার্জ আনার পেছনে সম্ভাব্য কারণগুলো ছিল- তদন্তের অপ্রতুলতা; ভয়ভীতির কারণে ভিকটিম, প্রত্যক্ষদর্শী অথবা সাক্ষীদের অসহযোগিতা; তদন্ত এবং প্রসিকিউশন টিমের মাঝে সমন্বয়হীনতা; আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সম্পর্কে প্রসিকিউশন টিমের জ্ঞানের অগভীরতা ইত্যাদি।

দেশে আজ যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে একটি গণজোয়ার চলছে। রাজনৈতিক পরিমন্ডলেও লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। এমন একটি অনুকূল পরিবেশে ভিকটিম, প্রত্যক্ষদর্শী বা সাক্ষীরা নির্ভয়ে এবং স্বতঃস্ফুর্তভাবে এগিয়ে আসবে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রদানের জন্য। তদন্ত এবং বিজ্ঞ প্রসিকিউশনের এ মূহুর্তে উচিত সঠিক কৌশল নির্ধারণের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত তদন্ত ও বিশ্লেষণ করে ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে এক বা একাধিক ফরমাল চার্জ দাখিল করা। এক্ষেত্রে অবশ্যই তদন্ত টিম এবং প্রসিকিউশনকে তাঁদের ফৌজদারী এবং প্রথাগত অনুশীলনীয় সংস্কৃতির পরিসীমা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন এবং সংশ্লিষ্ট মামলার রায়ের আলোকে আমাদের ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলোকে পরিচালনা করতে হবে।

যুগে যুগে সত্যের জয় অনিবার্য। সত্য তার আপন রূপে প্রতিভাত হতে বাধ্য; কিন্তু কখনও কখনও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করতে হয়। সে লড়াইটিই এখন আমাদের করতে হচ্ছে।