বাংলালিংক কর্মীদের চাকুরিচ্যুতিও কি ‘বাংলালিংক দামেই’ করছে?

সাঈদ কাজী
Published : 15 Feb 2016, 05:07 PM
Updated : 15 Feb 2016, 05:07 PM

মুনার পেটে যখন রেঞ্ছু হাত দিল সাথে সাথেই প্রিয়া বলে উঠলো "আমার ভাগ্নে ইঞ্জিনিয়ার হবে"। রেঞ্ছু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করাতেই মুনা বলে উঠলো তার বাবা চেক করেছে এবং তাদের ঘরের ট্র্যাডিশন মেয়ে হলে ডাক্তার আর ছেলে হলে ইঞ্জিনিয়ার। আর তখনই রেঞ্ছু বলে উঠলো "ভাই তু আন্দার ই রেহ, বাহার বাহুত সার্কাস হে, তেরা নানা সার্কাস কা রিং মাস্টার, ওহ রিং ঘুমায়েগা ওর বলেগা ভাগো ইঞ্জিনিয়ার বানো"।"ত্রি ইডিয়টস" মুভির রিং মাস্টার 'ভীরু সাহস্ত্রু বুদ্ধের' মত দেশের অন্যতম প্রধান মোবাইল কোম্পানি 'বাংলালিংক' তেমনই রিং মাস্টারের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে কোম্পানিতে কর্মরত শত শত কর্মীর উপরে। আর এখানে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য নয়। মূলত তাদের কোম্পানি থেকে অন্যায়ভাবে ইঞ্জিনিয়ার ভাগানোর জন্যই কর্তৃপক্ষ রিং মাস্টারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

ফ্লাশব্যাক:
২০০৫ সালে দেশীয় মোবাইল কোম্পানি 'সেবা' র সাথে মিশরীয় কোম্পানি ওরাসকম একীভূত হয়ে গঠন করে বাংলালিংক। চতুর্থ মোবাইল সেবা দান কোম্পানি হিসেবে দেশের মার্কেটে প্রবেশ করলেও এই সেক্টরে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে বাংলালিংক। অল্প সময়ের মধ্যে উন্নত নেটওয়ার্ক এবং গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করে এই কোম্পানি দেশের মোবাইল সেবাদানে দ্বিতীয় স্থানে চলে আসে। বর্তমানে এর গ্রাহক প্রায় ৩ কোটির উপরে। আর কোম্পানির এরুপ সাফল্যের রূপকার হল এই কোম্পানিতে কর্মরত হাজার হাজার কর্মী। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আজকে বাংলালিংককে কোম্পানি হিসেবে এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে। এই কোম্পানিতে কর্মরত ইঞ্জিনিয়াররা দিন রাত ছব্বিশ ঘণ্টা শ্রম প্রদানের মাধ্যমে গত প্রায় ১০ বছর ধরে গ্রাহকদের জন্য নিরবছিন্ন মোবাইল সেবা নিশ্চিত করে আসছে। এক্ষেত্রে দেখা গেছে চাকরীর কারনে হয়তো অনেক ঠিকমত সময় দিতে পারতেন না পরিবার কে, উপস্থিত থাকতে পারতেন না সামাজিক প্রোগ্রামে। হয়তো অনেকের কাছে তারা পরিগনিত হয়েছেন অসামাজিক জীব হিসেবে। কিন্তু চাকরী একটা দায়িত্ব। আর যেহেতু মোবাইল পরিসেবা কোম্পানি গুলো পাব্লিঙ্ক ডিলিং এর সাথে রিলেটেড সেখানে তাদের কাজই হল ২৪ ঘণ্টা মানুষের জন্য সেবা নিশ্চিত করা। এবং খুব দক্ষতার সাথেই এসব কর্মী কাজ টা করে আসছেন বলেই আজকে দেশে বাংলালিংক দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল সেবা কোম্পানি। বর্তমানে নেদারল্যান্ড ভিত্তিক ভিম্পেলকম এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান বাংলালিংক।

ঘটনার সূত্রপাতঃ
লেবার'ল এর সব কোড অব কন্ডাক্ট মেনে গত ৩১/০১/২০১৬ সালে গঠিত হয় 'বাংলালিংক এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন'। মূলত কর্মী ছাঁটাই বন্ধ এবং ক্রমাগত এমপ্লিইজদের সুযোগ সুবিধা কমিয়ে নিয়ে আসায় তা নিশ্চিত করার জন্যই এই ইউনিয়ন গঠন করা হয়। যার সভাপতি হন প্রকৌশলী উজ্জ্বল সাহা এবং সাংগঠনিক সম্পাদক হন প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোস্তাক। ইউনিয়ন টি শ্রম মন্ত্রনালয়ের এপ্রুভালের অপেক্ষায় আছে। এরই মধ্যে হঠাৎ করে গত ১১/০২/২০১৬ তারিখে প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম ভুঁইয়া কে কোন কারন ছাড়াই সন্ধ্যায় চাকরীচ্যুত করা হয়। বিনা কারনে চাকরীচ্যুত করার প্রতিবাদে কর্মীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং ওইদিন রাতে চীফ টেকনিক্যাল অফিসার (সিটিও)পেরেহেনি এলহামি কে অবরুদ্ধ করে রাখেন। পরে র্যািব পুলিশের উপস্থিতিতে সমাধানের আশ্বাস দিয়ে তিনি মধ্য রাতেই কর্মস্থল ত্যাগ করেন। ইউনিয়ন সভাপতি ওইদিনের মত কর্মসূচী বন্ধ করে গত রবিবার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচীর ঘোষণা দেন এবং অফিস আওআর শুরুর এক ঘণ্টা আগেই তারা তাদের কর্মসূচী পালন করবেন বলে ঠিক করেন। কিন্তু শনিবার মধ্যরাতেই এক মেইলের মাধ্যমে অথোরিটি অফিস টাইম এক ঘণ্টা এগিয়ে নিয়ে আসে। রবিবার দিনভর উত্তেজনার মধ্যে ইউনিয়ন এর সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ মোস্থাককে ডেকে নিয়ে ইন্টারোগেট শুরু করা হয়। এই বিষয়ে উজ্জ্বল পাল বলেন, "বাংলালিংকের ফরেনসিক ইনভেস্টিগেটর মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) সেলিম কবির, সিকিউরিটি ম্যানেজার মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) শেখ মঈনুল হাসান ও হেড অব অপারেশনস মারুফ আহমেদ বেলা ১২টার দিকে মোস্তাককে অফিস ভবনের লেভেল থ্রিতে ডেকে নিয়ে যান।"তারা তাকে 'ইন্টারোগেট' করা শুরু করেন। এক পর্যায়ে মোস্তাক 'সেন্সলেস' হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তারপর তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। আমাদের কাউকে ধরতে দেওয়া হয় নাই।"(সুত্রঃবিডিনিউজ) বর্তমানে তিনি রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন এবং এখনো আশঙ্খা মুক্ত নন। এরই মাঝে বাংলালিংক কত্রিপক্ষ আর কোন কর্মী ছাঁটাই করা হবে না বলে কোম্পানির "ওভারঅল রিস্ট্রাকচারিং" কথা বলে "স্বেচ্ছায় চাকরী ছাড়ার স্কিম" নামে একটি প্যাকেজ ঘোষণা করে। তবে ইতিহাস বলে, প্রাইভেট কোম্পানি এসব স্কিম নামেই ঘোষণা করে থাকে। কিন্তু কাজের বেলায় চাকরী ছাড়ার পর এমপ্লইজদের বিভিন্ন প্রবলেম দেখিয়ে এসব প্রমিজ কখনো ফুলফিল করেন না।

কর্মী ছাঁটাই কেনঃ
কর্মী ছাঁটাই এর যেসব কারন বাংলালিংক হাইয়ার ম্যানেজমেন্ট দেখাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম কারন হল কোম্পানি লাভের মুখ দেখছেন না। এই কারন টা খুবই হাস্যকর একটা কারন। যেখানে মোবাইল কোম্পানি হাওয়াতেই ব্যবসা করে সেখানে কোম্পানি লাভের মুখ দেখছেনা?? এই কথা পাগল ও বিশ্বাস করবেনা। আর যদি তাই হত গত প্রায় ১১ বছর কিভাবে তারা ব্যবসা চালিয়ে গেল??? কিভাবে তারা দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল কোম্পানি হল?? এখানে উল্লেখ্য যে বাংলালিংক প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা লাভ করে থাকে। আর মুনাফার খবর কোম্পানি প্রকাশ করেনা শুধু মাত্র কর্মী দের লাভের অংশ দিতে হবে বলে। যেটা অন্যান্য মোবাইল কোম্পানি করে থাকে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার লাভের অংশ তো দূরে থাক, উল্টো কোম্পানি কর্মীদের সুযোগ সুবিধা গনহারে কমিয়ে দিয়েছে। এবং মরার উপর খাঁড়ার গা হিসেবে শুরু করেছে কর্মী ছাঁটাই। যেখানে বাংলাদেশের লেবার'ল তেই বলা আছে কোন কারন ছাড়া কর্মী ছাঁটাই আইনের পরিপন্থী। বাংলালিংক নামে বাংলা হলেও এটা চালায় বিদেশি কোম্পানি ভিম্পেলকম। প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা তারা নিয়ে যাচ্ছে দেশের বাইরে। অথচ এই দেশের কর্মীদের দিয়ে গরুর মত খাটাখাটনি করিয়েও সেই হিসেবে সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে না এই প্রতিষ্ঠান। উপরন্তু চালাচ্ছে ছাঁটাই।

টেলিকম সেক্টর বর্তমানে বাংলাদেশে একটি সেচুরেটেড সেক্টর হিসেবে গন্য করা হয়। তার উপর স্পেসিফিক ক্যাটাগরির জব হওয়াতে এই সেক্টরের যারা জব করেন তারা জব ছেড়ে হঠাৎ করে অন্য জবে যাওয়াও বলতে গেলে অসম্ভব। তাই একবার চাকরী চলে গেলে আরেকটি সেইম চাকরী পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

একবার ভাবুন যারা বর্তমানে সেখানে কর্মরত আছেন হয়তো সেই সব কর্মীদের টাকাতেই চলে কারো সংসার, কারো সন্তানের স্কুল, কিংবা কারো মা বাবার চিকিৎসা। বলতে গেলে একটি সংসারের স্বপ্নই হয়তো গড়ে উঠেছে বাংলালিংকে কর্মরত একজন কর্মীর বেতনের টাকার উপর। যেই শরিফুল ভুঁইয়া হয়তো প্ল্যান করেছিলেন শুক্রবার উইকেনড। তাই পরিবার নিয়ে বেড়াতে যাবেন দূরে কোথাও, কিংবা তার সন্তানেরা প্ল্যান করে রেখেছে কাল বাবার ছুটি। বাবাকে নিয়ে ঘুরতে বের হব। সেই শরিফুল ভুঁইয়া উইএন্ডের আগের দিন সন্ধ্যায় জানতে পারলেন যেই প্রতিষ্ঠানে তিনি নিরলস শ্রম দিয়ে এসেছেন গত ১১ বছর, যেই প্রতিষ্ঠানে তিনি কাটিয়েছেন তার চাকরী জীবনের বসন্ত সেই প্রতিষ্ঠান কোন ধরনের কারন ছাড়াই তাঁকে চাকরীচ্যুত করেছে!!! কিংবা একবার ভাবুন মোহাম্মদ মোস্থাকের কথা। যেই প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করেছেন গত ১০-১১ বছর সেই প্রতিষ্ঠানের অথরিটির জেরার মুখে পড়ে আজ হাসপাতালের মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন!!!!! এরকম আরও শত শত কর্মী আছেন যারা প্রতিনিয়ত মানসিক যন্ত্রণায় আছেন কখন তার উপর ছাঁটাই নামক খড়গহস্ত নেমে আসে। হয়তো তাদের পরিবারও আজকে সেই মানসিক যন্ত্রণায় জড়িয়ে গেছে। কারন সংসার নামক যুদ্ধ ক্ষেত্রটা যে তার টাকাতেই চলে।

এরুপ অন্যায় ছাঁটাই মেনে নেয়া যায়না। মেনে নেয়ার নয়। উপরিউক্ত বিষয় গুলো বিবেচনায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের আশু হস্থক্ষেপ কামনা করছি। হয়তো কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ বাঁচিয়ে দিতে পারে হাজার হাজার কর্মী এবং তাদের পরিবারের ভবিষ্যৎ।