ব্লগের জন্য নীতিমালার দাবী এবং ‘ব’ ও ‘চ’-এর অপপ্রয়োগ

এহসানুল করিম
Published : 15 June 2012, 05:42 PM
Updated : 15 June 2012, 05:42 PM

১.
আজ দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকার প্রথম পাতায় বিপ্লব রহমানের "যাচ্ছেতাই ভাষা বাংলা ব্লগে* নিয়ন্ত্রণ বা সঞ্চালন নেই* বিরূপ প্রভাব তরুণ প্রজন্মে* দাবি উঠেছে নীতিমালার শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। গতকাল শেষরাতে অমি রহমান পিয়াল এই প্রতিবেদনের লিংকটি শেয়ার করার ফলে শেষরাতেই প্রতিবেদনটি পড়েছি। পড়ার পর থেকেই মুখতার আহমেদ স্যারকে বারবার মনে পরছে। নটর ডেম কলেজে মুখতার আহমেদ স্যার আমাদের বাংলা পড়াতেন। প্রথম ক্লাশেই তিনি সাবধান করে দিয়েছিলেন যেন মধুসূদন দত্ত লিখতে গিয়ে 'স'-এর স্থানে 'চ' অপপ্রয়োগ না করি। এই প্রতিবেদনের মূলসূত্র শুধু 'চ'-এর অপপ্রয়োগ। প্রতিবেদক বিপ্লব রহমান সহজলভ্য 'স' না দেখে খুঁজে খুঁজে 'চ'-কে হাইলেট করেছেন সম্ভবত 'চ'এর প্রতি তার গাঢ় ভালবাসা বা বিদ্বেষ থেকে। কিন্তু একথা সত্য যে, জীবনে প্রাকৃতজনের সহজবোধ্য 'চ'-এর দরকার আছে, তা না হলে শুধুমাত্র টেস্ট টিউব ভরসায় বিপ্লব জন্মানো অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও পক্ষপাতদুষ্ট।

২.
এই প্রতিবেদনে বিশিষ্ট জনদের মতামত সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এই মতামতকে কেন্দ্র করেই প্রতিবেদক নীতিমালা দাবী উত্থাপন ছাড়া আর কোন বিকল্প খুঁজে পান নাই। একটা বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, বিশিষ্টজনদের বক্তব্য নেয়া হয়েছে অশ্লীল শব্দের ব্যবহার নিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই অশ্লীলতার বিরুদ্ধে তারা মতামত দিয়েছেন। ব্লগের জন্য ইতোপূর্বেই প্রথম আলোসহ অন্যান্য কয়েকটি কর্পোরেট ব্লগ নীতিমালার জন্য তদবীর শুরু করেছিল। পরবর্তীতে ব্লগ এবং অনলাইন কমিউনিটির প্রতিক্রিয়া দেখে তদবীরকারীদের কেউ কেউ পিছিয়ে যায় এবং দাবীটি নীরব হয়ে যায়। কিন্তু নতুন করে এই দাবী নিয়ে দলভুক্ত হল কালের কন্ঠ। পত্রিকার জন্য একটি নীতিমালা আছে, "যাচ্ছেতাই ভাষা বাংলা ব্লগে* নিয়ন্ত্রণ বা সঞ্চালন নেই*- এইভাবে সকল বাংলা ব্লগকে দোষারোপ করে নীতিমালা লংঘনের মাধ্যমে উৎসাহী যোগদানের পশ্চাতে যে শুভ উদ্দেশ্য নাই এটা স্পষ্ট।

৩.
প্রতিবেদনটিতে মিথ্যা এবং ভুল তথ্য আছে। প্রতিবেদনের হেডিং "যাচ্ছেতাই ভাষা বাংলা ব্লগে" প্রতিবেদক প্রতিবেদনে যে কয়টি ব্লগের নাম উল্লেখ করেছেন তার কোনটির মধ্যে উনি যাচ্ছেতাই ভাষা পেয়েছেন!! কতিপয় বাংলা ব্লগে হয়তো অশ্লীল/যাচ্ছেতাই শব্দ ব্যবহৃত হয়। তবে প্রেক্ষাপট অনুযায়ী সেইসব বিবেচনা করা উচিত। সংবাদের সাব হেডিং * নিয়ন্ত্রণ বা সঞ্চালন নেই" -এই অদ্ভুত তথ্য তিনি পেলেন কোথায়! কারন তার প্রতিবেদনের একটা অংশে উল্লেখ করেছেন 'আমার ব্লগ' একমাত্র সঞ্চালকহীন ব্লগ। কোন তথ্যটা সত্য! সাব হেডিং * বিরূপ প্রভাব তরুণ প্রজন্মে"- প্রতিবেদকের আজব আবিস্কার এই বিরুপ প্রভাব। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, কালের কন্ঠ তার প্রতিপক্ষ পত্রিকার লোকজন কোন দিকে তাকিয়ে মূত্র ত্যাগ করে, উটপাখির সাথে সিজদার মিল প্রভৃতি বিষয়ে সৃজনশীল আবিস্কার ও প্রতিবেদন প্রকাশের কারনে অনলাইন কমিউনিটিতে আলোচিত হয়। অনলাইন কমিউনিটির কল্যানেই প্রতিবেদকের আবিষ্কৃত 'বিরুপ প্রভাবে' প্রভাবিত তরুণ প্রজন্ম কালের কন্ঠ উচ্চারন ও লিখনে 'ক'-এর স্থানে 'ব' অপপ্রয়োগ ঘটাতে থাকে। সাব হেডিং-এর শেষ অংশটি"* দাবি উঠেছে নীতিমালার" প্রকৃতপক্ষে প্রতিবদনের হেডিং হওয়া উচিত ছিল। এখন সরাসরি প্রশ্ন হল, কালের কন্ঠ এবং প্রতিবেদক এই দাবী কোথায় পেলেন! আপনাদের কাছে কোন কোন ব্লগার এবং কোন কোন ব্লগ এবং সুশীল সমাজের কোন কোন সুশীল এই আকুল দাবী জানিয়েছেন! অনলাইন কমিউনিটির কারনে জামায়ত এবং যুদ্ধাপরাধীরা কোণঠাসা, কোনঠাসা অবস্থায় আছে কালের কণ্ঠের সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন (মতিকণ্ঠ নামক একটি ওয়েব সাইটের কল্যাণে), কোনঠাসা হয়ে আছেন চমকের মন্ত্রীসভার চমকপ্রদ মন্ত্রীবৃন্দ এবং বোরখা ফখরুলের দল। সুতরাং নীতিমালার দাবী প্রকৃতপক্ষে কাদের স্বার্থ রক্ষা করে সহজেই অনুমেয়।

৪.
যে কোন পাঠক প্রতিবেদনটি একটু মন দিয়ে পড়লেই পরস্পর বিরোধী বক্তব্যগুলো স্পষ্ট অনুধাবন করতে পারবেন। কালের কন্ঠের সাবেক সম্পাদক অভিজ্ঞ আবেদ খানের দীর্ঘদিন লেগেছিল কালের কন্ঠের হলুদ সাংবাদিকতা বুঝতে। ইমদাদুল হক মিলন আবেদ রহমানের মত ততটা অভিজ্ঞ হন নাই। পত্রিকার সাধারন পাঠক আর অনলাইন কমিউনিটির সচেতন ব্লগারগন আবেদ খানের অনেক আগেই কালের কন্ঠের সাংবিদকতার রংটি চিনে গিয়েছিলেন। বিপ্লব রহমান এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে সেই রং-কে আরও একটু গাঢ় করলেন মাত্র।

৫.
বাংলা ব্লগ এবং অনলাইন কমিউনিটি গত পাঁচ বছরে অনেক ঋদ্ধ হয়েছে। বাংলা ব্লগিং-এর প্রথম দিকে হয়তো যাচ্ছেতাই ভাষা, আলাপ আলোচনা, লক্ষ্যহীন ব্লগিং বা লিটিলম্যাগ ধরনের সাহিত্য কেন্দ্রিক এলোমেলো একটা চরিত্র ছিল। আজ প্রতিটা প্রতিষ্ঠিত বাংলা ব্লগ একটা নিজস্ব চরিত্র সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে। এখন আর প্রতিষ্ঠিত ব্লগসমূহে যাচ্ছেতাই ভাষা ব্যবহারের সুযোগ নাই। তবে কখনও কখনও আবেগজনিত কারনে বিশেষত জামায়াতের একাত্তুরের ভূমিকা এবং চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে নতুন প্রজন্মের ঘৃনা ও অবস্থান ভদ্রবাক্যে প্রকাশ করা সম্ভব নয় বিধায় সুশীলদের বিবেচনায় তথকথিত অশালীন ভাষা ব্যবহারের কোন বিকল্প তরুন প্রজন্মের কাছে নাই।

৬.
ব্লগ এবং ব্লগারদের চেস্টায় বাংলা ব্লগ বিকল্প মিডিয়া হিসাবে একটি শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। অনেক সাংবাদিক আজ ব্লগে লিখেন। কারন ব্লগে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে আপোষ করতে হয়না। সচেতন নাগরিক এবং তরুন প্রজন্মের কাছে ব্লগ পাঠ করা বা লিখায় নিজের মতামত প্রদান করা এখন একটি স্বাভাবিক অভ্যাস। বাস্তব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় জনমত গঠন ও প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে ব্লগ এবং অনলাইন কমিউনিটির বিশাল শক্তি শুধু রাজনীতিকদের নয় কর্পোরেটদের কাছেও অসহনীয়। এই বিশাল ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে নিজ স্বার্থে ব্যবহারের জন্যই প্রয়োজন নীতিমালা নামক কন্ঠরোধের হাতিয়ার। সেই হাতিয়ার প্রয়োগের লক্ষ্যে ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য ধারাবাহিক কার্যক্রম যে বন্ধ নেই তার প্রমান আজকের কালের কন্ঠের রিপোর্টটি। ধারাবাহিক কার্যক্রমের প্রথম উদ্বোধন করেছিলেন 'সীমান্তে হত্যাকান্ড চলবেই' মতবাদের প্রাণপুরুষ আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ। তিনি বলেছিলেন বাংলা ব্লগগুলি হচ্ছে পর্নোগ্রাফী। উনাকে সামনে পেলে প্রশ্ন করতাম, 'স্যার , আপনি বাংলা ব্লগ পড়তে কোন সাইটে ঢুকে পড়েছিলেন? সাইটের নাম আর ব্লগ লেখকের নামটা বলুন স্যার। লজ্জা পাবেননা, এ্যাকসিডেন্ট ইজ এ্যাকসিডেন্ট!!"

৭.
ব্লগের নীতিমালার দাবী নিয়ে কালের কন্ঠ পত্রিকার প্রতিবেদনটি যিনি তৈরী করেছেন তার নাম মধুসূদন নয়। মধুসূদন হলে মুখতার আহমেদ স্যারের নিষেধ অমান্য করে 'স'-এর স্থলে 'চ'-এর অপপ্রয়োগ ঘটাতাম। এখানে আমি একটাও অশ্লীল শব্দ ব্যবহার না করে অশ্লীল ভাব প্রকাশ করেছি। কালেরকণ্ঠ, প্রতিবেদক আর যারা সুশীল ভাষা শিখাতে চান তারা এক্ষেত্রে কি করবে খুব জানতে ইচ্ছে করে।

এই পোস্টটির সাথে সহমত পোষণ করলে লিখাটি শেয়ার করুন।

ফেসবুক আইডি Abu Sayeed Ahamed